Delhi rally

মেহনতীর প্লাবনে ডাক 'মোদী হটাও'

জাতীয়

Citu aiks aiawu workers peasent farmers unity bengali news

অরূপ সেনঃ দিল্লি

প্রত্যাশামতোই শ্রমজীবীর প্রবল অসন্তোষ আছড়ে পড়লো দিল্লিতে। কেন্দ্রের মসনদে আসীন মোদী সরকারের বুকে কাঁপন ধরিয়ে বুধবার রামলীলা ময়দান থেকে গর্জে উঠলো লক্ষাধিক শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরের সমাবেশ। এদিন সকাল থেকেই রাজধানীর রাজপথ ঢেকে গিয়েছিল হাজার হাজার লাল পতাকার সুশৃঙ্খল মিছিলে। 

সমাবেশমুখী জনস্রোতে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে কোহিমার খেটে-খাওয়া জনতা স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিলেন, কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক নীতি মোকাবিলায় এবার আরও জোরালো প্রতিরোধ। দেশজুড়ে লাগাতার জোটবদ্ধ লড়াইয়ে পর্যুদস্ত হবেই জনবিরোধী সরকার। রাজধানীর অভিজাত অঞ্চলের পাশাপাশি  মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের এলাকাগুলিও এদিন সাক্ষী থাকলো শ্রমজীবীর মুখরিত ‘মোদী হঠাও, দেশ বাঁচাও’ স্লোগানের। 

কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি সরকারের মানুষ-মারা পদক্ষেপের সোচ্চার বিরোধিতায় এদিন দিল্লির রামলীলা ময়দানে ‘মজদুর-কিষান সঙ্ঘর্ষ সমাবেশ’ ডাকা হয়েছিল। সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (সিআইটিইউ), সারা ভারত কৃষকসভা (এআইকেএস) এবং সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন (এআইএডবলিউএ)’র ডাকে এই যৌথ সমাবেশ দৃশ্যতই ঐতিহাসিক চেহারা নেয়। শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের অসংখ্য দৃশ্যপটের মাঝেই এদিন জোটবদ্ধ মেহনতির বলিষ্ঠ প্রত্যয়ও নজর কেড়েছে দিল্লিবাসীর। 

লাল পতাকা কাঁধে নিয়ে নিজেদের জীবন-যন্ত্রণার কথা জানাতে এদিন শিল্পাঞ্চলের মজদুরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাবেশে এসেছেন খেত-খামারের ‘অন্নদাতা’রা। সমাবেশে একদিকে যেমন এসেছিলেন হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, ছত্তিশগড়ের শ্রমজীবীরা, তেমনই ছিলেন জম্মু-কাশ্মীর, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাডু, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওডিশা, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ডের গ্রাম-শহরের খেটে-খাওয়া মানুষ। গত ছ’মাসের টানা প্রচার আন্দোলনের পরে এই সমাবেশে সমস্বরে ধ্বনিত হয়েছে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটি আক্রমণ প্রতিরোধের শপথ।

মেহনতি জনতার সংগ্রামী মেজাজে সংহতি জানিয়ে এদিন সকাল থেকে রামলীলা ময়দানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছে গণশিল্পীদের বিভিন্ন দল। তারপরেই নেতৃবৃন্দ তাঁদের ভাষণে স্পষ্ট জানিয়েছেন, জীবিকার অধিকার, সম্মানজনক জীবনমান, সন্তানদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে মোদী সরকারকে পর্যুদস্ত করা ছাড়া আর পথ নেই। তাই শ্রমজীবীর জোটবদ্ধ লড়াই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট ও দুর্দশা থেকে নজর ঘোরাতে শ্রমজীবীর মধ্যে বিভেদ-বিষ ছড়াতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি। ষড়যন্ত্রের এই জাল ছিন্নভিন্ন করেই বিজয় অর্জিত হবে, প্রত্যয় জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। 


