Students Health Home

স্টুডেন্টস হেলথ হোমঃ একটি আন্দোলন

বিশেষ বিভাগ

মালিনী ভট্টাচার্য   


স্টুডেন্টস হেলথ হোমকে গুগলে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, তাকে বলা হয়েছে একটি এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অথচ স্টুডেন্টস হেলথ হোম নিজেকে নিজে বলছে, কোনো এনজিও নয়, একটি জন-আন্দোলন যা কোনো দলীয় রাজনীতির অংশীভূত নস্টুডেন্টস হেলথ হোম: একটি আন্দোলন
মালিনী ভট্টাচার্য   
স্টুডেন্টস হেলথ হোমকে গুগলে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, তাকে বলা হয়েছে একটি এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অথচ স্টুডেন্টস হেলথ হোম নিজেকে নিজে বলছে, কোনও এনজিও নয়, একটি জন-আন্দোলন যা কোনও দলীয় রাজনীতির অংশীভূত নয়। আসলে গুগলের এলেম যতোই থাকুক, তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে কলকাতার জগদীশচন্দ্র বোস রোডের ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা ইট-কাঠ-কংক্রিটের একটি স্থাবর প্রতিষ্ঠান আবার কী করে একটি ‘জন-আন্দোলন’ও হতে পারে। 
সেকথা বুঝতে হলে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে-থাকা হোমের শাখাগুলির কথাই শুধু নয়, জানতে হবে ১৯৫২ সাল থেকে তার ইতিহাসকেও। জানতে হবে এর নিয়মিত কর্মীদের পাশাপাশি এর সঙ্গে নানাভাবে সদস্যতার অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকা ডাক্তার, সেবাকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী ও নানা পেশার অসংখ্য মানুষকেও। জানতে হবে এর বহমান ঐতিহ্যকে। আমি ১৯৬৩-৬৪ তে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া হিসাবে প্রথম এর কথা শুনি। শুনেছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে হেলথ হোমের একটি বিশেষ সম্পর্ক বরাবরই ছিল। হোমেরই সহায়তায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কালপর্বে সম্ভবত এ রাজ্যে যে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম স্বেচ্ছা রক্তদান শিবির সংগঠিত হয়। 
কিন্তু এ রাজ্যের আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রাতিষ্ঠানিক সদস্যতার মাধ্যমে হোম তার শিকড় ছড়িয়েছে, আর সেখানে তার পরিচিতি শুধু ছাত্রদের জন্য বিনাব্যয়ে বা স্বল্পব্যয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও চিকিৎসার একটি কেন্দ্র হিসাবে নয়। রাজ্যজোড়া বিশেষ ধরনের এক অনাড়ম্বর অথচ শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উৎসস্থল বলে। আন্দোলনের জোয়ার ভাটা থাকে। এখানেও তাই। কিন্তু এর সঙ্গে যে সংগঠকেরা জড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা খুব দুঃসময়েও এর গতিকে পাঁকে মজে যেতে দেননি। 
হয়তো আমরা অনেকে জানি না, ব্রিটিশ আমলে ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্কটকালে কিছু চিকিৎসক, কিছু সেবাব্রতী মানুষ একত্র হয়ে এই বাংলায় গড়ে তুলেছিলেন পিপলস রিলিফ কমিটি, সামগ্রিকভাবে ত্রাণের কাজে যুক্ত হলেও জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন যাঁরা। আজও পিআরসি অনলস অধ্যবসায়ে সব প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে সে কাজ করে যাচ্ছে, কারণ তারও প্রথম থেকেই এই সাংস্কৃতিক অভিমুখ ছিল। স্বাধীনতার পাঁচ বছর বাদে জন্ম-নেওয়া হেলথ হোমকে সেই সামগ্রিক অর্থেই পিআরসি’র সহোদরা বলতে পারি আমরা।
কী এই আন্দোলনের সাংস্কৃতিক মর্মকথা? তা হলো সকল মানুষের ভালো থাকা। দীর্ঘ বিদেশি শাসনের ভুক্তভোগী আমরা, এমন দেশের মানুষ যারা দুশো বছর ধরে একের পর এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে, না-খাওয়া মানুষগুলো যক্ষ্মায় ভুগেছে, কলেরা বা ম্যালেরিয়ার মহামারীতে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে মরেছে; সে দেশের মানুষের মতো কেই বা জানে পর্যাপ্ত খাদ্য, নীরোগ জীবন, অশিক্ষা থেকে মুক্তি এইসবই মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। আর স্বাধীন দেশের সংবিধানে সেই সমানাধিকারের কথা কাগজেকলমে বলা আছেও বটে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন বড়ই কঠিন, তা কখনোই হতে পারে না যদি মানুষ তার নিজের অধিকার চিনে না নেয়। সে চেতনার উন্মেষে সহায়তা করাই পিআরসি বা হেলথ হোমের সংস্কৃতি, যদি রাজনীতি বলেন এটাই তাদের রাজনীতি। 
