Post Editorial

পঞ্চায়েত আর পঞ্চায়েতের কাজ করে না গ্রামের জীবন ডুবেছে অনিশ্চয়তায়

উত্তর সম্পাদকীয়​

Post Editorial


 

ঈশিতা মুখার্জি

করমণ্ডল রেল দুর্ঘটনা আবার আমাদের সামনে বিষয়টি নিয়ে এল। বিষয়: গ্রামে বেকারি। গ্রামবাংলায় কাজ নেই। পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিকের উৎস। এখানের গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে সকলে হাঁটা দেয় দেশের যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও কাজে। কোভিডের সময়ে এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা চোখের সামনে ধরা দিয়েছিল। আর এই সেদিন রেল দুর্ঘটনায় প্রসঙ্গটি আবার উঠল। গ্রামবাংলায় কাজ নেই। কাজ নেই, গ্রামবাংলার মানুষ বেকার— এইটুকু বললেই পরিস্থিতি বোঝা যাবে না। গ্রামবাংলার মানুষের জীবন অনিশ্চিত। পরিবারের সকলে খুঁজে চলেছে কোথায় কাজ পাওয়া যায়। ২০১১ সালের পর থেকে নির্বাচিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণে গ্রামোন্নয়নের কাজ উলটোপথে হেঁটেছে। গ্রামে মানুষের জীবনে যে অনিশ্চয়তা ছিল এক সময়ে পঞ্চায়েত সেই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে তোলার অস্ত্র ছিল। ২০১১ সালের আগে গ্রামবাংলা থেকে পরিযায়ী শ্রমিকেরা কি অন্য রাজ্যে যাননি? তখনও পরিযায়ী শ্রমিকরা এ রাজ্যের কোনও কোনও অঞ্চল থেকে নির্দিষ্ট কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে যেত। কিন্তু আজকের মতো সম্পুর্ণ অনিশ্চয়তাকে ভর করে যেভাবে হোক ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র না গেলে বাঁচা যাবে না, বেঁচে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না— এই অবস্থা ছিল না। গ্রামে গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় সমষ্টি বা কমিউনিটির ধারণা ছিল। উন্নয়নের কাজ হতো এই সমষ্টি বা কমিউনিটিকে ভিত্তি করে। এর ফলে গ্রামীণ জীবনে অনিশ্চয়তা কম ছিল।

গ্রামবাংলায় কৃষির উপর নির্ভরশীল মানুষ ২০১১ সালের পর ক্রমাগত বেড়ে গেছে। কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা যত বেড়েছে, তত গ্রামের কৃষিকাজকেই আঁকড়ে ধরেছে মানুষ। গ্রামে যারা কৃষিকাজ করতেন, তাঁরা তো ছিলেনই; এর সাথে যুক্ত হলো যাঁরা শহরে গিয়েছিলেন কাজের খোঁজে এবং কাজ হারালেন। তাঁরা একে একে গ্রামে ফিরতে শুরু করলেন এবং জমির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। গ্রামে অধিকাংশ কৃষক ক্ষুদ্র ও মাঝারি জোতের। অর্থাৎ স্বল্প জমির উপর জীবিকার জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন আরও বেশি বেশি মানুষ। কোভিডের আগের পরিস্থিতি ছিল এইরকম যে কৃষির উপর নির্ভরশীল মানুষ বাড়লেও যে রাজ্যগুলিতে কৃষি থেকে আয় কমে আসছিল, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছিল অন্যতম। ২০১৮-১৯ সালেই, অর্থাৎ গতবারের রক্তাক্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে কৃষি থেকে আয় কমেছে দ্রুত গতিতে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী এমনিতেই ২০১২-১৯ ফসল উৎপাদনের থেকে প্রকৃত আয় প্রতি মাসে ১০১৭ টাকা থেকে কমে ৯৬৭ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। এর পর কোভিডের পরের পরিস্থিতি ফলে কীভাবে মানুষের আয় কমেছে আমরা জানি। পরিযায়ী শ্রমিকের একটা বড় অংশ কাজ না পেয়ে ফিরে এসে সেই জমির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কাজ নেই, চারপাশে শুধু কাজ হারানোর কথা। কিন্তু সরকারি তথ্য আবার জানাচ্ছে যে গ্রামীণ বেকারি পশ্চিমবঙ্গে কমেছে। এই তথ্য আমাদের বিভ্রান্ত করলেও এই তথ্যের পিছনে কারণ বোঝা কঠিন নয়। কাজ হারানোর ফলে খেতমজুরের সংখ্যা বেড়েছে ভীষণভাবে।

