কলতান দাশগুপ্ত
"...কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়?" কাজের জন্য হন্যে হয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়া এই বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন করোনা কালে অন্য কোনও উপায় না পেয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন তখন নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন তাদের কেউ করেনি। এখন তো আবার দেশের নামে কোনও প্রশ্ন করা অপরাধ! তবুও জিজ্ঞেস করার বড় শখ হয় যে স্বাধীনতার পর ছিয়াত্তর বছর ধরে গোটা দেশের মানুষ যেই অবিরাম পথ হাঁটলাম... কি পেলাম? যত পথ হাঁটছি ততই চারপাশে গরিব আর বড়লোকের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে, যত পথ হাঁটছি ততই বেকার আর স্থায়ী চাকরির দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে, যত পথ হাঁটছি ততই বাজারের ব্যাগের সাথে চাল,ডাল,তেলের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। যোগ্য চাকরিপ্রার্থী, মেধা আছে, সার্টিফিকেট আছে, তবু হকের চাকরি না পেতে পেতে বয়স পেরিয়ে যাওয়ার অবস্থায় রাস্তায় বসে রয়েছে ৯৫০ দিন ধরে। যন্ত্রণা আছে, কিন্তু থামার কোনও জায়গা নেই এ জীবনে। "...রুখ জানা নেহি তু কভি হার কে"!
যে পথ দিয়ে হেঁটে আমার আগের প্রজন্মের যৌবন ব্রিটিশ সূর্যকে অস্তমিত করার ক্ষমতা দেখিয়েছিল, যে পথ দিয়ে হেঁটে আমার আগের প্রজন্মের যৌবন দাঙ্গাবাজদের রুখে দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিল সেইপথে আমরা আবার নেমেছি ইনসাফ চাইতে। ওই পথের প্রতিটা বাঁকে বাঁকে ক্ষুদিরাম, বিনয়-বাদল-দীনেশ, কল্পনা দত্ত, মুজফ্ফর আহ্মদ, মাস্টারদা, আশফাকুল্লাহ, রামপ্রসাদ বিসমিল সহ আরো অনেকে নিজের জীবন যৌবন বাজি রেখে শাসকের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে লড়ে গিয়েছিলেন। সেই লড়াইয়ের মশাল আজ আমাদের হাতে। হাতে স্থায়ী কাজ না পাওয়ার কথা নিয়ে আমরা যখন সোচ্চার হই, রাস্তায় ভেঙে, উপড়ে নিশ্চিহ্ন করে দিই রাষ্ট্রের পলকা ব্যারিকেড ঠিক তখনই রাষ্ট্র ঠিক করে নেয় এই যৌবনকে ভাগের অঙ্কে গুলিয়ে দিতে হবে। সুদীপ্ত কলেজ ক্যাম্পাসে সবার স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার চেয়ে ছিল। মইদুল তার সংসারের একমাত্র রোজগেরে, রোজগার বন্ধ করে কলকাতায় এসেছিল সবার হাতে কাজ দেওয়ার দাবিতে। আনিস চেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি যাতে তৃণমূলী মাফিয়াদের হাতে বেহাত না হয়ে যায়। খুবই ন্যূনতম বুনিয়াদী চাহিদা। কিন্তু রাষ্ট্র মনে করেছিল চাহিদা তো পূরণ হবেই না বরং এই দাবি তোলার জন্য শাস্তি হিসেবে এদের শহীদ হতে হবে। রাষ্ট্র খুব বোকা; ভেবেছিল এদেরকে শাস্তি দিয়ে বাকিদের বোধহয় চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু রাষ্ট্র এখনো এদেশের এই বাংলার যৌবনের স্পর্ধা টের পায়নি। আমরা, এই বাংলার যুবরা যন্ত্রণার বিরুদ্ধে ইনসাফের লড়াইতে রাষ্ট্রকে সরাসরি রাস্তায় নামতে চ্যালেঞ্জ করছি।