Post editorial on panchayet election

কোন পথে পশ্চিবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা

উত্তর সম্পাদকীয়​

অসীম দাশগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনটি বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে: বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কীভাবে গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষদের যুক্ত করে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। তৃণমূল সরকারের আম‍‌লে কীভাবে সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে এবং বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের করণীয় কাজ কী।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা
আমরা মনে রাখি ১৯৭৭ সালের ২১ জুন প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। শপথ গ্রহণ করার পরেই ঘোষণা করেছিলেন, বামফ্রন্ট সরকার শুধুমাত্র মহাকরণ থেকে সরকার পরিচালনা করবে না। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান হবে শহর ও গ্রামের নির্বাচিত সরকার (অর্থাৎ শহরাঞ্চলে নির্বাচিত পৌরসভা এবং গ্রামাঞ্চলে নির্বাচিত পঞ্চায়েত)। এই আলোচনায় আমরা গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে এলাকার মানুষদের যুক্ত করে উন্নয়নের উদ্যোগের কথাই সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করবো।
জ্যোতি বসুর শপথ গ্রহণের দিনের ভাষণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে (সেচের সম্প্রসারণ, রাস্তার উন্নয়ন, পানীয় জলের ব্যবস্থা ইত্যাদিতে) এলাকার সাধারণ মানুষদের সরাসরি যুক্ত করার লক্ষ্যে এক বছরের মধ্যেই (৪ জুন, ১৯৭৮), রাজ্যের প্রথম ত্রি-স্তর পঞ্চায়েতে ( জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতে) অনুষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন। নির্বাচনের পরে সমীক্ষা করা হয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শ্রেণি চরিত্রের ওপর। দেখা যায় যে নির্বাচিতদের মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগই এসেছেন কৃষক, ভূমিহীন খেতমজুর, বর্গাদার, কারিগর, শিক্ষক ও অন্যান্যদের মধ্যে থেকে। এবং এই কৃষকদের মধ্যে শতকরা ৭২ ভাগই হলেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, অর্থাৎ সংখ্যাধিক্যে গ্রামের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষরাই হলেন পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি। তাই এই পঞ্চায়েতগুলির মাধ্যমেই এলাকার দরিদ্র কৃষকদের যুক্ত করে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ভূমি সংস্কারকে ভিত্তি করে সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই বিকল্প পথে গ্রামোন্নয়নের পরিকল্পনা রচনা ও রূপায়ণ এবং এই বিকল্প পথের মূল লক্ষ্য হিসাবে স্থির করা হয় গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়বৃদ্ধি।
যেহেতু কৃষিতে, খামার পরিচালনার তথ্যের ভিত্তিতে বিঘা প্রতি ফসল উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের সর্বোচ্চ নজির বারংবার পাওয়া যায়, বৃহৎ কৃষকদের নয়, প্রান্তিক কৃষকদের জমি থেকেই, তাই ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে কৃষি জমির পুনর্বণ্টনই হলো কৃষিতে বামফ্রন্ট সরকারের বিকল্প নীতির মূল ভিত্তি। এর ফলে, ভারত সরকারের জাতীয় নমুনার তথ্য অনুযায়ী (২০০৩) যেখানে সমগ্র দেশের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের (যাঁরা গ্রামাঞ্চলে কৃষি সংশ্লিষ্ট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ) হাতে আছে মোট কৃষি জমির মাত্র ৪৩ শতাংশ, সেখানে ভূ‍‌মি সংস্কারের ফলে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের হাতে জমির মালিকানা হয়েছে মোট কৃষিজমির প্রায় ৮৪ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ রাজ্যে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন (১৫ জানুয়ারি, ২০১১ পর্যন্ত) প্রায় ৩০.৫ লক্ষ পরিবার এবং এঁদের মধ্যে তফসিলি জাতি, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষই উপকৃত হয়েছেন ৬৬ শতাংশ।
সাধারণ কৃষকদের কর্মসংস্থান এবং তাঁদের জমিতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভূমিসংস্কারের পাশাপাশি সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং উন্নত বীজ ও সারের ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব প্রদান করা হয় ধারাবাহিকভাবেই। উদাহরণ হিসাবে সেচ ব্যবস্থায় বৃহৎ সেচের সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিশেষ অগ্রাধিকার আরোপ করা হয় ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পগুলির ওপর। এর সামগ্রিক ফল হিসাবে রাজ্যে সেচযুক্ত জমির অনুপাত ১৯৭৭-৭৮ সালে ৩২ শতাংশ থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০-১১ সালে ৭২ শতাংশকে অতিক্রম করে। সেচ ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামোর অন্যান্য (রাস্তা ইত্যাদি) নির্মাণের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে যুক্ত করে এলাকার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যেখানেই ঠিকাদারদের পরিবর্তে এলাকার সাধারণ মানুষদের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে, সেখানেই অপেক্ষাকৃত কম খরচে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে শুধু স্থানীয়ভাবে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তাই নয়, যে অর্থের সাশ্রয় হয়েছে তাতে বাড়তি কাজও করা সম্ভব হয়েছে। এবং সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষের স্বার্থে মোট উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান বর্ধিত হয়েছে এবং মজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে বিকল্প নীতির লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
ভূমিসংস্কার এবং কৃষি সমেত গ্রামোন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করে পরিকল্পনা রচনা ও রূপায়ণের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে পর্যায়ক্রমে আরও সম্প্রসারিত করা হয়। এর পাশাপাশি পঞ্চায়েতের মাধ্যমে রূপায়িত প্রকল্পগুলির সঙ্গে যাতে জেলাতে গ্রামাঞ্চলে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে রূপায়িত প্রকল্পগুলির মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকে, তার জন্য ১৯৮৫-৮৬ সালে সমগ্র দেশে সর্বপ্রথম জেলাস্তরে জেলা পরিকল্পনা গঠিত হয় এরাজ্যেই, যাতে এই কমিটিগুলিতে একই সঙ্গে নির্বাচিত পঞ্চায়েত এবং জেলা ও ব্লকস্তরে বিভিন্ন দপ্তরের আধিকারিক ও বাস্তুকারদের আলোচনার মাধ্যমে প্রতিটি স্তরে যথাযথভাবে প্রকল্পগুলি রূপায়িত করা সম্ভব হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৮৯ সালে কলকাতার পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্যগুলির পঞ্চায়েতীরাজ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের তরফ থেকে গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে মেদিনীপুরের কেশিয়ারী থেকে জবা হাঁসদা, জেলাস্তরের ক্ষেত্রে সূর্য মিশ্র এবং রাজ্যস্তর থেকে আমাদেরও বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়। সমস্ত আলোচনার শেষে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগকে প্রশংসা করে তাকে সমগ্র দেশের মডেল হিসাবেই চিহ্নিত করেন। এই ধারণাকে সামনে রেখেই পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংশোধন (৭৩তম সং‍‌শোধন) করা সম্ভব হয়।
আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পরবর্তী পর্যায়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াকে শুধু গ্রামপঞ্চায়েত স্তর নয়, প্রতি গ্রামের ক্ষেত্রে গ্রাম সংসদস্তর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয় এবং প্রতিটি স্তরে বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের যুক্ত করা হয় উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করে, যা সমগ্র দেশে আর কোথাও হয়নি। উল্লেখ করা অপ্রসঙ্গিক নয় যে, ভারত সরকারের পঞ্চায়েতী রাজ মন্ত্রকের তরফ থেকে রাজ্যগুলির পর্যালোচনার (২০০৯-১০) প্রকাশিত ফল অনুযায়ী পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের নিরিখে সমগ্র দেশের মধ্যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই পশ্চিমবঙ্গ অর্জন করে প্রথম স্থানাধিকার হওয়ার সম্মান।

