Post Editorial on Democracy

গণতন্ত্র হত্যার মৌলিক সূত্র

উত্তর সম্পাদকীয়​

দেবাশিস চক্রবর্তী 
আশি বছর আগে জিম করবেট দেখেছিলেন ‘ম্যান ইটার অব কুমায়ুন’। এবারের পঞ্চায়েত ভোটে বাংলার মানুষ দেখেছেন ‘ব্যালট ইটার অব বেঙ্গল’। 
তৃণমূলের যে প্রার্থী জেতার মরিয়া চেষ্টায় বিরোধীদের পক্ষে যাওয়া ব্যালট চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছেন তিনি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। ঘটনাটি বিচিত্র এবং দুষ্কর্মের প্রকৃতিতে হাস্যকর উপাদান থাকায় তিনি মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমে বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু ভেবে দেখলে পঞ্চায়েত ভোটকে ঘিরে উন্মত্ত হিংসার অভিযানের তুলনায় তাঁর অপরাধ অনেক লঘু। 
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, হিংসা তেমন কিছুই হয়নি। বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঘটনা মাত্র ঘটেছে। শুধু যে মৃত্যুর সংখ্যা তিনি কম করে হিসাব করেছেন তা নয়, এই ভোটকে তিনি একটি স্বাভাবিক ভোট বলে চিত্রায়িত করেছেন। অথচ দিন যত যাচ্ছে তত আরও স্পষ্ট সংবাদ আসছে কীভাবে ধাপে ধাপে এই নির্বাচনে জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন চলাকালীন চোখের সামনে যা দেখা গেছে, এখন বোঝা যাচ্ছে তার পিছনে পরিকল্পনা ছিল আরও ভয়াবহ। মনোনয়ন আটকাতে না পারলে প্রার্থী তোলানো, তা না পারলে বুথ দখল, তা-ও না পারলে ভুয়ো ব্যালট, সবকিছুর পরে গণনাকেন্দ্র ঘিরে রেখে লুট। ‘কারচুপি’ শব্দটি এখানে প্রযোজ্য না, কেননা কোনও গোপনীয়তার আশ্রয় নেওয়া হয়নি। প্রকাশ্যে লুট হয়েছে মানুষের দেওয়া রায়। 
গণনা হয়েছে ১১ জুলাই। ২২ জুলাই পর্যন্ত রাজ্যের নর্দমায়, পুকুরে, মাঠে, আবর্জনার স্তূপে ব্যালট পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের পেটের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। চলতেই থাকবে। এত হাজার হাজার ব্যালট ফেলে দেওয়া হয়েছে যে পুড়িয়েও শেষ করা যাবে না। সিল করা ব্যালট বাক্স পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে, যা গোনাই হয়নি। অথচ ফল বেরিয়ে গেছে। কে জিতেছে তা-ও এখনও পর্যন্ত ঠিক করে উঠতে পারেনি রাজ্য নির্বাচন কমিশন। লজ্জা ঢাকার ন্যূনতম আশ্রয় নেওয়া হয়নি কেননা লজ্জা বোধ বিদায় নিয়েছে শাসকদের। 
লক্ষ্য করার বিষয়, এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দেখা গেছে শাসক দল ও প্রশাসনের যৌথ আক্রমণ। পুলিশই শুধু দুষ্কৃতীদের সঙ্গী হয়েছে, তা নয়। একাংশের প্রশাসনিক আধিকারিকরা ক্রমাগত বেনিয়ম এবং অন্যায় কাজ করে গেছেন। ‘ওপরতলার’ নির্দেশ মানতে গিয়ে সংবিধানের নিয়ম অস্বীকার করা হয়েছে। গণনাকেন্দ্রে লুটের পদ্ধতি দেখে এখন যে কেউ বুঝছেন তা এক বড় পরিকল্পনার অংশ। একই কায়দায়, একই সময়ে তা করা হয়েছে। পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে তৃণমূলের বাহিনী যখন এই কাজ করছে তখন নির্দিষ্ট আধিকারিকরা তাদের সাহায্য করেছেন। যে সামান্য কয়েকটি মামলা এখনও পর্যন্ত হয়েছে তাতে ডাক পেয়েছেন বিডিও’রা। আদালতে দাঁড়িয়ে সঙ্গত প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারছেন না। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন লুট হয়েছিল। গণনাও বিকৃত করা হয়েছে। এমন দৃশ্য অতীতে কোনও নির্বাচনে কেউ দেখেননি। বিডিওরাই কেবলমাত্র জড়িত ছিলেন না, পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের আধিকারিকরা তৃণমূলকে জেতাতে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন। এমন ভাবা কষ্টকল্পনা হবে না যে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের আধিকারিকদের কেউ কেউ ভোট লুটের এই পরিকল্পনায় কার্যত নেতৃত্ব দিয়েছেন। 
