Post Editorial on Citizen Nagar

সিটিজেন নগরের দিনরাতই আজকের ভারত

উত্তর সম্পাদকীয়​

মহানগরের সমস্ত নাগরিক আবর্জনা এসে যেখানটায় জমে, সরকার বা পৌরনিগমের সরবরাহ করা যাবতীয় নাগরিক সুবিধে বা স্বাচ্ছন্দ্য যত অবধি এসে ফুরিয়ে যায়- নগরের সেই প্রান্তেই গড়ে উঠেছে বা বলা ভালো গজিয়ে উঠেছে আর একটা শহর! তার বাহারি নামখানা যেন আমেদাবাদ শহরের সমস্ত ব্যসন-ভূষণ, দেমাক আর জমককেই নিষ্ঠুর ঠাট্টা করে— সিটিজেন নগর। কারা থাকেন সেই ‘নগরে’? ঐতিহাসিক অভিজাত, ঐতিহ্যশালী, প্রাচীন মহানগরের ছুঁড়ে ফেলা, ডাঁই করে রাখা জঞ্জালের স্তূপ থেকে উঠে আসা তীব্র দূষণ আর দুর্গন্ধ, প্রতিদিনের শ্বাস-প্রশ্বাসে জড়িয়ে নিয়ে কাদের ঘর-গেরস্থালি চলছে আমেদাবাদের ধাপার মাঠে? আসলে নগরপালিকার ময়লা ফেলা গাড়ি যেমন শহরের রোজকার বাড়তি বর্জ্যগুলো সিটিজেন নগরের গা-ঘেঁষা মাঠটায় ঢেলে দিয়ে যায়, অনেকটা সেভাবেই যেন এই শহর, এই গুজরাট রাজ্য আর ভারত নামক মহান দেশের সরকার ও প্রশাসন একদা এই মানুষগুলোকেও বাড়তি আর বর্জনীয় ধরে নিয়েই তাঁদের পুরোদস্তুর নিকেশ করতে চেয়েছিল যাকে বলে ‘এথনিক ক্লিনজিং’। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা আর হিংসার সেই রাজনৈতিক ‘প্রোগ্রাম’ তলোয়ার-ত্রিশূল হাতবোমা, অ্যাসিড আর পেট্রোলের ‍‌জারিকেন নিয়ে তাদের মহল্লায় ঝাঁপিয়েছিল। নারী-শিশু-বৃদ্ধ-যুবক নির্বিশেষে হত্যালীলা চালিয়েছিল। হিন্দুত্বের গর্বিত বীর তরোয়াল, অন্তঃসত্ত্বার পেট চিরে, পবিত্র ত্রিশূলের ডগায় বিধর্মী ম্লেচ্ছ ভ্রুণটাকে গেঁথে নিয়ে, নৃত্য-উল্লাসে সনাতন ধর্মের কর্তব্য পালন করেছিল।
আজ্ঞে হ্যাঁ। এই মুহূর্তে যাঁরা সিটিজেন নগরে জঞ্জাল আর দুর্গন্ধের সঙ্গে সহবাস করছেন, ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবধি তাঁরা আমেদাবাদের উপকণ্ঠে নারোদা পাটিয়া এলাকায় নিজেদের বাড়িতে সুখে-দুঃখে, কষ্টে-আনন্দে, নিজেদের জীবনযাপন করতেন একান্ত নিজেদের মতো করেই। দু’দশক আগে ফেব্রুয়ারির ওই দিনটায় রাজ্যজোড়া এক সংগঠিত, সুপরিকল্পিত গণহত্যাকাণ্ডের অঙ্গ হি‍‌সাবেই তাঁদের সেই নিজস্ব ভুবনটা তছনছ করে দেওয়া হয়ে‌ছিল। গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা বজরঙ-বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সশস্ত্র বাহিনীর তাণ্ডব তাঁরা চোখের সামনে দেখেছেন। নারী-শিশু মিলিয়ে ৯৭জন