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ অনুযায়ী দেশে এখন অমৃত কাল চলছে। ১৪ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বক্তৃতায় দেশের উন্নতির বিষয়ে যতগুলো কথা বলেছেন তার কোনটাই আজ পর্যন্ত দিনের আলো দেখেনি। যদি ওনার কথামতো দেশ অর্থনৈতিক উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছতো তাহলে দেশের বেকারদের এত যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হতো না। মোদী লোকসভায় গেলে জানতে পারতেন যে তার সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারি বিভিন্ন চাকরির আবেদনপত্র জমা পড়েছে ২২ কোটি, কিন্তু নিযুক্ত হয়েছেন মাত্র ৭.২ লক্ষ। ২০২১-২২ সালে ১ কোটি ৮৬ লক্ষ আবেদনকারীর মধ্যে নিযুক্ত হয়েছেন মাত্র ৩৮ হাজার ৮৫০ জন। স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে এদেশের তরুণ সমাজের জন্য এত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি কখনো ছিল না। বেকারত্ব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২২ সালে ভারতবর্ষে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের তরুণ অংশের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩.২২ শতাংশ। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে একই সময়ে বেকারত্বের হার ১১.৩ শতাংশ, বাংলাদেশে ১২.৯ শতাংশ এবং ভুটানে ১৪.৪ শতাংশ। ক্ষমতায় আসার পর থেকে কখনো মেক ইন ইন্ডিয়া কখনো প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা বা কখনো পিএম বিশ্বকর্মা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে নানান প্রকল্প চালু করে দেশের যুবদের জন্য অনেক কাজ করার দাবি করেছিলেন মোদী। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য সম্প্রতি সামনে আসায় মোদীর মিথ্যার ফানুস চুপসে গিয়েছে।
২০১৪ সালে ভোটে লড়ার সময় মোদী ঘোষণা করেছিলেন প্রতি বছর ২ কোটি বেকারের চাকরি হবে। এ রাজ্যেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে ভোটে লড়ার সময় ঘোষণা করেছিলেন প্রতি বছর ২ লাখ বেকারের চাকরি হবে। এদের ঘোষণাপত্র আসলে পুরো ঢপ সেটা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এর ফল হিসেবে বেকারের মজুদ বাহিনী বাড়ছে। একাউন্টেন্সিতে মাস্টার ডিগ্রি করা মেয়েটি কোনও কাজের জায়গায় ন্যূনতম ১২-১৫ হাজার টাকা মাইনে দাবি করতে পারছে না কারণ তার পিছনে হাজার হাজার যোগ্য বেকার ওই একই কাজ তার অর্ধেক মজুরিতে করে দিতে রাজি আছে। মালিক শ্রেণিও চায় যে বেকারের সংখ্যা বাড়ুক। তাহলেই ১২-১৫ হাজার টাকার চাকরি অতি সহজে ৫,০০০ টাকায় করিয়ে নেওয়া যাবে। এই যন্ত্রণা আড়াল করতে ভাষ্য তৈরি করা হচ্ছে— হিন্দু যুবকের চাকরি না পাওয়ার কারণ মুসলমান যুবক, উঁচু জাতের পরিবারের সন্তানের কম খরচে লেখাপড়া না পাওয়ার কারণ এসসি/এসটি-দের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার অধিকার। সুস্থ পরিবেশে মাথায় একটা পোক্ত ছাদ না পাওয়ার কারণ অন্য জাতির জমির অধিকার, মেয়েদের সম্মান হারানোর কারণ মেয়েদের প্রগতিশীল হওয়া- এইসব সারবত্তাহীন কারণ!
