মণীন্দ্র চক্রবর্তী
আর কাঙাল হয়ে থাকতে নারি, দে মা আমায় রাজা করি ...।
সত্যিই তো, কাঙাল হয়ে থাকতে কারই বা মন চায়! সবাই তো সাধক রামপ্রসাদ নয় যে, ‘চাই না মা গো রাজা হতে’ গাইতে বসবেন- বরং উলটোটাই ঘটে। সকলেই চায় রাজা হতে। মরিয়া সেই চাওয়ার ভাবটাই একদিন তাই হাস্যরসাত্মক গান হয়ে ফুটে উঠেছিল দাদাঠাকুরের কলমে— ‘দন্ত অন্ত হলো গো মা, কেমনে চিবুই কলাই মুড়ি? এখন হালুয়া ভিন্ন দিন চলে না, বরং রাবড়ি হলে খেতে পারি। দে মা আমায় রাজা করি...! ’
কাজেই ভিক্ষাজীবীর যদি রাবড়ি খাবার সাধ জাগতে পারে, তাহলে শাসক তৃণমূলের আর কয়লা- বালি-চাকরি চুরির টাকা খেতে চাওয়াতে আশ্চর্য কি! তার জন্য যদি দু’-চারটে ব্যালট চিবিয়েও খেতে হয়, তাতে মহাভারত খুব একটা অশুদ্ধ হয় কি? রসে বশে থাকার জন্য এটুকু ক্লেশ অনায়াসেই সহ্য করা যায়। এ নিয়ে যারা ঠাট্টা মশকরা করে তারা ঘোর পাপী। কারণ ঠাকুর রামকৃষ্ণ সেই কবে বলে গিয়েছেন, ‘রাখিস মা তুই রসে বশে, ঝালে-ঝোলে-অম্বলে’। তৃণমূলও চেয়েছিল একেবারে রাজার মতো রসে-বশে, ঝালে-ঝোলে-অম্বলে থাকতে। কিন্তু পেট রোগা বাঙালি জাতির ‘অম্বল’ শব্দেই তো গলা বুক জ্বলতে থাকে, অপরিমিত ঝাল ঝোল সইবে কেন! যথারীতি বদহজম, বাহ্যিবমি শুরু হয়ে গেছে। কোনও ডাক্তার- বদ্যিতে তা নিরাময় করতে পারছেন না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দেওয়া সুরক্ষা কবচ, ওষুধ-পথ্য এবং উপচারেও কোনও কাজ দিচ্ছে না। নেতাদের একে একে আলিপুর, তিহার যাত্রা শুরু হয়েছে। গোটা রাজ্যে স্লোগান উঠেছে-‘তেনার পায়ে হাওয়াই চটি, ভাই-ভাতিজা কোটিপতি।’ ভবিষ্যতে এমনটা যে হতে পারে এটা উপলব্ধি করেই সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রী একবারে শুরুর দিকে দলীয় সভায় পইপই করে কর্মীদের সাবধান করে দিয়েছিলেন- ‘কম কম খাবেন’। কিন্তু কে কার কথা শোনে! অবশ্য শুনবেই বা কেন! চুরির ৭৫ ভাগ যদি কালীঘাটকে দিতে হয়, তবে হাতে আর থাকে কী! ফলে চুরির পরিমাণ বাড়াতে হয়েছে। এখন এমন অবস্থা যে, হাঁ করলেই চুরির মাল দেখা যাচ্ছে। দিনের পর দিন এই চুরি জোচ্চুরি মানুষ দেখেছেন। তবে ভয়-ভীতির কারণে এতদিন তাঁরা মুখ বুজে ছিলেন। কিন্তু ২০১৮ আর ২০২৩ তো এক নয়, তাই রাস্তাঘাটে বেরোলেই আজ তৃণমূলের নেতা নেত্রীদের চোর অপবাদ শুনতে হচ্ছে। যদিও তাতে তৃণমূলের কোনও লজ্জা নেই, কারণ গোটা দলটার মার্গ দর্শন মূলত দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এক) অন্যের ধন চুরি না করলে রাজা কখনোই রাজা হয়ে উঠতে পারে না— এটা তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। এবং দুই) পরবর্তীতে এই রাজা এবং তার অমাত্যরাই হয়ে ওঠে চোরেদের বিশ্বাসযোগ্য একটি আশ্রয়স্থল, চোরেদের সহায়।
চোর-ডাকাত এবং রাজার মধ্যেকার এই সম্পর্কের কথা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বলে গিয়েছেন গৌতম বুদ্ধ। শ্রদ্ধা-শীল-প্রজ্ঞা সহ মানুষের বিভিন্ন গুণাবলী এবং উৎসাহশক্তি ব্যাখ্যা কালে তিনি বলে ছিলেন— ডাকাতের আশ্রয় তিনটি। ১) অনতিক্রম্য নদী ও পর্বতাদি অর্থাৎ সাধারণের অগম্য স্থান। ২) তৃণ বা বৃক্ষের জঙ্গল অর্থাৎ মহাবন, সাধারণভাবে যা মানুষের অপ্রবেশ্য। তৃতীয় এবং সর্বপ্রধান আশ্রয় হলো— রাজা বা রাজার মহামাত্য। ডাকাতরা এই ধরনের ক্ষমতাবানদের উপর সর্বদা নির্ভর করে। কারণ, তারা ভাবে— যদি কেউ আমাকে অভিযুক্ত করে, তাহলে এই রাজা বা অমাত্যগণ আমাকে রক্ষা করার জন্য একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেবেই (‘অঙ্গুত্তর নিকায়’- এর ‘তিক নিপাত’)। যে কারণে আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও দিল্লি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতে গড়িমসি করে। যে কারণে সরকার পুলিশ আমলা প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের অলিখিত বোঝাপড়ায় লুটেরাদের