তৃণমূল সরকারের আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং করণীয় কাজ
বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে আঘাত করা হয়েছে ব্যাপকভাবেই। আমরা আগেই ব্যাখ্যা করেছি যে, গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের স্বার্থে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূল ভিত্তিই হলো ভূমিসংস্কার। কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে শাসকদের শ্রেণি স্বার্থেই শুধু ভূমিসংস্কারকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই নয়, এ‍‌ই আমলে প্রথম বছরেই উচ্ছেদ করা হয়েছে প্রায় ২৬৮৩৮জন গরিব কৃষককে তাঁদের জমি থেকে। এছাড়া, নির্মাণের ক্ষেত্রে (রাস্তা, সেচ বাঁধ ইত্যাদির ক্ষেত্রে) বামফ্রন্ট আমলে গৃহীত পদ্ধতি (অর্থাৎ ঠিকাদার বাদ দিয়ে এ কাজে শ্রমজীবী মানুষদের যুক্ত করা) পরিবর্তন করে শুধু যে চালু করা হয়েছে ঠিকাদার পদ্ধতি তাই নয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘কাটমানি’ পদ্ধতি, অর্থাৎ নির্মাণ কাজে যে সাধারণ করদাতাদের অর্থ ব্যবহার করা হবে, তার একটি অংশ এলাকার অপেক্ষাকৃত ধনী‍‌ নেতাদেরই প্রদান করতে হবে। এর ফলে শুধু যে কম কাজ হচ্ছে তাই নয়। অনৈতিকভাবে সুবিধা চলে গেছে ধনী রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এবং সৃষ্টি হয়েছে দুর্নীতির এক বিরাট চক্র। এবং এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ। এই ধরনের দুর্নীতির চক্র ব্যাপকভা‍‌বে ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে, উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানকে পরিকল্পিতভাবেই আঘাত করে।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে এবারে পঞ্চায়েত নির্বাচনের লড়াই হলো এ রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে শ্রেণিস্বার্থের লড়াই। আগেরবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে (২০১৮) যেভাবে শাসক‍‌শ্রেণি লুট করে দখল করেছিল মানুষের পঞ্চায়েতকে, এবার তা হবে না। এবার সেই পঞ্চায়েতগুলি রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন বামফ্রন্টের এবং সহযোগী দলের প্রার্থীরা এবং তাঁদের সঙ্গে আছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। এই লড়াইতে তাই গরিব মানুষের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, যে জয়ের দিকে আশা করে তাকিয়ে আছেন সমগ্র রাজ্যের সাধারণ মানুষ।
 

Comments :0

Login to leave a comment