STORY | NIRUPAM GHOSHAL | NATUN MASTERMASAI| MUKTADHARA | 2025 APRIL 14

গল্প | নিরুপম ঘোষাল | নতুন মাস্টারমশাই | মুক্তধারা | ২০২৫ এপ্রিল ১৪

সাহিত্যের পাতা

STORY  NIRUPAM GHOSHAL  NATUN MASTERMASAI MUKTADHARA  2025 APRIL 14

গল্প | মুক্তধারা

নতুন মাস্টারমশাই

নিরুপম ঘোষাল

 

ইশকুলে নতুন মাস্টারমশাই এসেছেন। অল্প বয়স। প্রথম দিন। হেডমাস্টারমশাই নতুন মাস্টারমশাইকে পরিচয় করাতে ক্লাসে এসেছেন।

ছাত্ররা শৃঙ্খলা মেনে উঠে দাঁড়িয়েছে।

নতুন মাস্টারমশাইর হাতে নাম-ডাকার খাতা, চক, ডাস্টার।

বিরাট ক্লাসরুম। ছাত্রদের বসার চেয়ার-টেবিলের দুটো রো। ছাত্ররা গাদাগাদি করে বসে।

ছাত্ররা অবাক হয়ে দেখতে লাগল নতুন মাস্টারমাশাইকে।

মাস্টারমশাইদের পড়ানোর জন্য ক্লাসরুমে ছোট্ট একখানা চৌকি। তার ওপরে একটা চেয়ার, একটা টেবিল। পেছনের দালানে সিমেন্টের ব্ল্যাকবোর্ড।

হেডমাস্টারমশাই আর নতুন মাস্টারমশাই ছোট্ট চৌকির ওপর এসে দাঁড়ালেন।

হেডমাস্টারমশাই হাতের ইশারায় ছাত্রদের বসতে আদেশ করলেন। ছাত্ররা শৃঙ্খলা মেনে আবার যে যার জায়গায় বসে পড়ল।

গোটা ক্লাসরুম চুপ।

হেডমাস্টারমশাই নতুন মাস্টারমশাইকে দেখিয়ে বেশ ভারি গলায় ছাত্রদের বললেন, শোনো, ইনি হলেন আমাদের ইশকুলের নতুন বাংলার মাস্টারমশাই প্রাণতোষ সরকার। তোমাদের বাংলা গদ্য ও পদ্য পড়াবেন। যাইহোক, তোমরা মন দিয়ে ক্লাস করো। প্রাণতোষবাবু আপনি ক্লাস শুরু করুন। বলে, হেডমাস্টারমশাই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

ছাত্রদের গুঞ্জন।

নতুন মাস্টারমশাই নাম-ডাকার খাতা, চক, ডাস্টার টেবিলে রাখলেন। চেয়ারে বসলেন না। দাঁড়িয়ে নাম-ডাকার খাতা খুলে, বুকপকেট থেকে কলম বের করতেই, ছাত্রদের গুঞ্জনের মাত্রা বেড়ে গেল।

নতুন মাস্টারমশাই কোনওরকমে নাম-ডাকা শেষ করলেন। তবুও ছাত্রদের গুঞ্জন থামলো না।

এরপর শুরু হল পড়ানো। নতুন মাস্টারমশাই ছাত্রদের কাছে বাংলা বই চাইলেন।

প্রথম বেঞ্চের এক ছাত্র বাংলা গদ্য বই এগিয়ে দিতে উঠে দাঁড়াতেই, তার পেছনের বেঞ্চে বসা আরেক ছাত্র তাকে সামান্য জোরে ধাক্কা মেরে মুখটিপে হেসে উঠল। তার হাসিতে আবার কয়েকজন ছাত্র যোগ দিল।

ধাক্কা খাওয়া ছাত্র নতুন মাস্টারমশাইকে কোনওরকমে বইটা দিয়ে ঝুপ করে বসে পড়ল।

বই হাতে পেয়ে নতুন মাস্টারমশাই ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, কোন গল্পটা তোমাদের পড়াবো বলো?

তৃতীয় বেঞ্চের এক ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলতে গেল, স্যার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি।

তার পাশে বসা ছাত্রটি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সমর্থন করে বলল, হ্যাঁ স্যার, ছুটি গল্পটি আমাদের পড়ান।

তার পেছনের বেঞ্চে বসা ছাত্রটি তাকে আঙুলের খোঁচায় কাতুকুতু দিতেই, ছাত্রটি হাসিতে গড়িয়ে পড়ল পাশের ছাত্রটির গায়ে।

পাশের ছাত্রটি আঘাত খেয়ে উল্টে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল তাকে। এতে দুটো ছাত্রের মধ্যে একটুখানি হাতাহাতি হল।

ক্লাসসুদ্ধ হাসির রোল উঠল।

হাসলেন নতুন মাস্টারমশাই নিজেও। অবশ্য তাঁর হাসিতে ছিল শুধুই সরলতা। শুধু শিক্ষক গুরুজন নয়, ছাত্রদের প্রকৃত বন্ধুও বটে তিনি।

নতুন মাস্টারমশাই সেই মতো করে বললেন, ঠিক আছে, আজ তোমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি গল্পটি পড়াবো। তোমরা সবাই মন দিয়ে শুনবে কেমন!