কিন্তু শুধু প্রচার তাদের কাজ নয়। হেলথ হোমের কথায় যদি ফিরে আসি তাহলে বলা যায়, সদ্য স্বাধীন দেশে এসবের জন্য কোনও সরকারি পরিকাঠামো তৈরি হবারও আগে থেকে তারা নজর দিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে, যে তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনের ভারত তৈরি করবে বলে আমরা মনে করি। হেলথ হোম ভোলেনি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা, স্বাধীনতা আসার আগেই দুরন্ত যক্ষ্মা যাঁর জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। 
স্বাস্থ্য সচেতনতা যদি আনতে হয় তাহলে আর কোনও সুকান্তের জীবন যেন অকালে ঝরে না যায় তার ব্যবস্থাও করতে হবে। সেই সংকল্প নিয়েই হেলথ হোমের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবীরা সেই সময় থেকেই স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও চিকিৎসার একটি পরিকাঠামো গড়ে তোলাতে ব্রতী হয়েছেন। কোনও বিরাট বিনিয়োগ ছিল না তাঁদের পিছনে। ‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে/ তোমা সবাকার ঘরে ঘরে’ এই মন্ত্র নিয়েই তাঁরা কাজ করেছেন। 
একই সঙ্গে তাঁদের বার্তা এটাই ছিল যে স্বাধীন দেশের সরকার যদি জনসাধারণের নির্বাচিত সরকার হয়, তাহলে জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব সে এড়াতে পারে না। ১৯৫৯ সালে তাদের কাজকে ছড়িয়ে দিতে এবং মজবুত করতে এই পূর্বসূরিরা সরকারি অনুদানের দাবি করেছিলেন, যে দাবি বিধানচন্দ্র রায়ের সরকারের দরবারে পৌঁছে দেন তৎকালীন বিরোধী নেতা জ্যোতি বসু। তীব্র বিতর্কের পরে সরকার সে দাবি মেনে নিয়েছিল এবং ১৯৬২ থেকে হেলথ হোম সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে। এই অনুদানের দাবি যে সরকার মেনে নিয়েছিল তা কোনও দয়ার দান ছিল না, জনস্বাস্থ্যের অধিকারকেই ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছিল এর মধ্য দিয়ে। কিন্তু হেলথ হোমের মূল কাজ তাই বলে কখনোই সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েনি, যা তাদের সাহায্য করেছিল জনসাধারণের জীবনে নিজেদের শিকড়গুলিকে অটুট রাখতে। 
১৯৭৮ সালে আলমা আটায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনের ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যে’র বার্তা স্টুডেন্টস হেলথ হোমের আরব্ধ কাজকে এক সুদৃঢ় মতাদর্শের ভিত্তি তৈরি করে দিল। সমস্ত জনসাধারণের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক সুস্বাস্থ্যের অধিকার এবং বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলায় বিশ্বের সব দেশের সরকারগুলির দায়িত্বের প্রসঙ্গটি উঠে এল সেখান থেকে। এর পরবর্তী সময়ে এদেশের সরকারও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল পুষ্টি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট সরকার। সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বৃদ্ধির পাশাপাশি তারা স্টুডেন্টস হেলথ হোমের গুরুত্ব বুঝেছিল তরুণ প্রজন্মের কাছে সুস্বাস্থ্যের বার্তা পৌঁছানোতে এবং এই সময়ে অনুদান বৃদ্ধির সুযোগে হেলথ হোম তার কাজকর্ম জেলায় জেলায় আরও প্রসারিত করে। 
কিন্তু তার জীবনীশক্তি ঠিক কতটা তার প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১১ সালে জমানা বদল হবার পরে। হঠাৎ করেই বিনা বলাকওয়ায় নতুন সরকার সমস্ত অনুদান বন্ধ করে দিল। কোভিডের সময়ে তার পরিকাঠামোটিকে সরকার ব্যবহার করল ঠিকই, কিন্তু হেলথ হোম তারপরেও কোনও সরকারি স্বীকৃতিই কার্যত পেল না। তা সত্ত্বেও হেলথ হোমের আদর্শ মরেনি। কোভিডের সময়ে যে রেড ভলান্টিয়ারদের আমরা জেলায় জেলায় কোনও সরকারি সাহায্য ব্যতিরেকেই আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি, তাঁরাও কি হেলথ হোমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হননি? 