সিআইটিইউ’র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কে হেমলতা ও তপন সেন, এআইকেএস’র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অশোক ধাওয়ালে ও বিজু কৃষ্ণাণ, এআইএডবলিউইউ’র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এ বিজয়রাঘবন ও বি ভেঙ্কটের পাশাপাশি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সর্বভারতীয় কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা, বিপ্লব মজুমদার, নিরাপদ সর্দার প্রমুখ। এদিন শ্রমিক-কর্মীদের ১২টি ফেডারেশন, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কর্মী, ব্যাঙ্ক, বীমা, বিএসএনএল শ্রমিক-কর্মী সংগঠনের ৩১ জন প্রতিনিধি সমাবেশে ভাষণ দেন।

কে হেমলতা বলেন, মোদী সরকার মেহনতির কথা শোনার সরকার নয়। এরা অতি-ধনীদের সম্পত্তি বৃদ্ধির জন্য নীতি নিচ্ছে। দেশে যখন মহামারীতে মানুষের সর্বনাশ হয়েছে তখনও বড় কর্পোরেটদের সম্পত্তি বহুগুণ বেড়ে গেছে। দেশে বেকারি বাড়ছে অথচ বড় বড় কোম্পানি লোক ছাঁটাই করে চলেছে। সরকার শ্রম কোড তৈরি করেছে। যাতে শ্রমিকরা নিজেদের সংগঠিত করতে না পারে, দর কষাককষি করতে না পারে। দেশে বিপুল সম্পদ রয়েছে, কিন্তু তা ধনীদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। মোদী সরকারকে হারাতেই হবে। গ্রামে গ্রামে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে।


অশোক ধাওয়ালে বলেন, দেশের ২৬-২৭টি রাজ্য থেকে শ্রমজীবী মানুষ এই সমাবেশে এসেছেন। মোদী সরকারের নামই সারা দেশে হয়ে গেছে ‘মোদানি’ সরকার। এদের কাজই হচ্ছে বড় পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করা। অথচ সব কৃষি-ফসলের দাম আজ পড়েই চলেছে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের জন্য মোদী সরকার কিছুই করছে না। উৎপাদনের খরচের দেড়গুণ দামে এই সহায়ক মূল্য দিতেই হবে। কর্পোরেটদের ১১ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব হয়েছে। কৃষকের ঋণ মকুব করা হবে না কেন? অরণ্যের অধিকার আদিবাসী কৃষকদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। রেগা নিয়ে কেলেঙ্কারি হচ্ছে। আমাদের দাবি, ২০০ দিনের কাজ দিতে হবে।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরে গান্ধীজী বলেছিলেন, ব্রিটিশ সরকারকে সংশোধিত করা যাবে না, তার অবসান ঘটানোই একমাত্র পথ। আজ যখন মহামারীতে চিকিৎসা না পেয়ে লক্ষ ভারতীয় মারা গিয়েছেন, ঋণভারে ও অনাহারে লক্ষ লক্ষ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন তখন লাল ঝান্ডার এই সমাবেশ ঘোষণা করছে, ‘মোদী সরকারকে সংশোধন করা যাবে না, এর অবসান ঘটাতেই হবে।’ এই সরকার স্বাধীনতার পরে সবচেয়ে কর্পোরেটমুখী, সবচেয়ে সাম্প্রদায়িক, সবচেয়ে শ্রমজীবী বিরোধী সরকার। এই শয়তান সরকারকে পরাস্ত করার আহ্বান নিয়েই আমরা ফিরে যাব।  

এ বিজয়রাঘবন বলেন, মোদী সরকারে সামনে মন্ত্রীরা বসে আছেন, পিছনে রয়েছে আরএসএস। জনগণের জীবন-জীবিকার ওপরে লাগাতার আক্রমণ চলছে। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত মানুষ এখন ভারতে থাকেন। তরুণদের হাতে কোনও কাজ নেই। নরেন্দ্র ভোটে জেতার আগে বলেছিলেন, বছরে ২ কোটি লোককে কাজ দেব। এখন যত রোজগার ২ জনের! গরিব মানুষের ঐক্য ভাঙার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই সরকার। এই সরকার গণতন্ত্র ধ্বংসের সরকার। বিজয়রাঘবন কেরালা সরকারের বিকল্প নীতির কথা তুলে ধরে বলেন, সেখানে ভূমিহীন জমি পাচ্ছেন, ঘরহীন মানুষ আবাস পাচ্ছেন। 

