রণদীপ মিত্র: সিউড়ি
‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’, দিকে দিকে গায়ের জোরে, লুটের বখরা ছড়িয়ে, ছাপ্পা মেরে ভোটে জেতা তৃণমূলীদের প্রতি এই উপমা অনুপযুক্ত নয় মোটেই।
তবে পানশ্বর হেমব্রম কিন্তু সেই দলে পড়েন না। করঞ্জাবুনীর ‘মাঝি হারাম’ এই পানশ্বর কিন্তু গাঁয়ের প্রকৃতই ‘মোড়ল’।
এলাকার আদিবাসী মানুষ যেমন তাঁদের সামাজিক রীতি মেনে পানশ্বরকে গাঁয়ের মোড়ল বেছেছেন, ঠিক একইভাবে লাল ঝান্ডার প্রার্থী হওয়া সেই পানশ্বরকেই ভোট দিয়েও করেছেন গাঁয়ের মেম্বার।
ঠিক একই রকম নজির রেখেছে আমডোলও। সেখানকারও ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ তকমা পেয়েছিলেন আব্দুল অদুত। যিনি মন্টু প্রধান নামেই বেশি ‘খ্যাত’। পঁচিশ বছরের মেম্বার, তিন-তিনবারের প্রধান এই আব্দুল অদুতকে উপড়ে ফেলেছেন এবার মানুষ।
রাজনগরের আদিবাসী প্রধান জনপদ নতুনগ্রাম, করঞ্জাবুনী, বেলবুনী, মাচানতলী। চার গ্রাম মিলে সংসদ একটাই। লড়াইয়ের মাটি। শহীদের রক্তে রাঙা তল্লাট ভোলেনি লড়াকু মেজাজ। এক সংসদ এলাকাতেই লাল ঝান্ডার হয়ে অকুতোভয় সংগ্রামে শামিল কুড়িজনের মাথায় ঝুলছে মিথ্যা মামলা। শাসক নিশ্চিত ছিল এবার থমকে যাবে লড়াইয়ের মেজাজ। হয়েছে উলটো। শহীদ নন্দলাল মিস্ত্রির রক্তে রাঙানো মাটি যে তার সাহস হারায়নি তার প্রমাণ পানশ্বরের জয়।
২০১৮’র ভোটের তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী ছিল এই জনপদ। মেরে ধরে মানুষকে বুথ থেকে বের করে দেওয়ার মতো নির্লজ্জ অত্যাচারের পথ নিয়েছিল শাসক দল। তাই নতুনগ্রাম থেকে করঞ্জাবুনী, বেলবুনী থেকে মাচানতলী - প্রস্তুতি নিয়েছিল আগাম। সামনে ছিলেন মোড়ল পানশ্বর। প্রচারের পথেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন,‘‘আমি নিজে শিকারী। ৩০০ মিটার তির এখনও ছুঁড়তে পারি। দরকারে গ্রাম বাঁচাতে ধরব তিরধনুক।’’
অদম্য সাহসিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন ‘মাঝি হারাম’। মানুষ পেয়েছিলেন ভরসা। তাই তো বিপক্ষে থাকা তৃণমূল প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এলাকার মানুষ। গোটা এলাকার মতো, পানশ্বর লড়েছিল গ্রাম বাঁচাতে। আর তৃণমূলের বাবুশ্বর লড়েছিল আখের গোছাতে। এই বাবুশ্বরকেই গ্রামের মানুষ দেখেছে ২০২১-এ গেরুয়া পতাকা হাতে গ্রাম দাপাতে। কিন্তু বেচাল হতেই ‘ঝাড়ফুঁক’ করা বাবুশ্বর সুযোগ বুঝে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তৃণমূলে। জবাবে মানুষ ছাপ দিয়েছে ব্যালটে।