সরকারি প্রতিকূলতায় হেলথ হোমের কাজ বন্ধ হয়ে যায়নি, বরং ২০২২ সালের পর থেকে সমস্ত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীকে একত্রে জড়ো করে কঠিন অর্থ সঙ্কটের মোকাবিলা করেছেন তাঁরা। গত দু’বছরে শুধু আয়ব্যয়ের ফারাক কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন এর কর্ণধারেরা তাই নয়, কোনও কোনও পরিষেবা নতুন করে চালু করতে পেরেছেন, হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। মাটিতে আছাড় দিয়ে ফেলে দিলে যে সেই মাটিকে আশ্রয় করেই নতুন করে উঠে দাঁড়ায় তাকে ঠেকাবে কে? এইজন্যই একথা সত্য যে হেলথ হোম কোনও প্রতিষ্ঠান মাত্র নয়, হেলথ হোম একটি আন্দোলন। 
সরকারের কাছে ন্যায্য অর্থ সাহায্যের দাবি তাঁদের এবং আমরা যারা হেলথ হোমের শুভানুধ্যায়ী তাদের তো চালিয়ে যেতেই হবে। আজকের দিনে যখন সরকারি ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে তখনও। তাছাড়া তাঁদের আন্দোলনের যে সাংস্কৃতিক দিকটির কথা বললাম - স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে জনচেতনার উন্মেষে সাহায্য করা– সে কাজটি এ সরকারের পছন্দ বলে মনে হয় না। বিশেষত তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় আজ এ রাজ্যে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর ব্যাধি দূর করার নিদান। তাই তো হোমের বোনফোঁটার উৎসবে প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করা হয় পশ্চিমবঙ্গের অভয়াদের কথা। এইসব আন্দোলন নিয়েই তো হেলথ হোম। তার এই কঠিন রাস্তায় অগ্রগতির শরিক হতে চাই আমরাও এইটুকুই আজ বলার কথা।
য়। আসলে গুগলের এলেম যতোই থাকুক, তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে কলকাতার জগদীশচন্দ্র বোস রোডের ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা ইঁট-কাঠ-কংক্রিটের একটি স্থাবর প্রতিষ্ঠান আবার কী করে একটি ‘জন-আন্দোলন’ও হতে পারে। 
সেকথা বুঝতে হলে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে-থাকা হোমের শাখাগুলির কথাই শুধু নয়, জানতে হবে ১৯৫২ সাল থেকে তার ইতিহাসকেও। জানতে হবে এর নিয়মিত কর্মীদের পাশাপাশি এর সঙ্গে নানাভাবে সদস্যতার অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকা ডাক্তার, সেবাকর্মী, ছাত্রছাত্রী ও নানা পেশার অসংখ্য মানুষকেও। জানতে হবে এর বহমান ঐতিহ্যকে। আমি ১৯৬৩-৬৪ তে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোর পড়ুয়া হিসাবে প্রথম এর কথা শুনি। শুনেছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে হেলথ হোমের একটি বিশেষ সম্পর্ক বরাবরই ছিল। হোমেরই সহায়তায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কালপর্বে সম্ভবত এ রাজ্যে যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম স্বেচ্ছারক্তদান শিবির সংগঠিত হয়। 
কিন্তু এ রাজ্যের আরো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রাতিষ্ঠানিক সদস্যতার মাধ্যমে হোম তার শিকড় ছড়িয়েছে, আর সেখানে তার পরিচিতি শুধু ছাত্রদের জন্য বিনাব্যয়ে বা স্বল্পব্যয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও চিকিৎসার একটি কেন্দ্র হিসাবে নয়। রাজ্যজোড়া বিশেষ ধরণের এক অনাড়ম্বর অথচ শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উৎসস্থল বলে। আন্দোলনের জোয়ারভাটা থাকে। এখানেও তাই। কিন্তু এর সঙ্গে যে সংগঠকেরা জড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা খুব দুঃসময়েও এর গতিকে পাঁকে মজে যেতে দেননি। 
