উৎসবে অনুভবে
মুক্তধারা
গল্প
জোনাকির নিস্তেজ আলো
অমল কর
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩
'ক' অক্ষর গোমাংস নিমাই মাঝদরিয়ায় গেছে জেলেডিঙি নিয়ে মাছ ধরতে। সামনে পুজো।
মাগ-ছেলের ভরণ-পোষণ ছাড়াও মহাজনের কর্জের টাকা শোধ । বউ বিনির পরণে ছেঁড়া কাপড়, ছেলের জুতোহীন পা। এ দফায় বাড়তি
ঝুঁকি নিয়ে বেশিকিছু রোজগার করতে না -পারলে ইজ্জত পাংশুটে হয়ে যাবে। জয় মা দুগ্গা বলে নদীর নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়ে নিমাই।
দূর থেকে বন্ধু লখাই হাঁক পাড়ে যতদূর বাজখাঁই গলায় চিলচিৎকারে শব্দ যায় __ নিমাই, এবার ফিরে আয়,ওখানে ঘূর্ণি, এলোমেলো বাতাসে ঝড়ের ইশারা।জোর হিম্মতে বইঠা মেরে ডিঙি বেয়ে ফিরে আয় জলদি।
লখাই-এর গলার শব্দগুলো নিমাই পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা বোঝা গেল না। লখাইরা তড়িঘড়ি ফিরলেও,
ফিরল না নিমাই।দিন মাস বছর পার হয়ে গেল,ফেরেনি নিমাই।
নিমাই-এর বউ বিনির ঘর বলতে আট বাই দশ।চিড়ফাড় বিনি। চতুর্দিকে তার তিনশত আঁধার।
দুর্মর আশায় ছুটে ছুটে যায় নদী চরায়। দুচোখ ছেনে খোঁজে নিমাইকে।বিধবা হাওয়ায় শুনতে পায় শুধু হাহাকার আর আর্তনাদ। ভাঙা ডিঙি যদিবা ফিরেছে,
ফেরেনি নিমাই।
যাবার কালে নিমাই বিনিকে আদর করতে করতে বলে গেল, 'ইবার, দুগ্গা আসার আগে তুকে লালপেড়ে
শাড়ি দোব, নেতাই পাবে জুতো। পং পং আওয়াজ তুলে হেঁটে বেড়াবে সাহেব আমার উঠোনে, রাস্তায়।..কেডা যায়। নিমাই-এর ছেলে গো। ...গন্ধতেল মাখবি তুই, ...সিন্দুর। চুড়ি বাজবে টুংটাং তুর দুইহাতে..। কইলকেতা নে যাব, দুগ্গা দেখাব।'
কোথায় কি! রাক্ষুসে পেটের দাহে আর বাচ্চাটার পীড়নে বাঁচার তাগিদে বিনিকেও শয়তান সুদখোর মহাজন হারান বাগদির বাইরের ঘরে অষ্টপ্রহর গতর বেচতে হয়।পাতাই ছিল ফাঁদ। বিনির ঝাঁঝালো বাড়তি ফুটন্ত যৈবনের দিকে হারানের লোলুপ দৃষ্টি ছিল। নিমাই-র ডিঙিতে লখিন্দরের লোহার বাসরঘরের ছেঁদার মতো চোরা ছেঁদা হারানের কারসাজি। লোভ নদীর নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে ঘূর্ণির তোড় ঝড় আর হারানের খেয়ালি মতলবে নিমাই আর ফিরতে পারেনি।
ভয়াল দাঁতাল মহাজন নিমাই-র কর্জ শোধের অছিলায় লুটে নেয় বিনির মাংসল শরীর। হাটে হাঁড়ি ভাঙার ফোঁস দেয় বিনি। নেতাইকে লোপাট করার হুমকি আর বেঁচে থাকার প্রচণ্ড লোভের লালসা বিনিকে ক্রমশ পোয়াতি করে।
বিনিকে বেশিদিন সইতে হয়নি কলঙ্কের দহন।নির্জন নদীচরে একদিন পড়ে থাকে একা বিনির নিরীহ শীতল শব। কারা যেন নদীচরা থেকে লম্প নিয়ে আলো-আঁধারিতে ত্রস্ত পায়ে ফিরে যায়।
চন্দন সিঁদুর অশ্রু ছিল না,ছিল শুধু বিনির জন্য নীরব অবহেলা আর এতদিনের অসহায় কলঙ্কিত বেঁচে থাকার জ্বালা আর একরাশ খিদে।
নিরলস বেজে বেজে যায় ঝিঁঝির ঝাঁঝর।চিতাগ্নি জ্বলেনি বিনির। খোলা চোখ ছিল বিনির আকাশের দিকে মানুষের দিকে সমাজের দিকে শাসকের দিকে। কী এক জিজ্ঞাসা তুলে বিষণ্ণ বিবেক শুধু জ্বলেছিল মাঝরাতে জোনাকির নিস্তেজ আলো।
Comments :0