মানুষের হত্যা তাঁদের চোখের সামনেই ঘটেছে। চোখের সামনেই তাঁরা নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই, ঘর-সংসারের শেষ সম্বলটুকু পেট্রোল বোমা আর ডিজেলের আগুন গ্যাসে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যেতে দেখেছেন। নারোদা পাটিয়া থে‍‌কে সেই যে তাদের বাস উঠল, আর তো ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গুজরাট সরকার বা আমেদাবাদের পৌরসভা নয়, কেরালার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই ঘরছাড়াদের পাশে সেদিন না দাঁড়ালে, আজ‍‌ তাঁদের মাথার ওপর ছাদটুকুও থাকতো না। সিটিজেন নগর তাই শুধু নারোদা পাটিয়ার উদ্বাস্তু মানুষের শেষ আশ্রয়টুকুই নয়— ধর্মের নামে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘অধিকার ও মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠার নামে, এই দেশের বাসিন্দা একটি মানবগোষ্ঠীর ওপর যে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয়েছিল, এই জনবসতির মগ্ন চৈতন্য সেই ক্ষত রক্তের চিহ্নও বহন করে! শুধু বহনই করে না। আজকের শাসক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক সহযোগিতায় যে জঘন্য অন্যায়ের বৃত্তান্তকে আধুনিক ভারতের ইতিহাস থেকে বেমালুম মুছে দিতে চাইছে, সিটিজেন নগরের যৌথ স্মৃতি, সেটার বিরুদ্ধেও একটা মরিয়া প্রতিরোধ, শেষ ব্যারিকেড।
সেই সব স্মৃতির টুকরো টাকরা ছুঁয়ে দেখাতে, অস্থায়ী বস্তিতে তাঁদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ের আঁচ পেতেই, তাঁর ছোট্ট ইউনিটটা নিয়ে কলকাতা থেকে সিটিজেন নগরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তথ্যচিত্রকার দেবলীনা মজুমদার। ২০১৮ সালে দেবলীনা যখন প্রথমবার ওখানে যান, ৫ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারেননি। আর ওই দূষণ দুর্গন্ধকে সঙ্গে করেই সেলিমভাইদের এই নগরবাস হয়ে গেল দু’দশক। আমেদাবাদ পৌরসভা যে বসতির বৈধতাই স্বীকার করে না— যেখানেকার বাসিন্দাদের কোনোরকম সরকারি পরিষেবাও জোটে না— বরং যে কোনো সময় উচ্ছেদের নোটিস হাতে পাওয়ার আশঙ্কায় প্রত্যেকটা দিন কাটাতে হয়— সেখানে দু’দশক পেরিয়ে যাওয়া গণহত্যালীলার দুঃস্বপ্ন কতটুকু আর তাড়া করে? কাঁচা রক্ত, পোড়া মাংস আর পেট্রোলের গন্ধ এখনো কি নাকে আসে? প্রতিবেশী পরিজনদের বিকৃত-নিহত মুখগুলোর ছবি রোজ আরও একটু ফিকে হয়ে যায়?