হয়তো আমরা অনেকে জানি না, ব্রিটিশ আমলে ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংকটকালে কিছু চিকিৎসক, কিছু সেবাব্রতী মানুষ একত্র হয়ে এই বাংলায় গড়ে তুলেছিলেন পিপলস রিলিফ কমিটি, সামগ্রিকভাবে ত্রাণের কাজে যুক্ত হলেও জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন যাঁরা। আজও পিআরসি অনলস অধ্যবসায়ে সব প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে সে কাজ করে যাচ্ছে, কারণ তারও প্রথম থেকেই এই সাংস্কৃতিক অভিমুখ ছিল। স্বাধীনতার পাঁচ বছর বাদে জন্ম-নেওয়া হেলথ হোমকে সেই সামগ্রিক অর্থেই পিআরসি-র সহোদরা বলতে পারি আমরা।
কী এই আন্দোলনের সাংস্কৃতিক মর্মকথা? তা হল সকল মানুষের ভালো থাকা। দীর্ঘ বিদেশি শাসনের ভুক্তভোগী আমরা, এমন দেশের মানুষ যারা দুশো বছর ধরে একের পর এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে, না-খাওয়া মানুষগুলো যক্ষ্মায় ভুগেছে, কলেরা বা ম্যালেরিয়ার মহামারীতে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে মরেছে; সেদেশের মানুষের মতো কেই বা জানে পর্যাপ্ত খাদ্য, নীরোগ জীবন, অশিক্ষা থেকে মুক্তি এইসবই মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। আর স্বাধীন দেশের সংবিধানে সেই সমানাধিকারের কথা কাগজেকলমে বলা আছেও বটে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন বড়ই কঠিন, তা কখনোই হতে পারে না যদি মানুষ তার নিজের অধিকার চিনে না নেয়। সে চেতনার উন্মেষে সহায়তা করাই পিআরসি বা হেলথ হোমের সংস্কৃতি, যদি রাজনীতি বলেন এটাই তাদের রাজনীতি। 
কিন্তু শুধু প্রচার তাদের কাজ নয়। হেলথ হোমের কথায় যদি ফিরে আসি তাহলে বলা যায়, সদ্য স্বাধীন দেশে এসবের জন্য কোনো সরকারি পরিকাঠামো তৈরি হবারও আগে থেকে তারা নজর দিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের দিকে, যে তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনের ভারত তৈরি করবে বলে আমরা মনে করি। হেলথ হোম ভোলেনি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা, স্বাধীনতা আসার আগেই দুরন্ত যক্ষ্মা যাঁর জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। 
স্বাস্থ্য সচেতনতা যদি আনতে হয় তাহলে আর কোনো সুকান্তের জীবন যেন অকালে ঝরে না যায় তার ব্যবস্থাও করতে হবে। সেই সংকল্প নিয়েই হেলথ হোমের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবীরা সেই সময় থেকেই স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও চিকিৎসার একটি পরিকাঠামো গড়ে তোলাতে ব্রতী হয়েছেন। কোনো বিরাট বিনিয়োগ ছিল না তাঁদের পিছনে। ‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে/ তোমা সবাকার ঘরে ঘরে’ এই মন্ত্র নিয়েই তাঁরা কাজ করেছেন। 
একই সঙ্গে তাঁদের বার্তা এটাই ছিল যে স্বাধীন দেশের সরকার যদি জনসাধারণের নির্বাচিত সরকার হয়, তাহলে জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব সে এড়াতে পারে না। ১৯৫৯ সালে তাদের কাজকে ছড়িয়ে দিতে এবং মজবুত করতে এই পূর্বসূরীরা সরকারি অনুদানের দাবি করেছিলেন, যে দাবি বিধানচন্দ্র রায়ের সরকারের দরবারে পৌঁছে দেন তৎকালীন বিরোধী নেতা জ্যোতি বসু। তীব্র বিতর্কের পরে সরকার সে দাবি মেনে নিয়েছিল এবং ১৯৬২ থেকে হেলথ হোম সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে। এই অনুদানের দাবি যে সরকার মেনে নিয়েছিল তা কোনো দয়ার দান ছিল না, জনস্বাস্থ্যের অধিকারকেই ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছিল এর মধ্য দিয়ে। কিন্তু হেলথ হোমের মূল কাজ তাই বলে কখনোই সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েনি, যা তাদের সাহায্য করেছিল জনসাধারণের জীবনে নিজেদের শিকড়গুলিকে অটুট রাখতে। 