শহরের দিকে কাজ না পাওয়ায় কম মজুরিতে রেগায় কাজের চাহিদা বাড়ছে। কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের তথ্য থেকে আমরা জানতে পারছি যে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট এই পাঁচ মাসে রেগায় কাজের জন্য নাম নথিভুক্ত করেছেন ১৭.১০ কোটি মানুষ। ১৯২০-২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪.৪০ কোটি। করোনা মহামারীর সময় কলকারখানা বন্ধ থাকার ফলে রেগায় নাম নথিভূক্ত করার উৎসাহ অনেক বেড়েছিল। আবার স্বাভাবিক নিয়মেই লকডাউন উঠে গেলে এই উৎসাহে খানিক ভাটা পড়েছিল। কিন্তু চলতি বছরে দেখা যাচ্ছে এই নাম নথিভুক্তির সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। গতবছর রেগায় কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ ছিল ৮৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। চলতি বছরে বাজেট বরাদ্দ ৬০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ টাকা বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন কাজের ক্ষেত্রে যেখানে দেশের গরিব অংশের যুবরা যুক্ত।
বাংলার যুবসমাজ এখন জোড়া আক্রমণের সামনে। একদিকে তৃণমূলের সৌজন্যে সিঙ্গুর, শালবনী, হলদিয়া, রঘুনাথপুর, কাটোয়া, চকচকা সহ সারা রাজ্যের কর্মসংস্থানের ধ্বংসের ছবি আজ সকলের সামনে স্পষ্ট। অন্যদিকে বিজেপি গোটা দেশের শিল্পসম্ভাবনা কে পরিকল্পনা মাফিক ধ্বংস করছে । বিএসএনএলের প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো ব্যবহার করে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা মোবাইলে ৫জি পরিষেবা দিতে পারছে অথচ শুধু বিএসএনএলের অধিকার নেই ৫জি পরিষেবা দেওয়ার। আক্রমণ শুধু বিএসএনএল’এ সীমাবদ্ধ নয়। চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস, অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট, ব্রিজ অ্যান্ড রুফ, বেঙ্গল কেমিক্যালের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বন্ধ করার ফতোয়া দিয়েছে নতুন বিজেপি সরকার। করোনা মহামারীর সময় প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক ওষুধ অত্যন্ত সফলভাবে তৈরি ও বিপণন করতে পেরেছিল বেঙ্গল কেমিক্যালস। এইরকম একটি সংস্থাকে পুনরুজ্জীবন না ঘটিয়ে বিজেপি দেশের যুবদের সাথে প্রতারণা করছে, একইসাথে তৃণমূল এই বেঙ্গল কেমিক্যালের জমি সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিচ্ছে ব্যবসা করার জন্য। রেলের মতো ব্যাপক কর্মসংস্থানমুখী রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রও আজকে তীব্র আক্রমণের মুখে। সমগ্র রেলের পরিষেবা ক্ষেত্রকে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর মোদী। রেলের কর্মচারীদের নির্দিষ্ট সময়ের আগে বাধ্য করা হচ্ছে অবসর নিতে। অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ পদ শূন্য। ২০১৯ সালের পর থেকে স্থায়ী নিয়োগ হয়নি রেলে। একই লোক কে দিয়ে একাধিক কাজ করানোর প্রবণতা বাড়ছে। ফলে বিপদ ও বাড়ছে। প্রতিরক্ষা শিল্পকেও বেসরকারি হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর মোদী সরকার। গোটা দেশ জুড়ে শ্রমিকদের মজুরি কমছে, অধিকার ধারাবাহিক ভাবে খর্ব হচ্ছে । পুরনো শ্রম আইন পরিবর্তন করে পুঁজিপতি গোষ্ঠীর সুবিধার্থে তৈরি হয়েছে 'শ্রমকোড'। শ্রমিকদের দরকষাকষির সুযোগ তলানিতে। অথচ এই সময়ে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের মুনাফা বেড়েছে বহুগুণ। ‘ইকনমিক টাইমস’(২২ মার্চ, 2023)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত দশ বছরে মুকেশ আম্বানির মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ, আর গৌতম আদানির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১২২৫ শতাংশ। কেন্দ্রের সরকার ২০২০-২১ সালের বাজেটে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা সংস্থান করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বিক্রি করে। "জাতীয় নগদিকরণ পাইপ লাইনে' ৬ লক্ষ কোটি টাকা অর্থসংস্থান করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সরকারি