তথ্যচিত্রের সুবাদে এই উদ্বাস্তু মানুষদের সঙ্গে সংযোগ ও দীর্ঘ কথোপকথনের অভিজ্ঞতায় দেবলীনার উপলব্ধিটা অবশ্য একটু অন্য রকম। তাঁর ম‍‌নে হয়েছে, এই এতগুলো বছর ধরে, পুলিশ প্রশাসন নানা কিসিমের তদন্ত কমিশন— সরকারি বা অসরকারি সত্যন্বেষী দল দেশি বা বি‍‌দেশি নিরপেক্ষ গবেষক অথবা তথাকথিত ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দু’পক্ষের আইনজীবী এবং সবার ওপরে মহামান্য আদালত সবার সামনে সেই অভিশপ্ত ২৮ ফেব্রুয়ারির নির্মম নৃশংস ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে ‍দিতে নারোদা পাটিয়ার বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর গলায় কোথাও যেন একটা নির্লিপ্ত অবসাদ জমেছে। সেই দিনটা বা তার আগে পরের দিনগুলোর কথা ওঁরা ভোলেননি। হিংসা-হামলার চরিত্র হামলাকারীদের মুখ তাদের মনে আছে। মনে আছে স্থানীয় থানার পুলিশদের সেই বয়ানও ‘‘উপর সে অর্ডার আয়া কে আজ তুমহারা জান বচানেকে নহি হ্যায়’’! পুলিশকর্মীরা ওপরতলার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। সকাল ৯টায় আক্রমণ শুরু হলেও পুলিশ এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যায়। ততক্ষণে বজরঙ্গী অ্যাকশন প্রায় সারা! নারোদা পাটিয়ার তথাকথিত ‘মিনি পাকিস্তান’-কে জ্বালিয়ে পুড়ি‌য়ে গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া গেছে। ‘মিয়াভাইদের’ উচিত শিক্ষা দেওয়ার আর যেটুকু বাকি ছিল, উর্দিধারী জাতীয়তাবাদী পুলিশের উপস্থিতি, প্রহরা, প্রশ্রয়, প্রেরণা এমন কী প্রত্যক্ষ সাহচর্যে সেই কাজটাও যথাযথ সমাধা হয়।
২০২২ সালে দেবলীনা যখন শেষবার সিটিজেন নগরে গিয়েছিলেন, নারোদা নাম নিয়ে বিশেষ আদালতের এই আশ্চর্য রায় তখনও বছরখানেক দেরি। কিন্তু ওই সর্বস্ব হারানো মানুষরা ততদিনে অনেকবার বিচারের বাণীকে নীরবে-নিভৃতে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখেছেন। সেই চোখে কোনও জল না। ছিল শুধু একরাশ শূন্যতা আর হতাশা। এই মানুষগুলো তো গত দু’দশক ধরে দেখেছেন, কীভাবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় গুজরাট গণহত্যার পুরো ন্যারেটিভটাই ক্রমশ পালটে ফেলা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সংখ্যালঘুদের জীবন-জীবিকা-আশ্রয়ের ওপর যেমন নিখুঁত পরিকল্পনায় আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছিল, আক্রমণের চিহ্নগুলো মুছে ফেলার ক্ষেত্রেও সেরকমই একটা পরিকল্পিত ছক দেখা যাচ্ছে। প্রথমে তৎকালীন গুজরাট সরকার তথা সেই সরকারের মাথাদের ওই মৃত্যু-উৎসবের সমস্ত দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। প্রমাণ হয়ে গেল সরকারের তরফে কোথাও কোনও ‘ষড়যন্ত্র’ ছিল না। বরং গোধরা কাণ্ডের ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া’য় যখন