পূর্ত দপ্তরের অধীনে থাকা রাজ্যের সমস্ত ‘স্টেট হাইওয়ে’-তে টোল ট্যাক্স বসাতে চলেছে নবান্ন।
রাজ্যে এই মুহূর্তে ১৯টি স্টেট হাইওয়ে আছে। রাজ্য সড়কগুলির ওপর টোল বসিয়ে কর আদায়ের নীতি তৈরি করে ফেলে রাখা ছিল। এখন আর্থিক সঙ্কটের কথা বলে সেই টোল নীতিকেই কার্যকর করতে তৎপরতা শুরু হয়েছে। টোল বসিয়ে কর আদায়কে এতদিন জনস্বার্থের পরিপন্থী বলে ঘোষিত অবস্থান থেকে সরছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। টোল থেকে আয় করার এই পরিকল্পনায় বোঝা শেষ পর্যন্ত পড়তে চলছে জনগণের ওপরই।
সোমবার পূর্ত দপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের উপস্থিতিতে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। পূর্ত দপ্তরের অধীন সমস্ত জোনাল ইঞ্জিনিয়ারদের ওই বৈঠকে ডাকা হয়েছে। সূত্রের খবর, ওই বৈঠক থেকেই রাজ্য সড়কের ওপর টোল বসানো নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হতে চলেছে। বৈঠকে এই মুহূর্তে রাজ্য সড়কগুলির ওপর দিয়ে যানবাহন চলার পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপাতত যে সব রাজ্য সড়ক দিয়ে যান চলাচল বেশি সেই সড়কগুলিকেই টোলের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নবান্নের একটি সূত্রে জানা গেছে, বৈঠক থেকে টোল আদায় নিয়ে প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করে পাঠানো হবে পূর্ত দপ্তরে। সেখান থেকে বিস্তারিত আলোচনার পর পাঠানো হবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন আসার পরই রাজ্য সড়কের ওপর টোল বসিয়ে কর আদায়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হবে। নবান্ন থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন আসার পরই টোল প্লাজার পরিকাঠামো গড়া, কোনও রাজ্য সড়কগুলির ওপর প্রথম পর্যায়ে টোল আদায় করা হবে, একইসঙ্গে টোল আদায়ের হারও ঠিক করা হবে।
পেট্রোল ডিজেলের লাগামছাড়া দামে এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। এরাজ্যে তার ওপর বাড়তি প্রভাব আছে ফড়েদের। এরপর রাজ্য সড়কে টোল আদায় শুরু হলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে বাধ্য। অতীতে রাজ্য সড়েক টোল আদায়ের বিরুদ্ধে নীতিগত অবস্থান নিয়েছিল রাজ্য সরকার। এখন প্রবল আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ে আয় বাড়াতে আগের অবস্থান থেকে সরতে চাইছে রাজ্য। তারই পদক্ষেপ হিসাবে এরাজ্যের সমস্ত রাজ্য সড়কের ওপর টোল আদায় নিয়ে নতুন করে সমীক্ষায় নামছে পূর্ত দপ্তর।
গত সেপ্টেম্বর মাসে নবান্নে রাজ্য প্রশাসনের পর্যালোচনা বৈঠকে বসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ওই বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রীর মূল কথাই ছিল, কীভাবে রাজ্যের আয় বাড়ানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। মূলত দপ্তরের প্রধান সচিবদের মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, আগামী দিনে আয় বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। ওই বৈঠকেই রাজ্যের আর্থিক পরামর্শদাতা অমিত মিত্র সরকারি জমি ব্যাপক হারে বিক্রি করার পরিকল্পনা তৈরি করে দিয়েছিলেন। ৩২টি সরকারি জমি বিক্রি করে সাড়ে ৮হাজার কোটি টাকা তোলার লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট হয়েছিল। সরকারি জমি বিক্রি করে রিয়েল এস্টেটের হাতে তুলে দিয়ে আয় বাড়ানোর পরিকল্পনায় সিলমোহর দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নের ওই বৈঠকেই রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আমলাদের মমতা ব্যানার্জির ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল। ‘‘সরকারের আর্নিং কোথায়? শুধু তো বার্নিং হচ্ছে। মাইনে দেব কোথা থেকে? এটা তো তোমাদের (আধিকারিক) ভাবতে হবে।’’ বৈঠকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দেশ আসার পর থেকেই রাজ্যের প্রতিটি দপ্তর পরিকল্পনা তৈরি করে। সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবেই পূর্ত দপ্তর ঠিক করেছে, রাজ্য সড়ক থেকে টোল আদায় করে বাড়ানো হবে আয়।
২০১২সালে মমতা ব্যানার্জির ‘অনুপ্রেরণায়’ রাজ্যে তৈরি করা হয়েছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন। স্টেট হাইওয়ের তৈরির কাজে অগ্রগতি আনার জন্য পূর্ত দপ্তরের অধীনেই তৈরি করা হয়েছিল আলাদা একটি সংস্থা। রাজ্যের সড়ক নির্মাণের মূল দায়িত্বে পূর্ত দপ্তর। রাজ্য সড়ক, জাতীয় সড়ক, জেলার সড়ক সহ রাজ্যের সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত পূর্ত দপ্তর। ওয়েস্ট বেঙ্গল হাইওয়ে ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন তৈরি করে সরকার রাজ্য সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পূর্ত দপ্তরের থেকে আলাদা করে নেয়। সম্প্রতি ওয়েস্ট বেঙ্গল হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনকে তুলে দিয়ে পূর্ত দপ্তরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে প্রশাসনিক পর্যালোচনা সভায় মমতা ব্যানার্জি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সব সরকারি সংস্থার পৃথক অস্তিত্ব রাখার দরকার নেই। সংযুক্তির কথা শুনিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কোষাগারের খরচ কমাতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের হাতেই নির্মিত হয়েছিল হুগলীর চণ্ডীতলা-শিয়াখালা- চাঁপাডাঙা (রাজ্য সড়ক ১৫) রাজ্য সড়ক। ১৫৫ কোটি টাকা খরচ করে নতুনভাবে নির্মিত এই রাস্তায় গত ২০১৯সালে টোল প্লাজা তৈরি করে কর আদায়ের পরিকল্পনা নিয়েছিল স্টেট হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন। কিন্তু সেই প্রস্তাব সরাসরি ওই সময় প্রত্যাখান করেছিল রাজ্য সরকার।
পূর্ত দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নির্মিত সড়ক থেকে টোল আদায় করার মধ্য দিয়ে আয়ের পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হয়নি। রাজ্য সড়ক থেকে টোল আদায়ের জন্য নীতিও তৈরি করা হয়েছিল। সেই নীতি রাজ্য মন্ত্রীসভায় অনুমোদনও করা হয়েছিল। স্টেট হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের নির্মিত সড়কে তৈরি করা হয়েছিল টোল প্লাজাও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টোল আদায় থেকে পিছিয়ে আসে সরকার। ফলে এখন নির্মীয়মাণ টোল প্লাজা কার্যত কোনও টোল আদায় হয় না।
‘‘ ২০১৭ সালে মন্ত্রীসভার অনুমোদন পাওয়ার হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন টোল আদায়ের নীতি তৈরি করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর করা যায়নি। টোল আদায় না হওয়ার কারণে হাইওয়ে ডেভেলমেন্ট কর্পোরেশনের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যায়।’’ জানিয়েছেন এক আধিকারিক।
এখন চরম আর্থিক সঙ্কট দেখিয়ে ফের রাজ্য সড়ক থেকে টোল আদায় করার দিকে যাচ্ছে নবান্ন।
Toll Tax
আর্থিক সঙ্কটের বোঝা জনগণের ঘাড়ে
×
Comments :0