কলকাতা কর্পোরেশনে বসে শুক্রবার ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, প্লেটলেটের সংখ্যা ৪০ হাজারের নীচে নামলেই ডেঙ্গু আক্রান্তকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। রোগীকে বেশি করে জল খাওয়াতে হবে। এটাই ডেঙ্গুর একমাত্র চিকিৎসা। যদিও বাস্তবের সঙ্গে মেয়রের বক্তব্যের কোনও মিলই নেই। নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এমনটাই জেনেছেন হালতুর ১৪ বছরের কিশোরী ভার্গবী মন্ডলের পরিবার।
বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায় ভার্গবী। পরিবারের অভিযোগ, রবিবার ডেঙ্গু ধরা পড়ে ভার্গবীর। তাঁকে সেদিনই এমআর বাঙ্গুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে বেড ছিল না। তাই ভার্গবীকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন তাঁর পরিজনরা।
এরপর সোমবার সকালে কোনওক্রমে একটি বেড জোগাড় করে ভার্গবীকে ওই হাসপাতালেই ভর্তি করানো হয়। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে শুরু করেছে। বুধবার মারা যায় ভার্গবী। ভার্গবীর প্রতিবেশীদের প্রশ্ন, এক্ষেত্রে সময় মতোই প্লেটলেট পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে বেডের অভাবে মেয়েটাকে বাঁচানো যায় নি। এলাকাবাসীর প্রশ্ন, সাধারণ মানুষের উপর সমস্ত দায় কীভাবে চাপাতে পারেন মেয়র?
কিন্তু কলকাতার মেয়র ঠিক সেই কাজটাই করে চলেছেন। ২০২০-২১ সালে কোভিড বৃদ্ধির জন্য তিনি শহরবাসীকে দায়ী করেছিলেন। ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে ডেঙ্গু সমস্যার জন্যও নাগরিকদেরই দায়ী করেছেন ফিরহাদ।
শুক্রবার দুপুর ১টা থেকে কলকাতা কর্পোরেশনের মূল ভবনে ‘টক টু মেয়র’ কর্মসূচি চলাকালীন একাধিক বার ডেঙ্গু সমস্যার জন্য নাগরিক সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করেছেন মেয়র। ‘টক টু মেয়র’ শেষে সাংবাদিক সম্মেলনেও একই সুর বজায় রাখেন ফিরহাদ।
এদিন ‘টক টু মেয়রে’ ফিরহাদ বলেন, ‘‘ডেঙ্গুর প্লেটলেট পরীক্ষা না করালে কি আমি কাউকে জেলে পাঠাতে পারি? ডেঙ্গু হলে কি একা আমাদের দোষ? ফাঁকা মাঠে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। কিন্তু কারা ফেলছে আমরা ধরতে পারছি না। পাড়ার লোককে সচেতন হতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। পাটুলিতে সরকার থেকে জমি পেয়েছে। সেই জমিগুলি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। কেএমডিএ, পিডাব্লিউডি’র হাউজিং এর জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। খেয়াদহ পঞ্চায়েতে নগরায়ণ হচ্ছে। বহু বাড়ি ঢালাই হয়ে পড়ে রয়েছে। সেখানের জমা জলে মশা বাড়ছে।’’
মেয়রের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, নাগরিক পরিষেবার ঘাটতির ফলেই সমস্যাগুলি তৈরি হচ্ছে। তিনি এক প্রকার স্বীকার করে নিয়েছেন, কর্পোরেশন নিয়মিত নজরদারি করে উঠতে পারছে না। তা নইলে কোথায় জঞ্জাল পড়ে রয়েছে, তা কেন জানতে পারছে না কর্পোরেশন। কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ সদস্য অতীন ঘোষ। তিনি কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়রও বটে। অতীন ঘোষ একাধিকবার জানান, বাড়িতে জঞ্জাল ফেলে রাখলে কর্পোরেশন চিঠি পাঠিয়ে জরিমানা করবে। কিন্তু এখনও কত জরিমানা হল, কত চিঠি পাঠানো হল, তার কোনও উত্তর কর্পোরেশনের কাছে নেই।
কর্পোরেশনের আধিকারিক এবং শ্রমিকরা জানাচ্ছেন, কর্মী সঙ্কটে জেরবার দশা তাঁদের। কর্পোরেশনে সব মিলিয়ে ৩০ হাজারের কাছে শুন্যপদ। তারফলেই নজরদারির করা হয়ে উঠছে না। কিন্তু সমস্যার গোড়ায় না গিয়ে নাগরিকদের দায়ী করেই ক্ষান্ত মেয়র।
কর্পোরেশনের গাফিলতির পাশাপাশি কাউন্সিলররাও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। এমন অভিযোগও উঠে আসছে শহরের প্রায় প্রতিটি প্রান্ত থেকে। ঘটনাচক্রে শহরের ৯৯ শতাংশ কাউন্সিলরই তৃণমূলের প্রতীকে নির্বাচিত। ভার্গবীর বাড়ি কর্পোরেশনের ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডে। গত সেপ্টেম্বর মাসে এই ওয়ার্ডে মৌমিতা মুখার্জি এবং অনুরাগ মালাকার নামে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। পূর্বাচল এবং খালপাড় অঞ্চলের বহু বাড়িতে ডেঙ্গু আক্রান্তের হদিস মিলেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ডেঙ্গু ঠেকাতে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলরের কাছে বহুবার আবেদন করা হয়। কিন্তু তিনি পুজো নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন । অভিযোগ, বছর জুড়ে ওয়ার্ডে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো বা মশা মারার তেল দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করেনি কর্পোরেশন।
Comments :0