গ্রামের মানুষের বিরুদ্ধে এমন মরিয়া যুদ্ধে তৃণমূল নামলো কেন? তৃণমূলের রাজনীতির মৌলিক প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত। কমিউনিস্ট-বিরোধিতার রাজনীতি ছাড়া তৃণমূলের অন্য কোনও কোনও উপাদান ছিল না। এখন দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পরে সম্পদ আত্মসাৎ করা ছাড়া তৃণমূলের অন্য কোনও লক্ষ্য নেই। যেখান থেকে সম্ভব সেখান থেকেই সম্পদ আত্মসাৎ করার সহজ পদ্ধতিতে তারা চলছে। এর ফলেই দুর্নীতি সার্বজনীন চেহারা নিয়েছে। পঞ্চায়েতে যে টাকা আসছে বা গ্রামের প্রকল্পের জন্য যে টাকা আসছে তা খেয়ে নিচ্ছে তৃণমূলের নেতারা। ছিটেফোঁটা যা পড়ে থাকছে, তা বিলি করা হচ্ছে। যত সময় গেছে দুর্নীতির পরিমাণ এত বেড়ে গেছে যে বিলি করার মতোও আর টাকা থাকছে না। শাসক দলের পেটে ঢুকে গেছে গ্রামের লোকের প্রাপ্য অর্থ, বরাদ্দ, সম্পদ সবই। এর ফলে গ্রামে একদল নব্য ধনী তৈরি হয়েছেন। এদের যারা চালাচ্ছেন তারা আরও বড় ধনী। পঞ্চায়েতের টাকা খেয়ে বগটুইয়ের আনারুলের যদি প্রাসাদ বাড়ি হয়, তাহলে এদের চালানো অনুব্রতের কোটি কোটি টাকা। আবার, অনুব্রতদের যারা চালাচ্ছেন তাদের লন্ডন, থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কে টাকা। 
এই সম্পদ আত্মসাতের জন্য নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োজন। যেখানে কোনও প্রশ্ন, দায়বদ্ধতার অবকাশ থাকবে না। সেই লক্ষ্যেই ব্যক্তি তৃণমূলের নেতারা এবং দল হিসাবে তৃণমূল ক্ষমতার জন্য মরিয়া। গণতন্ত্রে এই ঝুঁকি থেকেই যায় যে কোনও দল কোথাও হেরে গেল। তৃণমূলের গতিসূত্রই এমন যে হেরে গেলে চলবে না। রাজ্যের ক্ষমতা থেকে তৃণমূল একবার সরে গেলেই দল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সুতরাং গণতন্ত্রকে হত্যা না করে তৃণমূলের কোনও উপায় নেই। আসলে আমরা যাদের দেখছি তারা ‘ডেমোক্র্যাসি ইটার্স অব বেঙ্গল’। 
২. 
তৃণমূলের একটি বড় সুবিধা হয়েছে ২০১৪ থেকে। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার তৈরি হওয়ার পরে দেশের রাজনীতিতে এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কর্মসূচি একের পর এক বাস্তবায়ন করা শুরু হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে আক্রমণ করা হয়েছে, বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকেই সমাজে মূল্যহীন করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এই প্রয়াসের অংশ হিসাবেই মেরুকরণ তীব্রতর করা হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর এই মৌলিক স্তম্ভটিকে দুর্বল করে তোলায় ভারতীয় সমাজ অস্থিরতার, অনিশ্চয়তার নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। সংসদ ক্রমশ নখদন্তহীন হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের দায়বদ্ধতার নীতি বিসর্জিত হয়েছে। রাফালে, পেগাসাস থেকে মণিপুর-কোনও প্রশ্নেই সরকার এখন সংসদে আলোচনার অনুমতি দিচ্ছে না। গণতান্ত্রিক রীতি পদ্ধতি মান্য করা হবে কিনা, তা সরকার নির্ধারণ করছে। 
গত ৯ বছরে লুটেরা পুঁজির রমরমা বহুগুণ বেড়েছে। সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটছে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া কারবারীদের হাতে। আদানিদের অস্বাভাবিক সম্পদবৃদ্ধির পিছনে একদিকে সরকারের সরাসরি মদত, অন্যদিকে বেনিয়মের ঘটনা সামনে চলে এসেছে। একটু-আধটু বেনিয়ম নয়, শিখণ্ডি সংস্থা খাড়া করে মূলধনী বাজারে অবাধে জালিয়াতি চলেছে। আবার, এই আদানিদের হাতেই থালায় সাজিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে বন্দর, বিমানবন্দর, কয়লাখনি, শক্তিক্ষেত্র, কৃষি বাণিজ্য। শুধু একটি গোষ্ঠীই নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেবার তালিকা দীর্ঘ হয়েছে এবং তা কর্পোরেটেরই। সম্পদ আত্মসাতের এক বিপুল প্রক্রিয়া চলছে। গণতন্ত্রকে সজীব রেখে যেহেতু তা করা কঠিন, তাই গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক শাসন চাপিয়ে দেবার প্রক্রিয়া চলমান। 