এক বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। ওই একই কারণে স্মরণাতীতকালে তৃণমূল যতরকম অপরাধ সংগঠিত করেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সেগুলোকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সুতরাং, চোর এবং তাদের চুরিকে রক্ষা করতে হলে যে কোনও মূল্যে তৃণমূলকে চোরেদের রাজপাট ধরে রাখতেই হবে। তার জন্য যে কোনও ধরনের অপরাধ করতে তারা প্রস্তুত। তারা ভেবেছিল— সন্ত্রাস চালিয়ে, মিথ্যা মামলা এবং হামলা হুমকি দিয়ে তারা তাদের রাজপাট চালিয়ে যাবে।
কিন্তু বাধ সাধল বামপন্থীরা। তৃণমূলের হামলা হুমকি এবং বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতি মোকাবিলা করে তারা গড়ে তুললেন রুটি রুজির লড়াই। একশো দিনের কাজ এবং আবাস যোজনার সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আছড়ে পড়ল বিডিও এবং পঞ্চায়েত অফিসগুলোতে। পালটাতে শুরু করল গ্রামের রাজনৈতিক ভারসাম্য। এর সাথে যুক্ত হলো নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে গোটা রাজ্যজুড়ে ধ্বনিত হওয়া ‘চোর ধরো, জেল ভরো’ স্লোগান। একই সাথে গ্রামে আওয়াজ উঠল— ‘গ্রাম জাগাও, চোর তাড়াও’। লাল ঝান্ডার শক্ত ডান্ডাটাকে আঁকড়ে ধরে মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে শুরু করল। জনগণের রুদ্র রূপ এবং মেজাজের সামনে তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ক্রমশ গর্তে ঢুকে পড়তে শুরু করে। এতে প্রমাদ গনে রাজ্যের শাসকদল। জন জোয়ারের খোঁয়ারে তাদের একটা অংশকে শামিল করানোর প্রতিশ্রুতি যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ নির্বাচনের মুখোমুখি হতে শাসকের পা কাঁপছিল। কারণ এই দুষ্কৃতীরাই তো ভোট লুটের অন্যতম ভরসা। সেটা নিশ্চিত হবার পর, চোদ্দ তলার নির্দেশে বশংবদ রাজ্য নির্বাচন কমিশন রাতারাতি পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করল। বামপন্থী এবং তাদের সহযোগীরা জানতেন, গ্রাম বাংলার চুরির রাজত্ব কায়েম রাখতে শাসক তৃণমূল এবং তাদের সহযোগী বিজেপি সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেই। সুতরাং সেই শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য অনেকদিন আগে থেকেই তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী সমস্ত শক্তি- কংগ্রেস, আইএসএফ, লিবারেশন সহ ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তির মানুষজনকে একত্রিত করে বিভিন্ন ইস্যুতে বামপন্থীরা ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এতে শহর এবং গ্রামগঞ্জের মানুষের মধ্যে একটা প্রতিরোধের মেজাজ তৈরি হতে থাকে। এতে আরও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে শাসকদল। যে কারণে নির্বাচন ঘোষণা হবার পর থেকেই তারা ভোট লুটের পরিকল্পনা শুরু করে। এবং গোটা পঞ্চায়েত নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার জন্য যতরকম অপকর্ম করা যায়, রাজ্যের শাসকদল এবং পুলিশ প্রশাসন যৌথভাবে সেগুলো চালিয়ে গেছে। মনোনয়ন পর্বে বাধাদান থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণের দিনে কারচুপি, গণনা কেন্দ্রে একেক জায়গায় একেক কায়দায় ভোট লুট, এমনকি গণনা কেন্দ্রের সিসিটিভি এবং তার মেমোরি চিপ গায়েব করে দিয়ে যেভাবে নিয়মকানুনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করেই ফলাফল উলটে দেওয়া হয়েছে, তাতে মহামান্য হাইকোর্ট অবধি নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। জয়ী প্রার্থীদের বলে দেওয়া হয়েছে তাঁদের ফলাফল আদালতের বিচারাধীন। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, গোটা পর্বে পুলিশ প্রশাসনের একাংশ নির্লজ্জভাবে শাসকদলের তাঁবেদারি করে গেছে। সরকারি আধিকারিকদের এই ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই রাজ্যবাসীর স্মৃতিতে থাকবে।
এতকিছু করেও বামপন্থী এবং তাদের সহযোগীদের উত্থান রুখতে পারেনি রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। এতরকম জালিয়াতির পরেও ঘোষিত ফলেও ২০২১-এর তুলনায় শতাংশের বিচারে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ভোট বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে বিজেপি’র ভোট কমেছে লক্ষণীয় হারে। কাজেই স্বচ্ছ নির্বাচন হলে, মানুষের রায় যথাযথভাবে প্রতিফলিত হলে ফলাফল কী হতো তা নিয়ে মানুষ আলোচনা করছেন। আদালত কী রায় দেবে, সেটা সময় বলবে। তবে প্রকৃত চিত্র হলো, ভোট লুটের রাস্তায় না হাঁটলে রাজ্যের বিস্তীর্ণ প্রান্তে তৃণমূলের জয় যে অধরা থাকত, এ বিষয়ে তৃণমূলও নিশ্চিত। এই চিত্র যত স্পষ্ট হচ্ছে, এরাজ্যে তৃণমূল বিজেপি’র দ্বিমুখী লড়াইয়ের তত্ত্ব জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার পবিত্র দায়িত্ব যাদের কাঁধে, সেই সংবাদমাধ্যমগুলো পড়েছে ফাঁপড়ে। তাই শাসকের মুখ রক্ষার্থে কর্পোরেট পরিচালিত ওই সংবাদ মাধ্যমগুলো এখন ভোট লুটের ঘটনাকে বৈধতা দেবার জন্য লিখছে— তৃণমূলের এই জয় সামাজিক প্রকল্পের সুফল! ছাত্র-যুবরা একে রসিকতা করে সমাজ মাধ্যমে লিখেছেন-‘প্রকল্পে কোনও ভরসা নাই, তাই ব্যালট পেপার চিবিয়ে খাই।’
এ ধরনের যুক্তি পালটা যুক্তি গণতন্ত্রে স্বীকৃত। কিন্তু ফল ঘোষণার পর রাজ্যজুড়ে যে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৃণমূল নতুন করে তৈরি করতে চাইছে, তার ফল নিশ্চিতভাবেই ভুগতে হবে তৃণমূলকে। ওদের ধারণা, ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে। কিন্ত, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সহ যে প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বামপন্থী সহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক শক্তি; যেমন- পঞ্চায়েত কাদের হাতে থাকবে? চোর- জোচ্চোরদের হাতে, না কি জনগণের হাতে? জমির অধিকার, ফসলের অধিকার কার হাতে থাকবে? গরিব কৃষক, খেতমজুর, বর্গাদারদের হাতে না কি গ্রামের নব্য ধনীদের হাতে? কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাবে? না কি তার মেহনতের সমস্তটাই তুলে দিতে হবে ফড়েদের হাতে? ১০০ দিনের কাজ গ্রামের প্রকৃত গরিবেরা পাবে, না কি ভুয়ো কার্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লোপাট হবে? আবাস যোজনার টাকায় গরিবেরা ঘর পাবে, না কি শাসকদলের বড়লোক নেতা এবং তাদের পরিবারের লোকজনই সব দখল করবে? বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পগুলির সুযোগ সুবিধা গ্রামের প্রকৃত গরিব মানুষেরা পাবে, না কি পুরোটাই শাসকদলের নেতা নেত্রীদের পকেটে যাবে? কর্মসংস্থান, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আদৌ মানুষের স্বার্থে রূপায়িত হবে, না কি সবটাই থাকবে খাতায় কলমে? এই প্রশ্নগুলোর কোনোটারই নিষ্পত্তি হয়নি, এখনও অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছে বহু প্রশ্ন।
সেই প্রশ্নের উত্তর চাইতে আবার চোয়াল চেপে প্রস্তুত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অভিজ্ঞতায় তাঁরা শিখেছেন, মানুষের সম্মিলিত মেজাজটাই হলো আসল শক্তি। যে শক্তির দাপটে ল্যাজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয় তথাকথিত গুন্ডা-মস্তান বাহিনী। যে শক্তি পুলিশ-প্রশাসন ও আমলাদেরও করজোড়ে দাঁড়াতে বাধ্য করে। লাল ঝান্ডা গ্রামের মানুষের মধ্যে সেই মেজাজটা তৈরি করে দিয়েছে। বলাবাহুল্য, সেই মেজাজকে সঙ্গী করেই চোরেদের বিরুদ্ধে অসমাপ্ত লড়াইকে তুঙ্গে তোলার সংকল্প গ্রহণ করেছেন তাঁরা। তাঁরা এও জানেন, বিজেপি-কে নির্মূল করতে না পারলে তৃণমূলের এই চুরি-জোচ্চুরি, অসভ্যতামিকে নিকেশ করা যাবে না। সুতরাং একটাই স্লোগান– ‘সামনে দিন জোর লড়াই। জোট বাঁধো তৈরি হও।
Comments :0