UTSAVE ANUVABE / STORY / AMIR UL HAQ / HUPPA SHERALI / MUKTADHARA / 29 SEPTEMBER 2025 / 3rd YEAR

উৎসবে অনুভবে / গল্প / আমির উল হক / হুপ্পা শেরআলী / মুক্তধারা / ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩

সাহিত্যের পাতা

UTSAVE ANUVABE  STORY  AMIR UL HAQ  HUPPA SHERALI  MUKTADHARA  29 SEPTEMBER 2025  3rd YEAR

উৎসবে অনুভবে 

মুক্তধারা

গল্প

হুপ্পা শেরআলী

আমির উল হক 

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩

       
-------------------------------------------------------------------

   একটা মানুষের নামের আগে কী করে 'হুপ্পা' শব্দটি পাকাপাকি ভাবে জুড়ে যায় তা পশ্চিম পাড়ার শেরআলীকে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবে না। পিতৃদত্ত নাম অবশ্য একটা ছিলো। কিন্তু ব্যবহার না করার ফলে আর কেউ মনে করতে পারে না। গ্রামের ভোটার তালিকায় সরকারি নথিতে ও সেই পাড়ার নাম নাম রয়েছে "হুপ্পা শেরালির পাড়া "। ফলে সরকারি ভাবেও নামটি স্বীকৃত। 
   ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় চব্বিশ বছর আগের। বলেছিল আমাদের সকলের জানুভাই। জান মহম্মদ, লোকে বলে জানু চালাকি। জানু ভাই এর মতন ধুরন্ধর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির লোক দেখা যায় না। আমাদের পরিবারের একেবারে নিজস্ব লোক হিসেবে তাকে সবাই চেনে। আমি জানুভাই কে জিজ্ঞেস করলাম  --- আচ্ছা পশ্চিম পাড়ার ঐ লোকটার নাম "হুপ্পা শেরালি" কী করে হলো ? 
জানুভাই শুরু করলেন  --- এক সময় আমাদের এই গা গেরামে খুবই হনুমানের উপদ্রব ছিলো। হনুমানের হামলায় বহু মানুষ আহত হতো। পুরো এলাকার প্রায় সমস্ত বাড়ির গাছের ফুল ফল, শাক সব্জি, সমস্ত রকমের ফসল খেতে বড় বড় হনুমানের দল হামলা করতো। ঐ দলে খুব বড় সাইজের কিছু হনুমান ছিলো। তাদেরকে "বীর" বলা হতো। ঐ "বীর" গোছের হনুমান গুলোকে কেউ তাড়াতে পারতো না। গ্রামের লোক লাঠি সোটা, তীর ধনুক, পাশলি বল্লম নিয়ে তাড়া করলেও  উল্টে তারাই গ্রামবাসীদের উপর চড়াও হতো, হামলা করতো। কত মানুষ যে ঐ হনুমান বাহিনীর হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বিশাল থাবা নিয়ে যখন তারা এগিয়ে আসতো তখন কোন বাধা তারা মানতো না। কেউ যদি সাহস করে রুখে দাঁড়াতো তখন তাদের উপর ঐ হনুমান বাহিনী নৃশংস ভাবে হামলা করতো। ওদের অত্যাচারে আমাদের গ্রামের মানুষদের টেকাই দায় হয়ে উঠেছিল। 