কিছু ঘটনা ঘটছিল, তখন রাজ্যের সরকার আর সেই সরকারের মুখ্য-মুখ নরেন্দ্র মোদী, তাঁর ডান হাত রাজ্যের তখনকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, মন্ত্রীসভায় তাঁদের অন্য সহকর্মীরা সব্বাই দিন-রাত এক করে প্রাণপণে ‘রাজধর্ম’-ই পালন করছিলেন! অন্তত পালনের চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের চেষ্টায় কোনও খামতি ছিল না। তাই প্রথমে বিশেষ তদন্তবাহিনী বা ‘সিট’ তাঁদের ‘ক্লিনচিট’ দিল। তারপরেও মামলার জল অনেক গড়িয়ে শীর্ষ আদালত, ‘মোদীজীর কাপড় ধোপদুরস্তই’ রেখে দিলেন। জানা গেল তাঁর বিরুদ্ধে সব সাক্ষ্য-প্রমাণই নাকি সাজানো-পড়ানো-বানানো! আদালত অভিযোগকারী (বা কারিনী)-দেরই বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নিদান দিলেন।
এটাই গুজরাট-গণহত্যা বিচারের দ্বিতীয় পর্ব, নারোদা পাটিয়ায় এহেন ‘রাজধর্ম’ পালনে ভয়ানক ব্যস্ত থাকার জন্যই পাশের নারোদা গম-এ তারা ‘সময়মত’ পৌঁছাতে পারেনি— পুলিশের তরফে এরকমই একটা অজুহাত দেওয়া হয়েছিল। নারোদা পাটিয়ার খুনিদের অনেকেই নারোদা গম-এর গণহত্যারও নেতৃত্ব দিয়েছিল। ১০০ জনেরও বেশি প্রত্যক্ষদর্শী সেই মায়া কোদনানি, বাবু বজরঙ্গীদের বিরুদ্ধে আদালতে বয়ানও দিয়েছিলেন। কিন্তু ১০০ সাক্ষ্য একদিকে আর সেলিব্রেটি সাক্ষী, খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বয়ানের ওজন আরেক দিকে। নারোদার হতভাগ্যরা চোখের সামনে দেখেছেন, বিধায়ক তথা রাজ্য মন্ত্রীসভার সদস্য মায়া সারাদিন ধরে কি নিপুণ পেশাদারি দক্ষতায় গোটা ‘অপারেশন’-টাকে নিখুঁত, কার্যকর, সফল করেন! অথচ অমিতজী তাকে সকালে মন্ত্রীসভার জরুরি বৈঠকে, সারাদিন বিধানসভার অধিবেশনে ব্যস্ত থাকতে দেখলেন! প্রসঙ্গত, বলা যায়, অমিত শাহজী তখন গুজরাটের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন। এবং খুব সম্প্রতি আমরা দেখলাম, বিশেষ আদালত মায়া কোদনানি সহ নারোদা গম গণহত্যা মামলার ৬৭ জন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস দিলেন ( বাকি ১৯ জন আগেই মুক্তি পেয়েছে)। মানে নারোদা গমে হত্যালীলা চলল— ১১ জন মুসলিম নারী-পুরুষ নিহত হলেন— কিন্তু খুনিদের সন্ধান পাওয়া গেল না! কিংবা হয়তো নারোদা গমের ঘটনাটা ঘটেইনি— কেউ কাউকে খুনও করেনি— সবটাই হয়তো মায়া বা ‘মায়ার খেলা’! অথবা ওই ১১টি মৃতদেহ বোধহয় নিজেরাই নিজেদের হত্যা করে, সেই দায় এইসব নির্দোষ নিরপরাধ, প্রোগ্রাম-এর ভাজা মাছটি উলটে খেতে না জানা, সনাতন ধর্মপ্রাণ বেচারাদের ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছিল! ধর্মাবতার খুব জোর বাঁচিয়ে নিয়েছেন।
