কুমার রানা
গরম কিছুটা কমল। কিন্তু, উত্তাপ বেড়েই চলেছে। উত্তাপ ভোটের। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে দুই ভিন্ন প্রক্রিয়ার ঘর্ষণ থেকে সৃষ্ট উত্তাপ। এক, সাধারণ মানুষের ভোট প্রক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা; আর দুই, তাতে যোগ দিতে না দেওয়ার জন্য হুমকি থেকে নিয়ে গা-জোয়ারি, লাঠি, বোমা, ইত্যাদি, এমনকি প্রশাসনিক ক্ষমতার প্রয়োগ। এ রাজ্যে নির্বাচন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দমন, অত্যাচার, ও হত্যা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোটার, ভোটকর্মী, সাংবাদিক– কার নসিবে যে কী আছে, কেউ জানে না। যে-কেউই গুলি খেতে পারে, বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে, লাঠির ঘায়ে মাথা ভাঙতে পারে। একের ভোট অন্যে গিয়ে দিয়ে আসতে পারে। এককথায় নির্ভয়ে ও নিরাপদে ভোট দিতে পারার সংবিধানপ্রদত্ত অধিকারটাই লুণ্ঠিত, মানুষের হাতে যা পড়ে থাকে তা নির্ভেজাল অনধিকার। নির্বাচন হবে, লোকে ভোটে প্রার্থী হবে, ভোটার নিজের পছন্দমতো ভোট দিয়ে আসবে– এটাতো একটা অতি স্বাভাবিক এবং নিরীহ প্রক্রিয়া। অথচ এর জন্যও ভারত সরকারের সশস্ত্র বাহিনী আসছে, আদালতে মামলা হচ্ছে, প্রশাসনের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তুমুল কলহ হচ্ছে, আর জনসাধারণকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই-সব ইতর তামাশা দেখে যেতে হচ্ছে।
এই রাজনৈতিক নৈরাজ্য সৃষ্টির একাধিক কারণ আছে। আবার সেই কারণগুলি পরস্পরের সঙ্গে জটিলভাবে জড়ানো। যেমন, এর একটা কারণ অবশ্যই বর্তমানে রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল কংগ্রেস দলটির গঠনগত চরিত্র, যা তার রাজনৈতিক বিশ্বাসে গণতন্ত্রের জন্য কোনও জায়গা বরাদ্দ করেনি। রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে যাঁরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছেন, তাঁদের অনেকেই খুব সঠিকভাবেই তৃণমূলের নানান অপকর্ম ও সরকারের নানান অপশাসনের বিরুদ্ধে সরব। তা হলেও, এখানে একটা প্রশ্ন আসে, এ-রকম একটি অগণতান্ত্রিক রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল একটি দল কীভাবে সরকারে আসার মতো জনসমর্থন পেল। পাশাপাশি এই প্রশ্নও আসে, এমন একটি সরকারের বিরুদ্ধে, খাতায় কলমে হলেও, বিজেপি’র মতো একটি ফ্যাসিবাদী শক্তি কীভাবে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠল? এর অতিসরল উত্তরটা হলো রাজ্যের মানুষ এটাই চাইছে। কিন্তু, তাই যদি হতো, তাহলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতবার জন্য এত রক্তপাত ও প্রাণহানি কেন? স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে ভোট করলেই তো গোল মিটে যেত। এখানে গণতন্ত্রকামীদের একাংশ বলবেন, এটা কেবল তৃণমূলের একচ্ছত্র পঞ্চায়েত দখলের ব্যাপার নয়, সেই দলের মধ্যে আবার যে যেখানে মাতব্বর তার দখলদারির ব্যাপার। এটাও যে আংশিকভাবে সত্য তা খবরের কাগজে নানান সংবাদ দেখলে বোঝা যায়। কিন্তু, এর পরেও সম্পূর্ণ সত্যটা উদ্ঘাটিত