বিজু কৃষ্ণাণ বলেন, এক লক্ষের বেশি কৃষক, আড়াই লক্ষ দিনমজুর গত কয়েক বছরে আত্মঘাতী হয়েছেন। কৃষির উৎপাদন খরচ বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কৃষক-খেতমজুর দেনার দায়ে ডুবে যাচ্ছেন। শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর লাগাতার লড়াই করে যাচ্ছেন। একসঙ্গেও লড়াই হয়েছে। তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ৩৮০ দিনের আন্দোলনে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শ্রমিকরাও। দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁরা লড়াই করেছেন, সরকার যতদিন না কালা কানুন ফিরিয়ে নিয়েছে তাঁরা বাড়ি যাননি। শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করতে সরকার চারটি শ্রম কোড এনেছে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সামনে এখনও তা চালু করার সাহস পায়নি। ঐক্য জরুরি, বিভেদনীতিকে পরাস্ত করেই বিকল্প নীতি সামনে তুলে ধরা সম্ভব। ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনে আম্বানি-আদানিদের সরকারকে হারাতেই হবে। 

বি ভেঙ্কট বলেন, আম্বানি-আদানি এক ডাবল ইঞ্জিন, মোদী-শাহ এক ডাবল ইঞ্জিন। আমরা এখানে ট্রিপল ইঞ্জিন— শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর। মোদী সরকার রেগা’র কাজে টাকা ছাঁটাই করেছে। খাদ্য নিরাপত্তায় ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাঁটাই হয়েছে এবারের বাজেটে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য কর্মসংস্থানে অর্থ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যারা এখানে এসেছি তারা দেশের উৎপাদক শ্রেণি। কোভিডের সময়ে খাদ্য উৎপাদন ছিল ২৮ কোটি টন, এখন তা ৩১ কোটি টন। এই বৃদ্ধি কৃষক, খেতমজুরদের জন্য। মোদী সরকার গণবণ্টনের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে। গ্রামীণ গরিব, কৃষক, খেতমজুরদের বড় অংশই তফসিলি জাতি-আদিবাসী। তাঁদের অবস্থা শোচনীয় হচ্ছে। কেন্দ্রের রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে দলিতদের ওপর আক্রমণ বাড়ছে। কর্মসংস্থানে তফসিলিদের অংশ কমিয়ে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার।  


এই সমাবেশের জন্য গঠিত অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক বলেন, এই তিন শ্রেণি যে এখানে উপস্থিত হয়ে নিজেদের দাবি সোচ্চারে তুলছে, এটাই মোদী সরকারের এক পরাজয়। সরকার চায় সাম্প্রদায়িক বিষয় তুলে এই শ্রমজীবীদের ভাগ করে রাখতে। এই তিন শ্রেণির উপরে নয়া উদারনীতির হামলা চলছে দীর্ঘদিন। এর বিকল্প নীতি সম্ভব। যদি আমাদের দেশের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের ওপরে ২ শতাংশ সম্পদ কর বসানো হয়, তাহলে সব ভারতবাসীকে পাঁচ অধিকার দেওয়া যায়। সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা, বিনামূল্যে শিক্ষা, বিনামূল্যে চিকিৎসা, কম দামে আনাজ, বিপুল অংশের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। এখানে এই তিন শ্রেণির মানুষ যে দাবি তুলছেন তা-ই দেশের দাবি। 


সভার শেষ বক্তা হিসাবে সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন বলেন, যে উদ্দীপনা নিয়ে আপনারা এখানে এসেছেন, সেই উদ্দীপনা নিয়েই ভূমিস্তরে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দেশে পরিবর্তন চাই কিন্তু কোন পথে সে পরিবর্তন হবে তা শ্রমিক-কৃষক স্থির করবে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কতটা আক্রমণাত্মক হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে, তার ওপরেই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।

মোদী সরকার লাভজনক চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ বিক্রির যে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে, তা প্রতিরোধের শপথে সংস্থার কর্মী ইউনিয়নের সভাপতি রাজীব গুপ্ত এদিন তপন সেনের হাতে একটি স্মারকলিপি তুলে দেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment