Post Editorial on MGNREGA

রেগায় একদিকে দুর্নীতি, অন্যদিকে বরাদ্দ বন্ধ গরিবকে ভাতে মারছে দুই সরকারই

উত্তর সম্পাদকীয়​


টানা ১৮ মাস মজুরিহীন গ্রামের ভোটে আপনাদের স্বাগত!
না, এমন ব্যানার কোথাও চোখে পড়বে না। মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে তক্কো-বিতর্কে কোথাও সিকি ভাগ সময়ও বরাদ্দ থাকবে না। সপ্তাহান্তে রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী বুথ পাহারায় থাকবে তো? স্পর্শকাতর থেকে অতি স্পর্শকাতর বুথ কী ঠিক হলো, দিনভর চলবে আলোচনা। 
এই আলোচনা একবারে অনর্থক এমন দাবি করা যায় না। মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের-সরকারের- প্রশাসনের- নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সংবিধান তো আরও দায়িত্ব দিয়েছিল সরকারকে। মানুষের কাজের অধিকার নিশ্চিত করার। 
এদেশে তৈরি হয়েছিল ১০০দিনের কাজের আইন। দেশের সংবিধানের ২১ নং ও ২৩ নং ধারায় ১০০দিনের কাজের জন্য শ্রমিকদের কাজ দেওয়া ও মজুরি নিশ্চিত করার অধিকার দেওয়া আছে। সাংবিধানিক এই অধিকার আজ এরাজ্যে বিলীন। টানা ১৮ মাস ধরে মজুরিহীন দিন কাটাচ্ছেন গ্রামের প্রতি বুথে আমাদের সহ নাগরিকরা। 
২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ সালে শেষ এরাজ্যের ১০০দিনের কাজ করে মজুরির ২১০টাকা করে হাতে পেয়েছেন শ্রমিকরা। রেগার কাজ কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প। এই কাজে যুক্ত যাঁরা সকলেই সেই অর্থে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পভুক্ত শ্রমিক। তাঁদের জন্য মজুরি নেই, ন্যূনতম মজুরির আইন নেই। নেই মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে অন্যন্য সুযোগ সুবিধা।
গোটা দেশে ২০২০-২১ সালের হিসাবে ৬কোটি ৮১ লক্ষের শ্রমিক যুক্ত ছিলেন রেগার কাজে। দেশের গ্রামীণ শ্রমশক্তির ১৭ শতাংশ রেগার শ্রমিক। এরাজ্যে দেড় কোটি রেগার কাজে যুক্ত শ্রমিক গত ১৮ মাস ধরে বঞ্চিত হয়ে আছেন। তাঁদের বকেয়া মজুরির পরিমাণ ২৭৬৫ কোটি টাকা! ২০২২ গোটা বছর, ২০২৩ সালের জুলাই মাস নিষ্কাম। কোথাও কোনও কাজ নেই। আইনে আছে কাজ করার জন্য সরকারের কাছে ‘৪ক’ আবেদন পূরণ করে জমা দিলে কাজ দিতে বাধ্য সরকার। কিন্তু গত ১৮ মাসে হাজারে লাখে ‘৪ক’ ফরম পূরণ করেও কাজ মেলেনি। 
১৮ মাস মজুরিহীন গ্রামের কোটি মানুষ। কাজ করেও তাঁরা মজুরি পাননি। কোনও উদ্বেগ, আশঙ্কা নেই সমাজের কোনও অংশে। সংবাদ মাধ্যমে আছে খবর। তা শুধু কেন্দ্র আর রাজ্যের দ্বন্দ্ব। মোদী আর মমতার বাইনারিতে। ধরুন, কাতার এয়ারওয়েজ সিদ্ধান্ত নিল, তাঁদের বিমান সেবিকা থেকে অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্তদের বড় অংশকে ছাঁটাই করা হবে। সংবাদ মাধ্যমের প্রথম পাতাজুড়ে থাকবে ফরসা গাল বেয়ে বিমান সেবিকার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল। ছবি দেখে আমাদের চোখের পাতা ভিজে যেতে বসবে। বুকটা যন্ত্রণায় হুহু করে উঠবে।
কিন্তু পদ্মা মাঝি ? তাঁর চোখের জলের হিসাব কে নেবে? বাঁকুড়ার তালডাংরার আদিবাসী গৃহবধূ কাজ করেছেন। মজুরি পাননি। মাঝরাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে তাঁকে এখন যেতে হচ্ছে দুর্গাপুরে ঢালাই কারখানার কাজে। এই কাজে তাঁর কোনও অভিজ্ঞতা নেই। তবু মাঝরাতে ঘুম ছেড়ে মুখে কিছু না দিয়েই বের হতে হচ্ছে। অভুক্ত মা সন্তানদের ভুখমারি থেকে বাঁচাতে ছুটছেন শহরে। 
১১২ বার রাজ্যে এসেছে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল। শুরুটা হয়েছিল কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের শীর্ষ আধিকারিকদের পাঠিয়ে। পরবর্তীতে রাজ্যে ১০০দিনের কাজের সরজমিন তদন্ত করে গেছেন রেগার কাজের সোসাল অডিটের সঙ্গে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। প্রতিনিধিদল ঘুরে জড়ো করেছে একাধিক দুর্নীতির তথ্য। এরাজ্যে রেগার কাজে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। গত এক দশকে রাজ্যে আর্থিক লেনদেন জড়িত আছে, এমন সব কাজেই দুর্নীতিতে জড়িয়েছে শাসকদল। তাই কেন্দ্রীয় সরকার এরাজ্যের জন্য রেগা আইনের ২৭নং ধারা প্রয়োগ করে রেখেছে। ২০২২ সাল থেকে চলতি বছরেও সেই ধারায় বন্ধ আছে রেগা। ২৭ নং ধারা মানে, রেগার কাজে বরাদ্দ টাকার অপব্যবহার। কিন্তু কাজ আটকে রেখে লেবার বাজেট অনুমোদন করা যাবে না, এমনটা নয়। আইনেই বলা আছে, যেখানে যা দুর্নীতি হয়েছে তার জন্য রাজ্য সরকাকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই ব্যবস্থা কী তার রিপোর্ট কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকে পাঠাতে হবে। সেই রিপোর্টে যদি কেন্দ্রীয় সরকার সন্তুষ্ট না হয়, ফের ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু অনন্তকাল ধরে কাজ বন্ধ করার কোনও আইন নেই।
রেগাতে চুরি এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। গত ২০২১-২২ সালে রেগায় এরাজ্যে যে পরিমাণ কাজ হয়েছে তাতে মজুরি মেটাতে দরকার ছিল ৭ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা। কিন্তু কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে এরাজ্যে লেবার বাজেটের অনুমোদন ছিল ৫হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। লেবার বাজেট টপকে গিয়ে এরাজ্যে কেন কাজ হয়েছে, তার ব্যাখ্যা রাজ্য সরকার দিতে পারেনি। ফলে ১৪০০কোটি টাকার বকেয়ার পরও দেদার কাজ হয়েছে রাজ্যে। ১০০দিনের কাজ চাহিদা ভিত্তিক। জব কার্ড নিয়ে কাজের চাহিদার ভিত্তিতে কাজ দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্তরে সীমাহীন দুর্নীতি চক্রের জোটে এরাজ্যে রেগার কাজ করা হয়েছে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে। জেলা ভিত্তিতে টার্গেট করে দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় টপকে গেছে এক জেলা আর এক জেলাকে। 
না হলে তখনও, যখন ঘরে বসে সবাই আতঙ্কিত? সাবান মাখার সময় গন্ধ না পেলে করোনার আতঙ্ক গ্রাস করছে গরিবকেও। অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক আছে তো, জানার জন্য মুড়ি মিছরির মতো বিক্রি হচ্ছে পালস অক্সিমিটার যন্ত্র। হাতে আঙুলে গুঁজে তারপর স্বস্তি। কড়া লকডাউনে পথ ঘাট খাঁ খাঁ করছে। ঠিক তখন তিন বছর আগে এক জুলাই মাসে গোটা রাজ্যে একদিনে ১৮ লক্ষ মানুষকে রেগায় কাজ দিয়েছিল রাজ্য সরকার। জনশূন্য গ্রামের মাঠে হুগলীর আরামবাগ মহকুমার গৌরবাটি, হরিণখোলা একের পর পঞ্চায়েত জুড়ে হাজার হাজার কাজ হয়েছিল। ওই সময় কলকাতার পরেই করোনা সংক্রমণে শীর্ষে ছিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলা। লকডাউনের সময় জুলাই মাসের একদিনে ২০০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৯৮টিতে রেগার কাজ হয়েছিল ৭০ হাজার জব কার্ড গ্রাহকদের!
বিপদটা ঠিক এখানেই। মমতা ব্যানার্জির অজানা নয় ১০০দিনের কাজের সীমাহীন দুর্নীতির। ঠিক একইভাবে কেন্দ্রীয় সরকারও জানে রাজ্যের দুর্নীতির হদিশ। তাই দুই তরফের কাছেই রেগা এখন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের হাতিয়ার মাত্র। রাজ্য বলবে, কেন্দ্রীয় বঞ্চনা। বিজেপি বলছে, দুর্নীতির জন্য বন্ধ টাকা। আর কাজ না পেয়ে, বকেয়া মজুরি না পেয়ে জীবনযন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মরবেন গরিব মানুষ।
