ইজরায়েলের দখলে থাকা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের একটি পাহাড়ি অঞ্চল হল বেথলেহেম। রুক্ষ, শুষ্ক পাহাড়ে শীতের কামড় বড় তীব্র। সেই তীব্রতা দূর করে উত্তাপ। সেই উত্তাপ জ্বালিয়ে রাখতেই বেথলেহেমের খ্রীষ্টান সম্প্রদায় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই বছর আড়ম্বরের সঙ্গে ক্রিসমাস পালন করা হলো না।
বেথলেহেমে ক্রিসমাসের জন্য পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়ে। দোকানে দোকানে বিক্রি হয় ‘সুভিন্যিওর’। কিন্তু গাজায় চলা গণহত্যার প্রতিবাদ হিসেবে এইবার ক্রিসমাস পালন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্যালেস্তিনীয় খ্রীষ্টানরা।
সেই অনুযায়ী বেথলেহেমের লুথেরান চার্চে ‘নেটিভিটি’ দৃশ্য বা যীশুর জন্মের দৃশ্য অন্যভাবে সাজানো হয়েছে। চিরাচরিত রীতি মেনে এইবার আস্তাবলে জন্মাননি যীশু। বরং তিনি শুয়ে রয়েছেন ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপে। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ধ্বংসের চিহ্ন। আর যীশুর পরণে রয়েছে কেফিয়ে। প্যালেস্তাইনের বিখ্যাত চেক কাটা কাপড়। যা বিশ্বজুড়ে প্যালেস্তিনীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
বেথলেহেমের প্যালেস্তিনীয় খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম উদ্যোক্তা মাজেদ ইশাক। তিনি জানাচ্ছেন, ‘‘এবারে ঠিক ছিল বিশাল বড় ক্রিসমাস ট্রি তৈরি করা হবে। পর্যটকদের ভিড়ের কথা মাথায় রেখে বেথলেহেমের ২টি জায়গায় লাগানোর কথা ছিল সেই গাছ। কিন্তু গাজায় যা হচ্ছে, তারপরে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই বছর ক্রিসমাসে উৎসব পালন করা হবে না।’’
বেথলেহেমের মাত্র ৭০ কিলোমিটার পশ্চিমে গাজা ভূখণ্ড। সেখানে এখনও চলছে অবিরাম বোমাবর্ষণ।
মাজেদ জানাচ্ছেন, ‘‘গাজায় আমাদের বহু পরিচিত আটকে রয়েছেন। কয়েকজন মারাও গিয়েছেন। আমাদের সম্প্রদায়ের বহু মানুষ গাজায় বসবাস করেন ঐতিহাসিক ভাবে। প্যালেস্তিনীয় মুসলমানরা কয়েক হাজার বছর ধরে আমাদের প্রতিবেশি। আমরা চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সংঘাত বন্ধ হোক।’’
১৯১৪ সালের ২৫ ডিসেম্বরও সাক্ষী ছিল এমনই এক উত্তাপের। বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্স যুদ্ধক্ষেত্রে নো ম্যানস ল্যান্ডের দুই প্রান্তে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন জার্মান এবং ব্রিটিশ সৈনিকরা। কিন্তু ২৫ ডিসেম্বর মাঝরাতে কোনও উপর মহলের পরোয়া না করেই যুদ্ধবিরতি চালু করেছিলেন সাধারণ সৈনিকরা। নো ম্যানস ল্যান্ডের বধ্যভূমি পেরিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন জার্মান এবং ব্রিটিশ সৈনিকরা। পালিত হয়েছিল বড়দিন। সামরিক ফ্লেয়ারের আলোয় খেলা হয়েছিল ফুটবল। বেয়নেট নামিয়ে রেখে প্রেমিকার ছবি, সিগারেট, কেক, চকোলেট আদানপ্রদান করেছিলেন ১৬-১৮ বছরের তরুণ থেকে শুরু করে ৪০-৫০ বছরের পোড় খাওয়া সৈনিকরা।
ফ্ল্যান্ডার্স ছাড়িয়ে গোটা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সৈনিকদের এই যুদ্ধবিরতি। ইস্টার্ন ফ্রন্টেও এই ঘটনা ঘটে। মহাযুদ্ধের ইতিহাসে এই ঘটনা ‘ক্রিসমাস ইন দ্যা ট্রেঞ্চেস’ এবং ‘ক্রিসমাস ট্রুস’ নামে পরিচিত।
শতাব্দী গড়িয়েছে। গাজায় এখনও চলছে যুদ্ধ। অলীক কল্পনায় পরিণত হয়েছে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা। ২০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৮হাজার শিশু। কিন্তু ইতিহাস হয়ে বর্তমান সাক্ষী, উগ্রতা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নয়। বরং বেয়োনেট নামিয়ে রেখে একে অপরকে আলিঙ্গন করাই মানবজাতির স্বাভাবিকতা।
গোটা বিশ্ব চেয়ে আছে, কবে সেই দৃশ্যের সাক্ষী থাকবে গাজাও।
Comments :0