Electoral Bonds

বন্ডে গেছে কোটি টাকা, দাম বেড়েছে দুধের

রাজ্য

নির্বাচনী বন্ডের মধ্য দিয়ে ঢুকেছে কোটি কোটি টাকা। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুধের দামও। 
২০১৯ সালে হাফ লিটার ডাবল টোনড দুধের এক প্যাকেটের দাম ছিল ৩৮ টাকা। সেই দুধের প্যাকেটই এখন মেট্রো ডেয়ারি বিক্রি করছে ৪৮ টাকায়। চার বছরের মধ্যে ২৬ শতাংশ বেড়েছে শুধু ডাবল টোনড দুধের প্যাকেট। 
এরাজ্যে মানুষের কাছে পরিচিত গোরুর দুধ প্যাকেটজাত করে বিক্রি হতো হাফ লিটার ৪৪ টাকায়। হাফ লিটার সেই দুধ চার বছরের মাথায় বেড়ে হয়েছে ৫৬ টাকা। এক ধাক্কায় প্যাকেটে বেড়েছে ১২ টাকা। ২৭ শতাংশ দাম বেড়েছে ‘কাউ মিল্ক’-এর। প্রিমিয়াম মিল্ক ৪৬ টাকা থেকে বেড়ে এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে হাফ লিটার ৬০ টাকায়। চার বছরে ৩০ শতাংশ বেড়েছে এই দুধের প্যাকেটের দাম। 
এরাজ্যে এখন দুধের দামের ওপর সরকারের আর কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই। রাজ্যের সরকারি দুধের কারখানাকে রুগ্‌ণ করে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে দুধের বাজারকে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে দুধের দাম। রাজ্যের প্রায় সমস্ত বেসরকারি দুধ উৎপাদনকারীরাও বাড়িয়ে দিয়েছে দুধের দাম। যার অবধারিত ফল ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
আগে সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল মেট্রো ডেয়ারি ও মাদার ডেয়ারি। কিন্তু মেট্রো ডেয়ারির শেয়ার নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয় তৃণমূল সরকার। এখন মেট্রো ডেয়ারির মালিকানা চলে গেছে বেসরকারি সংস্থার হাতে। এমকেজে এন্টারপ্রাইস কোম্পানি মমতা ব্যানার্জির দলকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৪৫ কোটি টাকা দিয়েছে। ওই গোষ্ঠীরই কেভেন্টার অ্যাগ্রো থেকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসে এসেছে ২০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে জালান গোষ্ঠীর নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্তির পরিমাণ ৬৫ কোটি টাকারও বেশি। 
ঘটনা হলো, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালে কেভেন্টার গ্রুপ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। যদিও এর সিংহভাগই গেছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন শাসক দল বিজেপি’র দলীয় তহবিলে। কেভেন্টার ফুড পার্ক ইনফ্রা লিমিটেড কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ১৯৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। এমকেজে এন্টারপ্রাইজেস কোম্পানি নির্বাচনী বন্ড কিনে রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসক দলের হাতে তুলে দিয়েছে ১৯২ কোটি টাকা। কেভেন্টার গ্রুপের অধীন মদনলাল লিমিটেড নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কিনেছিল ১৮৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শাসমল ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড (এমকেজে কোম্পানির একটি সংস্থা) ৪৪ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল। সবমিলিয়ে কলকাতার এই গোষ্ঠীর চার কোম্পানি নির্বাচনী বন্ড মারফত প্রায় ৬১৬ কোটি টাকা বিজেপি ও তৃণমূল দলের নির্বাচনী তহবিলে সরবরাহ করেছে, যার সিংহভাগই গেছে বিজেপি-র তহবিলে। 