আচ্ছা  জানুভাই এই সমস্যা বনবিভাগের কাছে জানানো হয়নি ?  হয়েছিলো বৈকি, কিন্তু বনবিভাগের বাবুরা এমন সময় এসেছিলো, তখন হনুমান বাহিনীর দেখা মেলেনি। বনবাবুরা এসে গাড়ি নিয়ে টহল দিয়ে চলে গেলেন। আমাদের সমস্যা থেকেই গেলো। তারপর গ্রামের সব মুরুব্বি লোকেরা মিটিং এ বসলেন। প্রধান, মেম্বার, এলাকার সব মাস্টার, অফিসার, কেরানী, শিক্ষিত ছাত্র যুবক, গ্রামের চৌকিদার দফাদার আর এলাকার বেশ কিছু মেয়ে বউঝি ও সেই মিটিং এসেছেন। এলাকার ডাকসাইটে নামকরা মোড়ল মাতব্বর গোছের মানুষেরা ডেকেছেন সবাইকে। সেই মিটিং এ যদি কিছু সমাধান বার হয়। গ্রামের মানুষ ও তাদের ফসল পানিকে এই হনুমান বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচাতে হবে। 
মিটিংয় শুরু করলেন এলাকার বিশিষ্ট মৌলানা ও সর্বজনমান্য ফরমান মৌলভী। তাঁর সামনে উপস্থিত সবাই একটু একটু ইতস্তত করছিলেন। ফরমান মৌলভীর অভয়দানে এবার একে সবাই মুখ খুললেন। কেউ বললেন আগুনের মশাল জ্বালিয়ে হনুমান তাড়ানো যাবে। কেউ বললেন তীর ধনুক,ঝাঁটা, লাঠি, বল্লম, সড়কি, হেসো পাশলি, দা,বটি যে যা হাতের সামনে পাবে তা নিয়েই পাহারা দিতে হবে। এই শুনে এলাকার মাস্টার মশাই একরাম মাস্টার সবাইকে বললেন -- না এরকম হলে তা যদি কোনভাবে কোন হনুমানের জীবনহানি হয় তাহলে তা খুব বেআইনি কাজ হবে। এটা কোনভাবেই করা যাবেনা। তখন সারা গ্রাম শুদ্ধ মানুষকে বেকায়দায় পড়তে হবে। মাজেদ সরকার, বিশাল বড় ভুড়িওয়ালা মানুষ। পাকুড়তলার বাঁশের মাঁচাতেই দিন রাত কাটান। মাঁচা ছেড়ে তিনিও মিটিংএ এসেছেন। একা চলাফেরা করতে অসুবিধা, তাই তার কিশোরী মেয়ে সুফেরাকে সঙ্গে এনেছেন। শাকিলা, ফেরদৌসী, হানুফা, বিউটি, ফেন্সি তারাও এসেছে তাদের বান্ধবী সুফেরার সঙ্গী হয়ে। কারও কথাতেই কোন সমাধানসূত্র বার হচ্ছেনা। একেবারে শেষ প্রান্তে কোন ঘেঁষে নিচু হয়ে বসেছিল গ্রামের চাষী শের আলী। সারা জীবন তার মাঠ ঘাট, বন জঙ্গল ও নদী নালাতেই কেটেছে। সারাজীবন রোদে পুড়ে, জলে ভিজে গয়ের রং যেমন নিকষ কালো তেমনি পেটানো শরীর। মুখাবয়বেও একটু ব্যতিক্রমী ছোঁয়া। শের আলীর সঙ্গে একটা লাঠি ও একখানা হেসো প্রায় সবসময়ই থাকে। আজ মিটিং এ এসেছে বলে সেগুলি সঙ্গে নেই। শের আলী অদ্ভুত লাফাতে পারে, দৌড়াতে পারে। আর ভয়ংকর জোরে চেচামেচি করতে পারে। গ্রামের লোকজন তাকে ভয়ে বেশ সমীহ করে চলেন। মিটিং এ অনেকেই যে যার মতামত রাখলেন। কোন কথাই  মতামতই মনপুত হচ্ছে না। এবার ভরা মিটিং কাচুমাচু মুখে শের আলী কিছু বলতে চাইছে। সবার দৃষ্টি তখন শের আলীর দিকে। 
দেখুন যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি কিছু বলতে পারি। সবাই বললেন --   হ্যাঁ বলো, বলো। তোমার যা বলার আছে নির্ভয়ে বলো। এবার শের আলী শুরু করলো  --- আমার নাম শের আলী। আমার নামের মাথায় একটা বাঘ আছে। আমি কোন কিছুতেই ভয় পাইনা। আমার সঙ্গে গোটা দশেক তাজা তাগড়াই জোয়ান ছেলে থাকলে এলাকা থেকে হনুমানের বাহিনীকে এলাকা ছাড়া করে