ঠিক যেমন জবাব পেয়েছেন পাইকরের আমডোলের পঞ্চায়েতের তিনবারের প্রধান। পঁচিশ বছর ধরে পঞ্চায়েতে দাপট যাকে করে তুলেছিল একডাকে চেনা ‘মন্টু প্রধান’। পয়সার জোর, গলার জোর, গায়ের জোর - কোনোটাতেই তাকে টেক্কা দেওয়ার মতো ছিল না কেউ। কিন্তু মানুষের জোটের জোরের কাছে যে সব ফিকে তা প্রমাণ করে দিয়েছে মন্টু প্রধানের হার।
জিতেছে কে? লাল ঝান্ডার প্রার্থী। আমডোলের দর্জি সুকুর সাহানা। গায়ের মোড়ে সামান্য এক মনোহারি দোকান, তাতে বসেই জামাকাপড় সেলাই করেই দিনগুজরান সুকুরের। ভাই পরিযায়ী শ্রমিক। গোটা পরিবারের সুনাম রয়েছে এলাকায়। মানুষের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানো দর্জি সুকুরের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। লকডাউন তার প্রমাণ। ঘরেই রয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক। তাই পরিযায়ীর যন্ত্রণা তার থেকে আর কে ভাল বুঝবে? তাই করোনা কালে কাজ হারানো, প্রাণ হাতে দেশে ফেরা পরিযায়ীদের জন্য নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন সুকুর ভাইরা।
আর মন্টু প্রধান ক্ষমতা বলে কী কী করেছেন? আমডোল জুড়ে কান পাতলেই স্পষ্ট শোনা যায়, মন্টু প্রধানের ছেলে, ছেলেদের বউ, ভাই মিলে পরিবারের এহেন কোনও সদস্য নেই যাদের জব কার্ডে টাকা ঢোকেনি। ছেলেকে করে দিয়েছেন হার্ডওয়ারের দোকান। পঞ্চায়েতের ঠিকাদাররা পেয়েছেন নিদান, ‘ছেলের দোকান থেকেই নিতে হবে মাল’। যা হয়েছে মন্টু প্রধানের টাকার ভাণ্ডার গড়ার কারিগর। পাশাপাশি এলাকার বালি মাফিয়ারা তার একান্ত দোসর। বাহুবলের দাপটের দায়িত্ব ছিল তাদেরই হাতে। তারপরেও মন্টু প্রধানের দাপটের শেষ হয়েছে বাঁশলৈ নদীর পাড়ে।
এমন ভরাডুবির আরও নজির আছে বীরভূমে। যেমন নলহাটির কয়থা-১। অঞ্চলের শেষ কথা ছিল তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি সাইদুল ইসলাম। পঞ্চায়েতে প্রার্থী করেছিলেন ভাইয়ের বউকে। পঞ্চায়েত সমিতিতে করেছিলেন নিজের স্যাঙাত আব্দুল মোমিনকে। ভোট ঘোষণা হতেই চোখ রাঙানি আরও বেড়েছিল। স্রেফ এলাকা তটস্থ রাখতে। আব্দুল মোমিন শুধু সাইদুলের দোসর নয়, নলহাটির বিধায়কেরও বিশ্বস্ত স্যাঙাত। সেই আব্দুল মোমিনকে হারিয়ে দিয়েছেন সামান্য চাষবাস করা মীর বদরে আলম।
লাল ঝান্ডার একনিষ্ঠ সৈনিকই এলাকার মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন বেশি পছন্দের। কারণ চোখ রাঙিয়ে, দাপদাপানিতে গাঁয়ের মোড়লি করা মোমিন, সাইদুলদের জবাব দিতেই যে জোট বেঁধেছিল মল্লিকপাড়া, খাসপাড়া সহ গোটা তল্লাট।
তাই কুশকর্ণিকা পাড়ের করঞ্জাবুনী থেকে ব্রাহ্মণী পাড়ের কয়থা কিংবা বাঁশলৈর কোলে থাকা আমডোল প্রমাণ দিয়েছে মানুষের জোটই বাছেন প্রকৃত মোড়ল - সুকুর, পানেশ্বর, বদরে আলম তারই নমুনা।
Comments :0