হয় না। যা-কিছু ঘটছে, একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, রোগের লক্ষণমাত্র, যার মধ্যে সব চেয়ে কুৎসিত ও উগ্ররূপে যেটা ফুটে উঠেছে তা হলো, জুলুমের জোরে আধিপত্য– একজনই সর্বেসর্বা, সে যা বলবে, যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই শেষ কথা। এটা কেবল পশ্চিমবঙ্গের বিশেষত্ব নয়, সারা পৃথিবীতে এইরকম প্রচণ্ড দক্ষিণপন্থী একনায়কীয় শাসনকে একমাত্র ব্যবস্থা বলে তুলে ধরা হচ্ছে। তারই অনুরূপগুলির ব্রত পালিত হতে দেখা যায় জেলায়, ব্লকে, গ্রামে।
আবার, সরলভাবে দেখলে এটাকে ব্যক্তির প্রভুত্বাকাঙ্ক্ষা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আদতে এটি একটি ব্যবস্থার অন্তর্গত ব্যাপার, সে ব্যবস্থা হলো ধনতন্ত্র, গণতন্ত্রের সঙ্গে যার জন্মজাত বিরোধ। গণতন্ত্র মানে মানুষে মানুষে সহযোগ, মানুষে মানুষে সম্মানের ও ক্ষমতার সহভাগ। আর ধনতন্ত্র ঠিক এর বিপরীত – ব্যাপক মানুষের শ্রম লুট করে কতিপয়ের মুনাফার পাহাড় জমানো। দ্বন্দ্বটা মৌলিক। গণতন্ত্র মানে, মানুষের স্ব-শাসন, আর ধনতন্ত্র মানে সংখ্যালঘু তস্কর ও তঞ্চকের আধিপত্য। ১৯৭৮ সালে প্রথম ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন হবার পর থেকে এ-রাজ্যের মানুষের পঞ্চায়েত-ব্যবস্থার সঙ্গে আবেগলগ্ন হয়ে পড়ার একটা প্রধান কারণই হলো, স্ব-শাসনের প্রতি তাঁদের এত বিপুল আগ্রহ, এর রূপায়ণের বহু সীমাবদ্ধতা এবং অপ্রাপ্তি সত্ত্বেও। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যখন সজীব ছিল, যখন বামপন্থী নেতা বিনয় চৌধুরির মানুষের নিজের হাতে নিজের কাজ করে নিতে পারার ক্ষমতা বিষয়ক সেই বিখ্যাত উক্তি ঘোষিত হয়েছিল, সেই-সময়কার পঞ্চায়েতগুলোর কাজকর্ম যাঁদের স্মরণে আছে, তাঁরা বলতে পারবেন, মানুষ প্রকৃতপক্ষে কত নির্লোভ। সেদিন যে মানুষেরা পঞ্চায়েতের কাজে দিবারাত্রির ফারাক মিটিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন সেই-সব শ্রমজীবী যাঁরা লাভের বখরা চাননি, নিজের ঘর পাকা করাতে চাননি, ছেলে-মেয়ের জন্য চাকরি চাননি, বা পঞ্চায়েতের দখল রাখার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের প্রার্থী করার জন্য দলীয় নেতার পদতলে পড়ে থাকেননি। তাঁরা স্ব-শাসন চেয়েছিলেন।
কিন্তু, সাময়িক পরাজয়ে, পঞ্চায়েত স্ব-শাসনের কেন্দ্র না হয়ে হয়ে উঠল সরকারি কাজকর্ম চালানোর একটা শাখা। যার হবার কথা ছিল স্থানীয় সরকার, তথাকথিত সেই পঞ্চায়েতকে পরিণত করা হলো সরকারি বিভাগে। অতএব, পঞ্চায়েত মানে কিছু অর্থ বরাদ্দ, উন্নয়নের নামে ইট-বালি-সিমেন্ট, এবং সে-সবের হাত ধরে এল গোপনীয়তার নিশ্ছিদ্র অনুশীলন– কয়েকজন মিলে সব কিছু ঠিক করা। যে-পঞ্চায়েত দপ্তরগুলো লোকসমাগমে উজ্জ্বল হয়ে থাকত, সেই দপ্তরগুলো হয়ে উঠল অদৃশ্য মুখোশ পরা চালিয়াত-জালিয়াতদের ক্রীড়াক্ষেত্র। মানুষের নিজের শাসনের জায়গা নিল মুদ্রার শাসন। মুদ্রার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল কতিপয় ঘোর স্বার্থান্বেষী।