জমি, রেললাইন, স্টেশন, বন্দর, বিমানবন্দর, জ্বালানিবাহী পাইপলাইন এবং অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সম্পদ বিক্রি করে। আর এইসব সম্পদ আত্মসাৎ করছে আদানি, আম্বানির মতো মুষ্টিমেয় বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠী। তাছাড়া ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ এই আট বছরে করপোরেটের অনাদায়ী ঋণ মকুবের মাধ্যমে লোপাট হয়েছে ব্যাংকের ১২ লক্ষ কোটি টাকা। সমস্ত কিছু বেসরকারিকরণ করে দেওয়ার ফলে এই প্রজন্মের একটা বড় অংশ স্থায়ী সরকারি চাকরির ভাবনা ভাবতে পারেনা। পিএফ, গ্রাচুইটি, পেনশন কি... এই প্রজন্মের একটা বড় অংশ জানেনা।
ক্রমাগত কমতে থাকার রোজগারের ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ তলানিতে ঠেকছে। মানুষের খরচের হার কমায় ভোগ্যপণ্য শিল্প এবং ক্ষুদ্র শিল্পের করুণ হাল দেশে। এর সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য কর্মী এক ভয়াবহ আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। অর্থনীতির এই মন্দার ভয়াবহ জের পড়েছে কৃষি এবং কৃষকের উপর। বীজ, সার, কীটনাশকের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে কৃষি আর লাভজনক পেশা থাকছে না। বৃহৎ পুঁজি বাজারে আসার ফলে ছোট কৃষক, খেতমজুররা কর্মহীন। ফসলের ন্যায্য দাম দিচ্ছে না সরকার। কিসান মান্ডি গুলো কার্যত গরিব কৃষককে কোনও সাহায্য করতে পারছে না।পরিণতিতে আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে বহু মানুষ। আমাদের রাজ্যে নিজেদের এলাকা ছেড়ে দলে দলে যুব, পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিনরাজ্যে ছুটছে। দলে দলে লোক ভিড় করছেন শহরে। শহরেও একটা চাকরিতে জীবন চলছেনা বহু মানুষের। সকালে চাকরিতে যাওয়ার আগে বা সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে বাইক ট্যাক্সির কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। বাইক বা গাড়িতে করে খাবার বা অন্যান্য জিনিসপত্র বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন শহরের বেশ কিছু যুবক যুবতী। এই নতুন ধরনের কাজে, যেখানে জীবনের ঝুঁকি আছে, সেখানে নিরাপত্তার নুন্যতম ব্যবস্থা রাখেনি রাষ্ট্র।
এসএসসি, পিএসসি, কলেজ সার্ভিস কমিশন, প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরির স্বপ্ন দেখা প্রতারিত যুবদের ক্ষোভ প্রতিদিন কোথাও না কোথাও আছড়ে পড়ছে এই শহরের বুকে। হাসপাতালের নার্স, স্কুলের প্যারাটিচার, এসএসকে, এমএসকে শিক্ষকরা তাঁদের হকের দাবিতে রাজপথে প্রতিদিন আলোড়ন তুলছে। পুলিশ আঁচড়ে,কামড়ে নির্মমভাবে তাঁদের আন্দোলন দমন করছে। চাকরির দাবিতে কলকাতার রাজপথে লড়তে এসে খুন হতে হচ্ছে মইদুলদের। ১০০ দিনের কাজ যারা করলেন তাদের বকেয়া বেতনের পরিমাণ ২,০০০ থেকে ২০,০০০ অবধি। পঞ্চায়েতে টাকা নেই কারণ তৃণমূল নেতারা ওই টাকা হজম করে পেল্লায় বাড়ি, গাড়ি হাঁকিয়েছেন। সরকারি চাকরির জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়েছেন তৃণমূল নেতারা। তারপরে বাঁচার জন্য হয় বিজেপিকে মিসকল দিচ্ছেন নয়তো বা ফোন ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন ডোবায়।বাংলায় শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরা যে দুর্নীতিতন্ত্র তৈরি করেছেন তা অভাবনীয়। নিয়োগ দুর্নীতি সহ অন্যান্য দুর্নীতিতে মোট কত লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে তার এখনো পর্যন্ত যথাযথ হিসেব হয়নি। আদালতের নির্দেশে ইডি বা সিবিআই তদন্ত কোনও আশা দেখাতে পারছে না বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে সেটিং এর ভাবনা প্রকট হয়ে উঠছে। রাজ্যে একটার পর একটা কলকারখানায় প্রতিদিন তালা ঝুলছে। নতুন শিল্প স্থাপনের ন্যূনতম কোনও উদ্যোগ নেই। এলাকা উজাড় করে ভিন রাজ্যে ছুটতে হচ্ছে কাজের জন্য, কিছু কিছু এলাকায় গ্রাম কার্যত যৌবনশূন্য। কলেজ ক্যাম্পাসে তোলাবাজদের দাপটে অনার্স-পাশের সিট লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কলেজে প্রতিবাদ করার মতো কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই নেই। ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ। স্কুল-কলেজে পড়াশোনার খরচ প্রতিদিন লাগামছাড়াভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যত কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই। কেন্দ্রীয় সরকার নীতির অন্ধ অনুসরণ করে এই রাজ্যেও জাতীয় শিক্ষানীতি চালু হয়ে গেল। পড়াশোনার অধিকার থেকে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের দূরে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করা হলো। মগজের দখল নেওয়ার জন্য নতুন করে সাজানো ইতিহাস পড়ানোর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করল রাষ্ট্র। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর ইতিহাস বইতে ইচ্ছাকৃতভাবে বদল ঘটানো হচ্ছে। কোথাও টিপু সুলতানের বীরত্বের কাহিনি মুছে দেওয়া হচ্ছে, কোথাও বা বাদ পড়ছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
"হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়, চীন —
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।
পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।" এই ভাবনা হজম করে নেওয়া আরএসএসের পক্ষে মুশকিল। বাংলায় আবার ছাত্রছাত্রীরা যে বই পড়ছে তাতে কোনও এক আন্দোলনের নেতা হিসাবে যার কথা উল্লেখ আছে, তিনি আজ নিয়োগ দূর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন।জেলে বসে সেই নেতার মাইনেও ৪০ হাজার টাকা বেড়ে গেল অথচ আইসিডিএস সেন্টারে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোকে একটা ডিম সেদ্ধ খাওয়ানো যাচ্ছে না কারণ সরকার বলছে পয়সা নেই। কয়েক হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাংলায়। নবম শ্রেণিতে নথিভূক্ত হলেন যতজন, তার থেকে ২ লাখ ছাত্র ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলেন না। কোথায় গেলো এই বিপুল সংখ্যক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রাষ্ট্র জানে না।
দেশের করপোরেট মিডিয়া অভাবনীয় ভাবে হিন্দুত্বের মতাদর্শ ও রাজনীতির পক্ষে ধারাবাহিক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। হিন্দুত্ব একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। দেশের মানুষের চিন্তার মধ্যে ঘৃণার সঞ্চার তৈরি করা এর কাজ । রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের নানা বন্দোবস্ত দেশজুড়ে জারি করা হয়েছে। এই প্রকল্পে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ এবং তার ভিত্তিতে প্রকাশ্য আচরণ যে সামাজিক সম্মতি আদায় করছে তা তৈরি করছে নয়া ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। এই ফ্যাসিবাদ কায়েম করাতে বিজেপির যোগ্য দোসর তৃণমূল। গত ১১ বছর ধরে এ রাজ্যে আরএসএস খোলা মাঠ পেয়েছে নোংরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাষ করার। তৃণমূল ভাগাভাগির খেলায় নেমে এনআরসি সিএএ- এর জুজু দেখিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট পরোক্ষভাবে কার্যত লুট করেছে। এই বাংলায় তো সাম্প্রদায়িক হানাহানি ছিল না। এই বাংলায় তো ধর্মের নামে জাতের নামে ভাগের রাজনীতি ছিল না। চোর, চিটিংবাজ, দাঙ্গাবাজরা নিজেদের স্বার্থে এই বাংলার শান্তি নষ্ট করেছে। যারা চাকরি চুরি করে আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল এই ইনসাফ পদযাত্রা তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। যারা আমাদের ধর্মের নামে জাতের নামে ভাগ করে হিংসার চাষ করেছিল এই ইনসাফ পদযাত্রা তাদের ঘরে ফসল তুলতে দেবে না। ভুল ইস্যুর বিরুদ্ধে মূল ইস্যুর লড়াই লড়বে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপের নব যৌবন। পশ্চিমবাংলার উত্তর অংশ থেকে যন্ত্রণার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে যৌবনের ডাকে আমরা সকলে ব্রিগেডের মাঠে পৌঁছাব। ব্রিগেডের মাঠে আসবে লাখো পরিযায়ী শ্রমিক, আসবে লাখো বেকার ছেলেমেয়ে তাদের সবার হাতে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের জানকবুল লড়াই লড়তে।
"...তাই এখন ক্লান্ত হওয়ার সময় নয়
তাই এখন আকাশ ছোঁয়ার দিনকাল!"
Comments :0