দেশে যদি এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার হয়, যদি অর্থনীতি এভাবে ক্রমে লুটেরা পুঁজির দখলে চলে যায় তাহলে সেই বাতাবরণে তৃণমূলের মতো দলের সম্পদ আত্মসাৎ, এবং সেই লক্ষ্যে গণতন্ত্রের ওপরে নিরন্তর আক্রমণের সুবিধা হয়। পশ্চিমবঙ্গে ঠিক তাই হচ্ছে। উপরিভাগের রাজনীতির ক্ষণস্থায়ী দ্বৈরথে মৌলিক রাজনীতির এই সূত্রবন্ধন আড়াল হতে পারে না। 
৩. 
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার অভিযান কিন্তু এবারের নির্বাচনের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। দেখা গেছে, গ্রামের মানুষ এই আক্রমণ প্রতিহত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। মনোনয়ন দেওয়া থেকে গণনা পর্যন্ত অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে। কিন্তু সহজে শাসক দলকে রাস্তা ছেড়ে দেননি তাঁরা। বাংলার অসংখ্য গ্রাম হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের ময়দান। 
আরো লক্ষণীয়, এই লড়াইয়ে সামনের সারিতে ছিলেন গ্রামের গরিব, খেটে খাওয়া অংশের মানুষ। ছোট কৃষক, খেতমজুর, গ্রামের অন্যান্য অংশের শ্রমজীবী, পরিযায়ী শ্রমিক যাঁরা ঘরে ফিরেছিলেন তাঁরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে এই লড়াই করেছেন। এই লড়াইয়ে তফসিলি জাতি, আদিবাসী, সংখ্যালঘু অংশের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল দেখার মতো। তরুণরা দলে দলে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। মহিলারা শুধু শামিলই হননি, বহু ক্ষেত্রে তাঁরাই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বামপন্থী দলগুলি ও তাদের সহযোগীদের সংগঠিত প্রয়াস ছাড়াও শাসকের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ প্রতিফলিত হয়েছে। যে ক্ষোভ নির্বাচনের পরে কমার বদলে বেড়ে গেছে। তৃণমূল যে গণতন্ত্র লুট করেছে, তা মানুষকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। 
রাজ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হবে। রাজ্যের স্বৈরাচারী শাসক যথাসাধ্য চেষ্টা করবে ভয়ের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে। নতুন নতুন কৌশল নেবে। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনে ইঙ্গিত মিলেছে, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তিও ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। জনগণের দাবিদাওয়ার আন্দোলন এই লড়াইকে আরও সংহত রূপ দিতে পারবে। শ্রেণি ও গণআন্দোলন নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত করতে পারলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামও শক্তিশালী হবে। এই সংগ্রামকে দেশব্যাপী গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ের অংশ হিসাবেই দেখা সমীচীন। 
এই লড়াইয়ের প্রয়োজনেই শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন অংশের সংগঠনকে আরও মজবুত করা প্রয়োজন। সাংগঠনিকভাবে সংহত করতে পারলে মানুষের শক্তি বহুগুণ বেড়ে যায়। এই কাজ অবশ্যই কঠিন। কিন্তু গণআন্দোলনের কর্মীরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করছেন এর সম্ভাবনা প্রসারিত হয়েছে।

Comments :0

Login to leave a comment