এমন এক অবস্থায় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করাটা যতটা জরুরি, ততটাই কঠিন। গণশত্রুরা মাঠের অনেকটাই দখল নিয়ে ফেলেছে। তাদের যদি সরাতে হয় তাহলে লোকশক্তির লৌকিক ব্যবহার ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই। আরও খোলসা করে বলতে গেলে, পঞ্চায়েত নির্বাচনকে স্ব-শাসনের সংগ্রামে পরিণত করার ডাক। পঞ্চায়েতের লব্জ থেকে প্রথমেই উন্নয়নের হেঁয়ালিটাকে সরাতে হবে। উন্নয়নের মানে কী হবে না হবে সেটা কোনও প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী-আর্থনীতিক উপদেষ্টা ঠিক করে দেবে না। সেটা ঠিক করবে স্ব-শাসনাধীন জনগণ, যার উদ্যোগই হচ্ছে সমাজের অগ্রগতির ভিত্তি। নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্য সেই জন-উদ্যোগের সংযোজক মাত্র, সে ভোটে জিতেছে বলেই তাকে বিধাতার আসনে বসানোর প্রশ্ন নেই। এ-রাজ্যে গ্রামসভার যে ধারণা গড়ে উঠেছিল, কেরালা যার সচেয়ে কার্যকর রূপ দিয়েছে, সেই ধারাতেই সাধারণ লোক, ঠিক করবে কোথায় রাস্তা হওয়া দরকার, আর কোথায় ইস্কুল, কোথায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তারা ঠিক করবে ইস্কুলটা সকালে হবে না বিকেলে। পাশাপাশি, গ্রামসভার প্রকৃত বাস্তবায়নটিকে ধারণাগতভাবে আরও প্রসারিত করতে হবে, এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এই স্ব-শাসনের রূপ এমন হবে যাতে এমনকি যারা নির্বাচক নয় তারাও এই ব্যবস্থায় যোগ দিতে পারে। উদাহরণ হিসাবে, স্থানীয় স্কুলটা কীভাবে পরিচালিত হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে, পঞ্চায়েত সদস্য থেকে নিয়ে, মা-বাবা, শিক্ষক, এবং ছাত্র-ছাত্রী, সকলের মতামত আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হবে। আজকের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনের নির্বাচক, গণতন্ত্রের অনুশীলনে যোগদানের দিকটা একদিকে যেমন তাদের শিক্ষার ব্যাপার, অন্যদিকে তেমনি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারেরও ব্যাপার। তেমনি প্রতিটি কাজে অঞ্চলের মেয়েদের নেতৃত্ব স্বীকার করে নেওয়াটা হবে একটা আবশ্যিক কর্মসূচি। স্ব-শাসনকে সম্পূর্ণ ফলবান করে তুলতে সাধারণ মানুষের যোগদানের ক্ষেত্রটাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, নির্বাচিত পঞ্চায়েতকে প্রত্যাহার করার দাবিটাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এককথায় বলতে গেলে, পঞ্চায়েতকে কোনও দল বা ব্যক্তির আধিপত্য থেকে মুক্ত করা নয়, কাজটা হলো পঞ্চায়েতের ধারণাটিকে মুক্ত করা। বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে নিয়ে শুরু করে নানান উন্নয়ন সংস্থান ও বিশেষজ্ঞের কল্যাণে পঞ্চায়েতকে নামিয়ে আনা হয়েছে ঠিকাদারের ভূমিকায়। ধারণার লড়াইটা তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গণশত্রুরা ধারণায় দরিদ্র, এবং তারা অন্ধ, তাই তাদের লাঠি সম্বল। গণতন্ত্রীর সম্পদ অজস্র মানুষের সহভাগে গড়ে ওঠা ধারণা ও তার অনুশীলন। আজকের নৈরাজ্য ও অনাচারের পরিসমাপ্তি ঘটাতে গেলে স্ব-শাসনের ধারণাটি একদিকে যেমন পথ দেখাবার আলো তেমনি পথ পরিষ্কার করার আয়ুধ।
Comments :0