পুরুষ পরিযায়ী শ্রমিকেরা অনেকে কাজে ফিরে গেলেও মহিলারা বেশি নিযুক্ত হয়েছেন খেতমজুরির কাজে। কিন্তু মজুরি কমেছে। অনেক বেশি মানুষ স্বল্প জমিতে খেতমজুরিতে নিযুক্ত। কৃষক পরিবারগুলিও ক্ষুদ্র ও মাঝারি জোতের। রাজ্য সরকার কৃষক আত্মহত্যার তথ্য স্বীকার করে না। কিন্তু তথ্যের অধিকার আইনের সূত্রে পাওয়া তথ্য জানাচ্ছে ২০২১ সালে মাত্র একটি জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরে ১২২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। বেড়ে চলেছে কৃষক আত্মহত্যা।

পরিবারগুলি নিজেদের খাবার জোগাড় করতে ধার করছে। কার থেকে করছে ধার? কে দেবে ঋণ? পুরানো মহাজনেরা ফিরে এসেছে নয়া উদারীকরণের যুগে ক্ষুদ্র বেসরকারি ঋণসংস্থার রূপে। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কোনও ক্রমে মুখের গ্রাস জোগাড় করা। গ্রামে গ্রামে যে স্বনির্ভর গোষ্ঠী ছিল, সেই গোষ্ঠী ভেঙে ব্যক্তিকেন্দ্রিক উদ্যোগী বানানোর প্রক্রিয়া চালু করেছে সরকার। এর ফলে বেসরকারি ঋণদান সংস্থার ব্যক্তিকে চড়া সুদের হারে ঋণ দেওয়া সুবিধাজনক হয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার আজ ঋণগ্রস্ত। চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির পর এ রাজ্যে গ্রামে গ্রামে চলছে ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থার রাজ। এই সংস্থাগুলি সাধারণত মহিলাদের ঋণদান করে থাকে। তাই তাদের নজর থাকে মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির দিকে। প্রতি মাসে কিস্তিতে এই ঋণ তাদের শোধ করার কথা। যদি শোধ করতে না পারেন তাঁরা আবার অন্য একটি ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থা থেকে ঋণ করেন ঋণ শোধ করার জন্য। যারা ঋণশোধ করতে পারেন, কয়েক কিস্তির পরেই তাঁদের আরও ঋণদানের কথা শোনান ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থাগুলি। তাই ধীরে ধীরে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে পরিবারগুলি। এই জাল থেকে মুক্তি নেই। পরিবারের পুরুষেরা আবার ঘর ছাড়েন যদি কোথাও কোনও কাজ পান সেই খোঁজে। পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ অঞ্চলে মহিলাদের যে পরিমাণ ঋণ ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থাগুলি দিয়েছে, তা তাদের মোট ঋণের ৯৭%। এই তথ্য জানা যায় বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে। ঋণ নিয়ে এবং আর্থিক বিষয় নিয়ে বিশ্বে, দেশে যে পত্র পত্রিকাগুলি খবর লিখেছে, গত কয়েক বছরে তারা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে মহিলাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার রমরমার কথা লিখেছে। গ্রামে বেশির ভাগ পরিবার এই অনিশ্চয়তায় ভুগছে।


 

দারিদ্র গ্রাস করেছে গ্রামীণ পরিবারগুলিকে। নির্বাচিত পঞ্চায়েত এখন আর তাদের পাশে দাঁড়ায় না। পঞ্চায়েত থেকে জীবিকা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, পানীয় জলের সুযোগ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের খোঁজ— এর কোনোটাই আর পাওয়া যায় না। বয়স্ক শিক্ষা এবং সাক্ষরতার প্রচারের কাজ পঞ্চায়েত করে না। পঞ্চায়েত নিজস্ব অফিসে কাজও করে না সব ক্ষেত্রে। প্রশাসনিক ভবন থেকেই কাজ হয়। পঞ্চায়েতের সাথে গ্রামোন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে, বামফ্রন্টের নীতিতে যা অতীতের ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গে ছিল ; বর্তমান কেরালায় আছে। এই কারণেই বামবিরোধীরা পঞ্চায়েত নির্বাচন চায় না; নির্বাচন চাইলেও বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত চায়। বামফ্রন্ট সরকারের পঞ্চায়েতে গ্রামোন্নয়নে উপকৃত অংশদের মধ্যে ২০০৮ সালে দুই-তৃতীয়াংশই ছিল তফসিলি জাতি, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজন। শুধু ভূমিসংস্কার নয়, পঞ্চায়েতের কাজ ছিল সেচের সম্প্রসারণ, উন্নত বীজ, রাসায়নিক ও জৈব সারের ব্যবহারে কৃষকের পাশে দাঁড়ানো। গ্রামীণ দারিদ্র সহজে এই ব্যবস্থায় কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। গ্রামবাংলার মানুষের অনিশ্চিত জীবনে সুরাহা এনেছিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যার মাধ্যমে মানুষ তার ‘অনুভূত প্রয়োজন’ প্রকাশ্যে বলতে পারত। এই গ্রামে স্কুল চাই, সেচের খাল চাই, ব্রিজ চাই, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এইরকম ব্যবস্থা চাই ইত্যাদি। অনেক সময় দেখা গিয়েছিল মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না; পথ বেরোতে মানুষের সাথে আলোচনার মাধ্যমেই।