১৯৭৮ সালে আলমা আটায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনের ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যে’র বার্তা স্টুডেন্টস হেলথ হোমের আরব্ধ কাজকে এক সুদৃঢ় মতাদর্শের ভিত্তি তৈরি করে দিল। সমস্ত জনসাধারণের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক সুস্বাস্থ্যের অধিকার এবং বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলায় বিশ্বের সব দেশের সরকারগুলির দায়িত্বের প্রসঙ্গটি উঠে এল সেখান থেকে। এর পরবর্তী সময়ে এদেশের সরকারও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল পুষ্টি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট সরকার। সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বৃদ্ধির পাশাপাশি তারা স্টুডেন্টস হেলথ হোমের গুরুত্ব বুঝেছিল তরুণ প্রজন্মের কাছে সুস্বাস্থ্যের বার্তা পৌঁছনোতে এবং এই সময়ে অনুদান বৃদ্ধির সুযোগে হেলথ হোম তার কাজকর্ম জেলায় জেলায় আরো প্রসারিত করে। 
কিন্তু তার জীবনীশক্তি ঠিক কতটা তার প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১১ সালে জমানা বদল হবার পরে। হঠাৎ করেই বিনা বলাকওয়ায় নতুন সরকার সমস্ত অনুদান বন্ধ করে দিল। কোভিডের সময়ে তার পরিকাঠামোটিকে সরকার ব্যবহার করল ঠিকই, কিন্তু হেলথ হোম তারপরেও কোনো সরকারি স্বীকৃতিই কার্যত পেল না। তা সত্ত্বেও হেলথ হোমের আদর্শ মরেনি। কোভিডের সময়ে যে রেড ভলান্টিয়ারদের আমরা জেলায় জেলায় কোনো সরকারি সাহায্য ব্যতিরেকেই আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি, তাঁরাও কি হেলথ হোমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হননি? 
সরকারি প্রতিকূলতায় হেলথ হোমের কাজ বন্ধ হয়ে যায়নি, বরং ২০২২ সালের পর থেকে সমস্ত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীকে একত্রে জড়ো করে কঠিন অর্থ সংকটের মোকাবিলা করেছেন তাঁরা। গত দু’বছরে শুধু আয়ব্যয়ের ফারাক কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন এর কর্ণধারেরা তাই নয়, কোনো কোনো পরিষেবা নতুন করে চালু করতে পেরেছেন, হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। মাটিতে আছাড় দিয়ে ফেলে দিলে যে সেই মাটিকে আশ্রয় করেই নতুন করে উঠে দাঁড়ায় তাকে ঠেকাবে কে? এইজন্যই একথা সত্য যে হেলথ হোম কোনো প্রতিষ্ঠান মাত্র নয়, হেলথ হোম একটি আন্দোলন। 
সরকারের কাছে ন্যায্য অর্থসাহায্যের দাবি তাঁদের এবং আমরা যারা হেলথ হোমের শুভানুধ্যায়ী তাদের তো চালিয়ে যেতেই হবে। আজকের দিনে যখন সরকারি ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে তখনও। তাছাড়া তাঁদের আন্দোলনের যে সাংস্কৃতিক দিকটির কথা বললাম - স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে জনচেতনার উন্মেষে সাহায্য করা – সে কাজটি এ সরকারের পছন্দ বলে মনে হয় না। বিশেষত তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় আজ এ রাজ্যে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভয়ংকর ব্যাধি দূর করার নিদান। তাই তো হোমের বোনফোঁটার উৎসবে প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করা হয় পশ্চিমবঙ্গের অভয়াদের কথা। এইসব আন্দোলন নিয়েই তো হেলথ হোম। তার এই কঠিন রাস্তায় অগ্রগতির শরিক হতে চাই আমরাও এইটুকুই আজ বলার কথা।
 

Comments :0

Login to leave a comment