নতুন মাস্টারমশাই পড়াবেন কি, ফের ছাত্রদের গুঞ্জন।

নতুন মাস্টারমশাই পড়াবার মধ্যে মধ্যে হাতের ইশারায় ছাত্রদের গুঞ্জন থামাতে বললেও, ছাত্রদের মধ্যে তার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না।

এভাবে বেশ কয়েক দিন কাটলো।

একদিন নতুন মাস্টারমশাইকে ডাকলেন হেডমাস্টারমশাই। জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ক্লাসে রোজ রোজ ছাত্রদের হইচই শুনতে পাই। কী ব্যাপার? ছাত্ররা কী আপনার কথা শুনছে না?

নতুন মাস্টারমশাই বেশ শান্তভাব নিয়েই উত্তর দিলেন, একটু করছে বইকি। সব ঠিক হয়ে যাবে স্যার।

হেডমাস্টারমশাই বললেন, ঘাবড়াবেন না, প্রয়োজনে বেত তুলবেন।

নতুন মাস্টারমশাই জানতেন, মাস্টারমশাই মানে হাতে বেত, কঠোর শাসন নয়। মাস্টারমশাই পিতামাতার সমান, ছাত্ররা তাদের সন্তানের মতো। ছাত্রদের প্রকৃত জ্ঞান চেতনা দিতে হবে। আর তা দিতে হবে ভালোবেসে, স্নেহে।

নতুন মাস্টারমশাই হেডমাস্টারমশাইয়ের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে, কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

তারপরেই যে কী ঘটল!

একদিন নতুন মাস্টারমশাই ক্লাসে এলেন। একইভাবে ছাত্রদের গুঞ্জন শুরু হল।

নতুন মাস্টারমশাই ছাত্রদের গুঞ্জনের মধ্যে নাম ডাকলেন, বই চেয়ে নিয়ে পড়াতে শুরু করলেন।

হঠাৎ পড়ানো বন্ধ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। মুখে কোনও কথা বললেন না। একটুপর পড়াবার বইখানা বন্ধ করে টেবিলের ওপর রাখলেন।

ছাত্ররা এসব দেখেও গুঞ্জন থামালো না, করেই চলল।

এবারে নতুন মাস্টারমশাই ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ঠিক আছে, আজ তোমাদের পড়তে হবে না। আজ শুধু একটা কথা তোমাদের আমি বলবো, দয়া করে একটু শুনবে।

নতুন মাস্টারমশাই কথাটা বার কয়েক বলায়, ছাত্ররা এবারে একটু গুঞ্জন থামালো।

নতুন মাস্টারমশাই গোটা ক্লাসরুমের ছাত্রদের ওপর একবার চোখ ঘোরালেন।

তারপর বেশ শান্তভাবে শিক্ষকদের বসার চেয়ারখানা দেখিয়ে বললেন, তোমরা এই চেয়ারখানা দেখতে পাচ্ছো? তোমরা নিশ্চয়ই জানো, এই চেয়ারখানায় কত গুণি সম্মানীয় শিক্ষকমশায়েরা বসে এসেছেন, এখনও বসেন। ভবিষ্যতেও বসবেন। তাই তো?

তারপর একটুখানি দম নিয়ে বললেন, আমি নিজে সেই শিক্ষকমহাশয়দের সম্মান-শ্রদ্ধা করি। তোমরা ক্লাসে গুঞ্জন করছো, করো। তোমরা আমাকে সম্মান নাও করতে পার, তাতে আমার কোনও দুঃখ নেই। তবে আমি বলবো, সেই গুণি সম্মানীয় শিক্ষকমহাশয়দের কথা ভেবে, এই চেয়ারখানাকে সম্মান করে ক্লাসে গুঞ্জন বন্ধ করবে, এই আমার আবেদন।

অবাক কান্ডা! নতুন মাস্টারমশাইয়ের ভাষণ শুনে গোটা ক্লাসরুম মুহূর্তে চুপ! তা একদিন নয়, এরপর থেকে প্রতিদিন।

তোমরা শুনে আরও অবাক হবে, নতুন মাস্টারমশাই যেদিন এই ইশকুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে, আরও বড় ইশকুলে চাকরি করবেন বলে চলে গেলেন, সেদিন এই ছাত্ররাই তাঁর জন্য খুব খুব কেঁদেছিল।

 

Comments :0

Login to leave a comment