Bangla Bachao Yatra

মিস্টার কৃষক? ধান বেচতে হলে ‘মিস্টার’ ফেলে আসুন

রাজ্য

পীযূষ ব্যানার্জি


নামের আগে জুড়ে গেছে ‘মিস্টার’!
সেই মিস্টার কাটাতে এক বছর ধরে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছেন দুলাল রায়! 
কি, ভাবছেন এসআইআর?
এসআইআর আতঙ্ক তখন আসেনি। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড থেকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সব জায়গাতেই আছে শুধুই দুলাল রায়। কৃষকবন্ধু’র সরকারি কাগজেও নামের আগেও নেই মিস্টার। 
এহেন দুলাল রায় গত বছর সরকারের কাছে ধান বিক্রি করার জন্য কাগজপত্র নিয়ে হাজির হয়েছিলেন নথিভুক্ত হতে। সব নথি যাচাই হওয়ার পর হাতে আসা ধান বিক্রির কার্ডে উঠে এল ‘মিস্টার’ দুলাল রায়। ব্যাস ধান বিক্রি বন্ধ।
ছেলের নামে ‘মিস্টার’। বাবা অজিত রায়। তিনিও গিয়েছিলেন নথিভুক্ত হওয়ার জন্য। ভোটার, আধার, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টের পাসবই থেকে কৃষকবন্ধু’র কাগজ দিয়ে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করার জন্য কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর বেরিয়ে আসে রেজিস্ট্রেশনের কার্ড। 
অজিত রায়ের কাগজ এল, অজিত ‘কুমার’ রায়। 
‘মিস্টার’ আর ‘কুমার’এর গেরোয়ও এখন বাবা আর ছেলেকে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে সরকারি দপ্তরে। তাঁদের প্রমাণ করতে মিস্টার দুলাল রায়, আর অজিত কুমার রায় আসলে একই মানুষ। যতক্ষণ না প্রমাণ হবে বন্ধ তাঁদের ধান বিক্রি!
‘‘দুলাল রায়টা কম্পিউটার থেকে মিস্টার দুলাল রায় বেরিয়ে এসেছে। তারপর থেকে ধান বিক্রি করতে পারিনি। ধান কেনার সরকারি লোকরা বলছে, মিস্টার থাকায় কম্পিউটার নিচ্ছে না। এখন সংশোধন না করলে ধান বিক্রি করা যাবে না। গত বছর তিন-চারবার ব্লকে এডিএ (ব্লক কৃষি আধিকারিক) অফিসে ঘুরে এসেছি। সংশোধন হয়নি।’’ বলছিলেন চন্দ্রকোনা ১ নং ব্লকের কঙ্কাবতী ৩ গ্রাম পঞ্চায়েতের কৃষক দুলাল রায়। এখন মাঠ থেকে তাঁর ধান উঠছে। কাজের চাপ সামলে আবার যাবেন ব্লকে। যদি নামটা থেকে মিস্টার কথাটা বাদ দেওয়া যায়?
যদি ‘মিস্টার’ বাদ না পড়ে?
গত বছর দেশের সরকার ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করেছিল কুইন্টালে ২ হাজার ৩০০ টাকা। মিস্টার’এর চক্করে পড়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দরে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেননি কৃষক। ‘‘গত বছর থেকেই সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারিনি। মিস্টার থাকায় খোলা বাজারে ২ হাজার ১ টাকা দাম দিয়ে ব্যবসাদারদের কাছে ধান বিক্রি করতে হয়েছিল।’’ বলছিলেন দুলাল রায়। অভাবী মূল্যে ধান বিক্রি করার পর এবার কি হবে জানেন না। গত বছর ধানের এমএসপি (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস) ছিল কুইন্টালে ২ হাজার ৩০০ টাকা। ফলে গতবারই মিস্টার’ যোগের কারণে দুলাল রায় ন্যূনতম সহায়ক মূল্যটুকুও জোগাড় করতে পারেননি। 
এখন মাঠে জোরকদমে ধান কাটা চলছে। এরাজ্যের সব জেলাতেই মাঠ থেকে ধান তুলতে শুরু করেছেন কৃষকরা। ধান উঠলে বসাতে হবে আলু। সরকার কি এবছর ধান কিনতে নামল?
কৃষকরা বলছে, এখন ধান কেনার শিবিরে রেজিস্ট্রেশন চলছে। সরকার কবে নামবে তার ঠিক না থাকলেও খোলাবাজারে ব্যবসায়ীরা নেমে পড়েছেন ধান কিনতে। সেই ধানের দাম কত? চন্দ্রকোনায় এখন মেশিনে কাটা পাকা ধানের দাম ব্যবসায়ীরা দিচ্ছে কুইন্টালে ১ হাজার ৫৫০ টাকা। আর ধান শুকনো করে বিক্রি করলে ১ হাজার ৭৫০ টাকা দর পাওয়া যাচ্ছে।
চলতি ২০২৫-২৬ আর্থিক বছরে ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কুইন্টালে ২ হাজার ৩৬৯ টাকা। যার অর্থ ধান মরশুমের শুরু থেকেই অভাবী বিক্রি সঙ্গী কৃষকদের। 
খরতাপ থেকে শুরু করে হাড়-কাঁপানো শীতে ৩৮৪ দিন রাজধানীর রাজপথে বসেছিলেন কৃষকরা। তিন কালা কৃষি আইন প্রত্যাহার করার দাবি নিয়ে। এমএসপি’র আইনি স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে। তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে দিল্লির মোদী সরকার।
কেন স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে ফসলের উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম দাবি করছেন কৃষকরা। এদেশের, এরাজ্যের কৃষকদের যাপিত জীবনই জানিয়ে দিয়েছে সঙ্কটের সর্বগ্রাসী চেহারাকে। সারা ভারত কৃষকসভার সাধারণ সম্পাদক বিজু কৃষ্ণাণের কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারেরই প্রতিষ্ঠান সিএসিপি (কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইস) তথ্যকে বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি গত ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে রবি ও খরিফ মরশুমে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ না মানায় ২০টি কৃষিপণ্যে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ লক্ষ কোটি টাকা। আর ২০১৬ সাল থেকে ২০২৫ সালের, ৯ বছরের হিসাবে কৃষকের ক্ষতি ২৪ লক্ষ কোটি টাকা।’’ 
২০২৩ সালে মোদী সরকারের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দপ্তর থেকে সামনে এসেছে এনসিআরবি (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো)’র সর্বশেষ কৃষক, খেতমজুর ও অসংগঠিত শিল্প শ্রমিক (দৈনিক মজুরির শ্রমিক)’দের আত্মহত্যার তথ্য।
সেই তথ্য জানাচ্ছে, এক বছরে (২০২৩সাল) এদেশে কৃষক ও খেতমজুরদের মিলিত আত্মহত্যার সংখ্যা ১০ হাজার ৮০০। দিনমজুর আত্মহননকারী ছিলেন ৪৭ হাজার। সব মিলিয়ে শুধু ২০২৩ সালে, এক বছরে কৃষক, খেতমজুর ও দিনমজুর মিলিয়ে ৫৬ হাজারের আত্মহত্যা! সেই তালিকায় নেই বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের মতো পরিযায়ী শ্রমিক অধ্যুষিত প্রায় ১২টি রাজ্য। মোদী সরকারের আমলে গত ১১ বছরে খেতমজুর-দিনমজুর ও কৃষক মিলিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৫ লক্ষ মানুষ। 
মোদী সরকারের আমলে ভয়াবহ এই কৃষি সঙ্কট নিয়ে মুখে রা কাড়েন না মমতা ব্যানার্জি। কারণ, নিজের রাজ্যেও কৃষক আত্মহত্যা নিয়ে মমতা ব্যানার্জির সরকার কোন তথ্য সরবরাহ করেন না। তবু এরাজ্যে তথ্যের অধিকার আইনে গত ২০২১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ২৩ টি ব্লকের কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা সামনে এসেছিল। শুধু ওই এক জেলাতেই ১২২ জন কৃষকের আত্মহত্যার তথ্য জানাতে বাধ্য হয়েছিল সরকার।
 

Comments :0

Login to leave a comment