দেবো। আপনারা আমাকে দশটা ছেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। গ্রামের ক্লাবের সেক্রেটারি গোলাম পাঞ্জাতন, সবাই তাকে সংক্ষেপে জিপি নামে ডাকে। জিপি'র উপর ভার পড়লো এই দশটা ছেলে জোগাড় করে দেওয়ার। অনেক ভাবনা চিন্তা করে জিপি এলাকার বাছাই করা তাগড়াই গোছের দশটা ছেলের নাম দিলো। ভরা মিটিং এ তাদের ডাক পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই দশটি ছেলেকে শের আলীর সামনে হাজির করানো হলো। মিটিংয়ে সবাই শের আলীকে জিজ্ঞেস করলেন --- শের আলী তুমি কী ভাবে এই মাত্র এগারো জনে এতগুলো হনুমানকে তাড়াবে ? 
শের আলী মুখ কাচুমাচু করে বলল -- আজ্ঞে আপনাদের যদি দোয়া থাকে তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। আপনারা সবাই দোয়া করুন। 
এই কথা বলেই একটা বিকট বিভৎস চীৎকার করে শের আলী একেবারে লাফিয়ে উঠলো। সকলে তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। শের আলীর শরীরে তখন যেন কোন দানবীয় শক্তি। কয়েকশত লোক হাজারো চেষ্টা করে ও তাকে থামাতে পারছেন না। এবার একটা অদ্ভুত শব্দ শের আলীর মুখে শোনা যাচ্ছে। হুপ -- হপ প --- হুপ প। কোন কথা না, শুধু ঐ একটিই শব্দ -- হুপ -- হুপ প --হুপ প প ----। 
ঘটনা কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামের অনেকের মধ্যে চাউর হয়ে গেছে। কেউ বলছে শের আলীকে জিনে ধরেছে, কেউ বলছে ভূতে ধরেছে। কেউ বা বলছে ওকে কোন অশরীরী আত্মা ভর করেছে। 
মিটিং প্রায় পন্ড হবার জোগাড়, সেই সময় ঐ উত্তেজনার মধ্যে জাহির কালু বলল --- কিছুদিন আগে হনুমানদের নিজেদের মধ্যে মারামারিতে একটা বীর হনুমান মারা গেছিল। সেই হনুমান মারা যাবার সময় এই ধরনের হুপ প  হুপ প শব্দ করছিল। নিশ্চয় সেই মৃত হনুমানের অশরীরী আত্মা শের আলীর উপর ভর করেছে। ঘটনার পরম্পরায় মিটিংয়ের সবাই হতবাক। কি বলবেন, কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শের আলীর মুখে তখনও ঐ একই শব্দের ফোয়ারা চলছে। মিটিংয়ের সভাপতি একরাম মাস্টার শের আলীকে জিজ্ঞেস করছেন  তোমার কী হলো শের আলী ?  তার ঐ একই শব্দ  হু পপপ -- হুপপপপ -- হুপপপপপ। সভাপতি মিটিং শেষ ঘোষণা করতেই শের আলী অদ্ভুত এক অঙ্গভঙ্গি করে উপস্থিত বাছাই করা দশজন ছেলেকে কী যেন ইশারায় বলল। সঙ্গে সঙ্গে শের আলী ওদের সবাইকে নিয়ে একেবারে নিমেষের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল। তারপর থেকে এলাকায় আর কোন হনুমানের দেখা নেই। দশজন জোয়ান ছেলে ও শের আলীকেও আর দেখা যায়না। ওরা যে কোথায় গেল কেউ বলতে পারেনা। সেই থেকে গোটা এলাকায় একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। 


 

Comments :0

Login to leave a comment