সাক্ষ্য-প্রমাণকেই মিথ্যা প্রমাণ করা। যাঁরা সর্বস্ব খোয়ালেন, তাঁরা সত্যি বলছেন না! বা তথাকথিত ছদ্ম-সেকুলার বিরোধী রাজনৈতিক দল আর ‘ধান্দাবাজ’ অসরকারি বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগু‍‌লির শেখানো বুলি বলছেন! যে সব পুলিশ অফিসার বা পদস্থ আমলারা সরকারের গোপন অ্যাজেন্ডার পর্দা ফাঁস করেছিলেন, ‘প্রমাণ’ করে দেওয়া হলো, তাঁরা আসলে অকুস্থলে ছিলেনই না। আসলে তাঁরা ‘ভিলেন’— নিজেদের অন্য ‘অপরাধ’ গোপন করার জন্যই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শিবিরের ‘হিরো’ সাজার চেষ্টা করছিলেন! তাহলে পুরো গল্পটা কী দাঁড়ালো? সরকার ‘নিস্পাপ’ এবং নিরপেক্ষ। তথাকথিত ‘আক্রান্ত’রা হয় ‘প্রতিহিংসা ও আবেগের আতিশয্যে’ বিভ্রান্ত নয়তো বিপথেচালিত। আর যারা তাঁদের উসকানো, গণহত্যার নাম করে সরকার তথা গুজরাটি অস্মিতাকে বদনাম করল, তাদের সব্বারই রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত মতলব ছিল। তার মানে ষড়যন্ত্রেরই দায়টা মোটামুটি আক্রান্ত আর অভিযোগকারীদের ঘাড়েই ঠেলে দেওয়া গেল। বাকি ছিল ‘আহত’ হিন্দুদের সেই বাহুবলী বাহিনী, যারা ময়দানে নেমে খুন-জখম-ধর্ষণ-লুট-অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছে। ‘মিয়াদের’ উপযুক্ত ‘শিক্ষা’ দিয়েছে। পুলিশ এমনভাবে কেস সাজিয়েছিল যে এদের অনেকেই জামিন পেয়ে যায়। এবার তাদের বেকসুর খালাস দেওয়ার পালা চলছে। এমনকি দলবদ্ধ ধর্ষণের আসামীদের ‘সংস্কারি হিন্দু’ বলে শাস্তি মকুব হয়ে যাচ্ছে।
এভাবে চলতে চলতেই হয়তো একদিন প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে গুজরাট গণহত্যা বলে কিছু ঘটেইনি। মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরা যে গোধরা-কাণ্ড ঘটিয়েছিল, সনাতন ধর্মের তরফে তার ‘স্বতঃস্ফূর্ত, বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত’ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেটা এমন কিছু নয় যে মোদীজীকে ‘মওত্‌ কে সওদাগর’ বলা যায় বা অমিত শাহজীকে জেলে ভরা যায়। মোদীজী মহান— প্রায় শিবের অবতার— তাই এইসব কুকথা আজ মিথ্যে অভিযোগের ‘বিষ’ পান করে নীলকণ্ঠ হয়ে বসে আছেন। যারা সেই মহানুভবতাকে ‘অনুভব’ করতে পারে না, তারা তিস্তা শীতলবাদের মতো দেশদ্রোহী। তাই মহামান্য শীর্ষ আদালত তাদের উপযুক্ত শাস্তির বন্দোবস্ত করে। আসলে এই পুরো বিষয়টাই সঙ্ঘ পরিবারের একটা বৃহত্তর ‘গেম প্ল্যান’-এর অঙ্গ। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব যাকে ‘স্মৃতি ধ্বংসের প্রক্রিয়া’ বলেছেন। বদলে দাও — মুছে দাও — ভুলিয়ে দাও — খুব সংগঠিত উপায়ে এই প্রক্রিয়াটাই চলছে দেশজুড়ে। শহর-রাস্তা-সৌধের নাম থেকে ইতিহাসের পাঠক্রম বদল— সবটাই এক সুতোয় বাঁধা। গান্ধী হত্যার প্রসঙ্গে আরএসএস’র নাম বাদ যাওয়া আর গুজরাট গণহত্যার নায়ক-নায়িকাদের একের পর এক ছাড় পেয়ে যাওয়া— শেষ অবধি কিন্তু একটাই ন্যারেটিভ নির্মাণ করে। সেটা হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদ ও সঙ্ঘ পরিবারের হাতে কোনও রক্তের দাগ নেই। আগামী প্রজন্ম, স্কুল থেকে স্নাতকস্তর অবধি যে ইতিহাস পড়বে, সেখানে আর্যরাই সমসত্ব-অখণ্ড ভারত রাষ্ট্রের আদি বাসিন্দা। সেই পুণ্য নেশন-ভূমি (‘গণতন্ত্রের মাতা তখনই জাতিরাষ্ট্র’) থেকেই আমাদের আর্য-পূর্বজরা সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার উত্তরাধিকার নিয়ে দুনিয়াভর ছড়িয়ে পড়েছিল। আর্যদের সেই মহাভারতের কথা অমৃত সমান। সেখানে জাতিভেদ বর্ণভেদ কিস্যু ছিল না! চারদিকে থইথই করছে গণতন্ত্র। জাতিপ্রথা, বর্ণাশ্রম এসব এল মধ্য যুগে। বিদেশি বিধর্মী মুসলিমরা ভারতবর্ষ দখল করে, আমাদের সনাতন ধর্মের ওপর এসব চাপিয়ে দিল। যাতে হিন্দুরা দুর্বল হয়— আর ইসলাম তার ধর্মান্তকরণ চালিয়ে যেতে পারে।
এই নতুন ইতিহাসের পাঠক্রমে মুসলিমরা শুধুই বহিরাগত আক্রমণকারী শাসক হিসাবে চিহ্নিত হবেন। মন্দির ধ্বংস আর ধর্মান্তর ছাড়া ভারতের ইতিহাসে যাদের আর কোনও ভূমিকা থাকবে না। কারণ সাংস্কৃতিক সমন্বয় বা মুসলিম শাসকদের উদ্যোগে ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষা-সাহিত্যের বিকাশের ইতিহাস তো বাদ পড়ে যাবে। ওই সঙ্ঘ-সংশোধিত পাঠক্রমের প্রেক্ষিতেই, হিন্দুত্ববাদ-রচিত বা পুননির্মিত গণ-স্মৃতির পটভূমিতেই আজকের ভারতীয় মুসলিম সমাজের মূল্যায়ন হবে। এবং তাতে অবধারিতভাবেই মুসলিমরা সনাতন সভ্যতার মূলস্রোতের বাইরে ‘অপর’ ও ‘আপদ’ হিসাবেই গণ্য হবেন! আর ‘আপদ’ বা ‘জঞ্জাল’ মানেই তো বর্জনীয়— তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করাটাই বিধেয় বা কর্তব্য। ২০০২-র গুজরাটে সেই কাজটাই পরীক্ষামূলকভাবে করা হয়েছিল। সেই সাফাই কর্মের পরেও যে সংখ্যালঘু মানুষজন টিকে থাকলেন তারা তো বাড়তি বা বর্জ্যই। তাই সিটিজেন নগরে বর্জ্য ফেলার মাঠের পাশেই তারা পড়ে রয়েছেন। সেটাকেই অভ্যেস করেছেন। তাই দেবলীনার তথ্যচিত্রে ক্যামেরার মুখোমুখি নিজেদের ক্রোধ-কষ্ট-ক্ষোভ-কান্না উগরে দিতে গিয়েও তাদের গলায় কোথাও একটা রুটিন যান্ত্রিকতা ফুটে ওঠে। তারপরেও নগরের বাসিন্দা এক মহিলা আবেগহীন, শুকনো গলায় যখন বলে ওঠেন, সরকারের অবহেলা আর এই দুর্গন্ধ সইতে সইতে মাঝে মাঝে মনে হয়, দাঙ্গাবাজদের হাতেই আমাদের মরণ হলো না কেন— তখন কোথায় যেন একটা প্রবল বিচ্ছিন্নতার হাহাকার টের পাওয়া যায়! ভারতীয় যৌথ যাপনের সমস্ত স্মৃতি সত্তা সত্যের ইতিহাস মুছে গিয়ে এই ধূসর বিচ্ছিন্নতাই কী আমাদের ভবিষ্যৎ বাস্তব হতে চলেছে?
এই বিচ্ছিন্নতার বাস্তবকে বদলাতে গেলে ২০২৪-এর প্রগতি ও গণতন্ত্রের পক্ষের সব শক্তিকে একটা জায়গায় এসে দাঁড়াতেই হবে। 
 

Comments :0

Login to leave a comment