এরাজ্যে মেট্রো ডেয়ারির ৪৭ শতাংশ শেয়ার ছিল সরকারি হাতে। গত আগস্টে রাজ্য সরকার তার অংশ বিক্রি করে কেভেন্টার্স অ্যাগ্রোকে। বিক্রি হয়েছিল মাত্র ৮৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকায়। জলের দরে সরকারি শেয়ার বিক্রির লাভ তুলেছিল কেভেন্টার সংস্থা। ২০১৭ সালে সরকারি শেয়ার বিক্রির পর মাঝে দু’সপ্তাহের ফারাকে কেভেন্টার্স তার অংশ থেকে ১৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেয় মান্ডালা ক্যাপিটালকে। কত দামে বিক্রি হয়েছিল? ১৭০ কোটি টাকায় ১৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করল কেভেন্টার্স। ১৫ দিনে ৯ কোটি টাকার ওপর বেড়ে গেল মাত্র ১ শতাংশ শেয়ারের! যে দামে বেসরকারি কেভেন্টার্স শেয়ার বিক্রি করেছে সরকার যদি সেই দাম পেত, তাহলে মেট্রো ডেয়ারির সরকারি অংশীদারিত্ব থেকে সরকারের আয় হতো ৫২২ কোটি টাকা। অথচ সরকার ৪৭ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছে মাত্র ৮৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকায়। জলের দরে সরকারি কোম্পানির শেয়ার বিক্রির পর কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়েছিল। কিন্তু সেই মামলায় গত ২০২২ সালে হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিসন বেঞ্চ সেই লিভ পিটিশন খারিজ করে দেয়।
নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কেভেন্টার্স গ্রুপের তৃণমূল দলকে বিপুল টাকা অনুদানকে আসলে গুরুদক্ষিণা বলে মানছেন সরকারি আধিকারিকরাই। আবার ২০১৯ সালে এমকেজে গোষ্ঠীর কলকাতার দপ্তরে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে তল্লাশি চালিয়েছিল কেন্দ্রীয় এজেন্সি ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডায়রেক্টরেট)। ২০২১ সালে বিপুল আর্থিক দুর্নীতি অভিযোগ এনে ইডি’র তল্লাশির পরই কলকাতার এই কোম্পানি বিপুল টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বিজেপি-কে। রাজ্যের এক অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকের কথায়, ‘‘ জলের দরে মেট্রো ডেয়ারির শেয়ার বিক্রির বোঝাপড়ার দাম দিতে হয়েছে যেমন রাজ্যের শাসক দলকে। তেমনই ইডি দিয়ে কোম্পানির কলকাতার সদর দপ্তরে চাপের মূল্য চোকাতে হয়েছে নির্বাচনী বন্ড কিনে বিজেপি-র তহবিল ভরাতে।’’ 
রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই শাসক দলকে কোটি কোটি টাকা দেওয়ার মূল্য শেষ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে রাজ্যের মানুষকেই। ‘‘ মেট্রো ডেয়ারি সরকারি হাতে থাকলে দুধের দামে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকতো। এখন সেসবের আর বালাই নেই। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা গৌণ।” একথা বলছেন আধিকারিকরাই। আবার যে দুধ বাজারে চড়া দামে প্যাকেটজাত হয়ে বিক্রি হচ্ছে তার গুনমান নিয়েও উঠছে একাধিক প্রশ্ন। ‘‘ আগে সরকারের তরফে নজরদারি থাকতো। প্রাণী সম্পদ বিকাশ দপ্তর থেকে নিয়মিত তল্লাশি চালিয়ে আটক করা হতো ভেজাল দুধ। এখন সাদা রঙের লিকুইড দুধ হিসাবে বিক্রি হলেও দেখার কেউ নেই। ভেজাল দুধে ছেয়ে যাচ্ছে বাজার।” গভীর আশঙ্কা জানিয়েই একথা বলছিলেন প্রাণী সম্পদ দপ্তরের এক আধিকারিক। 
শুধু দুধের চড়া দামেই থামছে না। গ্রামীণ দুগ্ধচাষিদের সহায়তা মূল্যের ওপরও সরকারের হস্তক্ষেপ দিন প্রতিদিন কমছে। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার দায় থেকেই শুধু সরকার হাত গুটিয়ে নিচ্ছে তা নয়, গ্রামীণ দুগ্ধচাষিদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প থেকে ক্রমশ হাত উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে। 
দুধের দাম
২০১৯- ডাবল টোনড দুধ ৩৮ টাকা
২০২৪- ডাবল টোনড দুধ ৪৮ টাকা।
বৃদ্ধি ২৬ শতাংশ
কাউ মিল্ক
২০১৯- ৪৪ টাকা
২০২৪- ৫৬ টাকা
বৃদ্ধি ২৭ শতাংশ
প্রিমিয়াম মিল্ক
২০১৯- ৪৬ টাকা
২০২৪- ৬০ টাকা
বৃদ্ধি ৩০ শতাংশ
এমকেজি গোষ্ঠীর নির্বাচনী বন্ড কিনেছে ৬১৬ কোটি টাকা

Comments :0

Login to leave a comment