এই মডেল মানুষের পঞ্চায়েতের মডেল। তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র পঞ্চায়েত মডেলে ত্রিস্তরের বিশেষ প্রয়োজন নেই; ব্লক এবং মহকুমা প্রশাসনিক ভবন থেকেই রাজ্যের নির্দেশে কাজ চলে। পঞ্চায়েতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও সেই অর্থে কাজ থাকে না তারা শাসকদলের হলেও। মানুষের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামোন্নয়ন হলে তা মানুষের উন্নয়নে কাজে লাগে, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপি পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বলতে যে উন্নয়ন বোঝে তা হলো গ্রামকে ভিত্তি করে যতটা সম্ভব বেসরকারি কর্পোরেটের মুনাফা বাড়ানো আর গ্রামের সম্পদ লুট করা।

পঞ্চায়েত ঘিরে দুর্নীতি এবং অপরাধের মাত্রা আকাশছোঁয়া। পঞ্চায়েত এখন আর পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে শিশু শিক্ষা আর মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালায় না। পিছিয়ে পড়া গ্রাম আর চিহ্নিতকরণের কাজ পঞ্চায়েত করে না। পঞ্চায়েত এখন আর রাজস্ব সংগ্রহ করে না। জাতীয় ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোর অপরাধের তথ্য দেখলে বোঝা যায় কতগুলি অঞ্চল কীভাবে অপরাধ প্রবণতায় এগিয়ে গেছে। আমরা ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে হিংসা দেখেছি। যদি ২০১৬ এবং ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে অপরাধের খতিয়ান দেখি তাহলে একই চিত্র চোখে পড়ে। বিশেষ করে অপরাধের চিত্রে উঠে আসে দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর— এই সব জেলাগুলিতে। ইদানীং কালে আবাস যোজনার দুর্নীতি, মিড ডে মিলে দুর্নীতি, সহ নানা অত্যাচারে গ্রামবাংলার মানুষের জীবন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। এই অনিশ্চিত জীবনযাত্রা বর্তমান ধারার পঞ্চায়েতের ফল এবং দেশের আর্থিক বিপর্যয়ের ফল। যদিও  প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিচ্ছেন যে আমাদের দেশের অর্থনীতি সারা পৃথিবীতে এগিয়ে যাবে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এই এগিয়ে যাওয়ার কোনও ছাপ নেই। একইরকমভাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন যে দেশের অন্য রাজ্যের চেয়ে আমাদের রাজ্য এগিয়ে, কিন্তু গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা দেখে এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় না। গত কয়েক বছরে গ্রামে কিশোরদের স্কুলছুট হওয়া এবং কিশোরী মেয়েদের বিয়ে ভীষণভাবে চোখে পড়ে। পরিবারের জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা এই তথ্য থেকে বেরিয়ে আসে।


 

মানুষের জীবন যাপন যত অনিশ্চিত হয়েছে, দুর্নীতি তত রমরমিয়ে বেড়েছে। ভয় ত্রাস জুড়ে রয়েছে মানুষের জীবনে। দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গ্রাম। গ্রামের সম্পদ লুট হচ্ছে, লুট হচ্ছে প্রকল্পের অর্থ। মানুষের দ্বারা স্বশাসিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে উঠলে এই লুটেরা দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াতে পারে না। গ্রাম ছাড়ছে পরিযায়ীরা। কিন্তু তাদের পরিবার, আত্মীয় বন্ধুরা যারা গ্রামে রয়ে গেছেন, যে পরিযায়ীরা বাইরে থেকে ফিরে এসেছেন কিন্তু এখনও গ্রামে আছেন কাজের খোঁজ পাননি বলে, তাঁরা বাঁচবেন কী করে? ২০২৩ সালের পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত নির্বাচন এই দীর্ঘ অনিশ্চয় জীবন থেকে মুক্তি চাইছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তো মানুষের; তার সাথে বাস্তুঘুঘু দুষ্কৃতীর স্বাভাবিক শত্রুতা। লড়াইটা আসলে শ্রেণিসংগ্রামের; অতীতের সমস্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের এটি প্রকৃত সত্য। এই সত্যকে স্বীকার করে একমাত্র বামপন্থীরা। তাই বামপন্থীদের আদর্শই গ্রামবাংলাকে অতীতের মতো এবারেও বিকল্পের খোঁজ দিচ্ছে— তা হলো মানুষের পঞ্চায়েতকে প্রতিষ্ঠা করা।


 

Comments :0

Login to leave a comment