এরাজ্যে সরকারি কর্মচারীদের ন্যায্য মহার্ঘভাতা ঠেকাতে আদালতে উকিল রেখে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নবান্ন। গোরু, কয়লা থেকে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে ঠেকাতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজ্য সরকার মামলার অংশীদার হয়ে যায়। আর সংবিধান স্বীকৃত কাজের অধিকার থেকে যখন এরাজ্যের গ্রামের মানুষকে টানা দু’বছর বঞ্চিত করে রাখা হয় তখন মমতা ব্যানার্জি আদালতে গিয়ে মানুষের অধিকার রক্ষার কথা ভাবতে পারেন না। পারেন না, একটাই কারণে ফের যদি দুর্নীতির পালকে আবার একটা সিবিআই থেকে ইডি তদন্তের পালক যুক্ত হয়ে যায়!
রেগা নিয়ে এই টানাপোড়েন শুধু গরিবের কাজ কাড়েনি। সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে গরিব বাড়ির একটা প্রজন্মকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে। করোনার সংক্রমণের জেরে কাজ হারানো মানুষের কাছে সুরাহা হতে পারত রেগা। তা হয়নি। তাই বেড়েছে স্কুল ছুট। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে চলতি বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা চোখে আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে সামাজিক সঙ্কটের চেহারাকে। বেড়েছে পরিযায়ীর স্রোত। গোটা পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে মানুষ। আদিবাসী, তফসিলি পরিবারে ভিনরাজ্যে যাওয়ার প্রবণতা কতটা বেশি দেখিয়ে দিয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা।
রাজ্যে দুর্নীতির আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে মোদী সরকারের রেগা নীতিও। ফি বছর দেশজুড়ে কমছে রেগার অর্থ বরাদ্দ। চলতি বছরে রেগার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ করেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত আর্থিক বছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ শেষ পর্যন্ত ছিল ৮৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত বছর থেকে এ বছর হিসাব ধরলে বাজেট বরাদ্দে ৩৩ শতাংশ ছাঁটাই করেছে মোদী সরকার। যে ৬০ হাজার কোটি টাকা এবার বরাদ্দ হয়েছে তার মধ্যে ৫ শতাংশ চলে যাবে প্রশাসনিক খরচে। বাকি ৬০ শতাংশ খরচ হবে নির্মাণ সামগ্রী খরচের জন্য। ফলে লেবার বাজটের জন্য পড়ে থাকবে ২১ হাজার কোটি টাকা। যে টাকার এক কানাকড়ি এখনও রাজ্যের জন্য অনুমোদিত হয়নি। কিন্তু রাজ্য বাদে বাকি দেশের জন্য এই যৎসামান্য টাকায় ১০০দিনের কাজের সংস্থানে মাত্র ৭ দিন বছরে কাজ মিলতে পারে। গরিব মানুষের সঙ্গে এই দুঃসাহস দেখাতে পারছে মোদী সরকার।
দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকা মমতা ব্যানার্জি রেগার কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের এই নীতির বিরুদ্ধে কোনও শব্দ উচ্চারণ করেননি। পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারেও তৃণমূল দল টুঁ শব্দটি করছে না। 
মানুষ যাঁর কাজ দরকার, বাঁচার জন্য আবাস দরকার তাঁরা বলছেন। মমতা ব্যানার্জিকেই বলেছেন। গত নভেম্বর মাসে বেলপাহাড়িতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বীরসা মুন্ডার জন্মদিনের সরকারি অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময় ক্ষণিকের জন্য কুড়চিবুনি গ্রামে দাঁড়িয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়। আদিবাসী সদ্যোজাতকে কোলে তুলে ছবি তোলার ফাঁকে মুখ্যমন্ত্রীকে মহিলারা বলেছিলেন,‘‘ ঘর পাইনি, কাজ নাই। কুথায় যাবো?’’
মজুরিহীন, কাজের আকালে থাকা গ্রামের ভোটে আপনাদের স্বাগত।

Comments :0

Login to leave a comment