EDITORIAL

বোমা শিল্পে প্রথম

রাজ্য সম্পাদকীয় বিভাগ

CPIM west bengal panchayat election TMC BJP BENGALI NEWS editorial bombing

বোমা-বারুদ-বাজিই যে এখন পশ্চিমবাংলার সবচেয়ে বিকাশমান শিল্প সেটা বোধহয় তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে বা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। নিত্যদিনই মানুষ সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে তার ভূরি ভূরি নমুনা চাক্ষুষ করছেন। রাজ্যের শিল্প নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গর্বের অন্ত নেই। চা, তেলেভাজা, ঘুঘনি, পাউরুটি ইত্যাদি মুখ্যমন্ত্রীর অতি পছন্দের শিল্প। এসব বক্তৃতা দিলেও কখনো বোমা-বারুদ শিল্প নিয়ে কথা বলেন না। সম্প্রতি বাজি হাব নিয়ে বিস্তর চর্চা হলেও কোথায় কখন এই হাব উদয় হবে কেউ জানে না। তবে মুখ্যমন্ত্রী বলুন বা না‍‌ই বলুন, সরকারের কোনও তথ্য থাকুক বা না থাকুক রাজ্যে এই শিল্প যে সবচেয়ে বেশি রমরমা সেটা সাধারণ মানুষ প্রতিদিন টের পাচ্ছেন।
বৈধ উপায়ে বোমা বানানো যায় না। তাই বাজি কারখানার আড়ালে রমরমিয়ে চলে বোমা তৈরি। তৃণমূল জমানায় বোমা তৈরি রীতিমতো কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। কত শত সহস্র এমন বাজি কারখানা রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তার কোনও হিসাব নেই। আসলে এসব কারখানার ৯৯ শতাংশই অবৈধ বা বেআইনি। শাসক নেতাদের ছত্রছায়ায় এবং পুলিশের অলিখিত নিরাপত্তায় চলে। গুটি কতক বৈধ কারখানা থাকলেও তারা বাজির আড়ালে লুকিয়ে বোমাও তৈরি করে তিন/চার গুণ বাড়তি মুনাফার আশায়। এইসব বৈধ-অবৈধ যাবতীয় বোমা-বাজি কারখানার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাসক দলের নেতা কর্মীরা। বস্তুত তৃণমূলের মদতেই ব্যাঙের ছাতার মত সর্বত্র গজাচ্ছে এমন কারখানা। ফলে পুলিশ দেখেও দেখে না। আবার বহু ক্ষেত্রে পুলিশ ও শাসক নেতারা নিয়মিত টাকা তোলে এই সব কারখানা থেকে। নেতা-পুলিশের পায়ে নৈবেদ্য দিয়ে নিশ্চিন্তে চলে বোমা-বারুদের কারবার।
চাহিদা না বাড়লে বোমার কারবার বাড়ে না। এই বাজির চাহিদা সেই অর্থে না বাড়লেও বোমার চাহিদা কিন্তু হু হু করে বাড়ে। আর এই চাহিদার উৎস শাসক দল। বোমা উৎপাদনের বৈধতা না থাকায় তার কোনও হিসাব মিল‍‌বে না। তবে প্রতিদিন রাজ্যে যত বোমা ব্যবহার হয়, বিস্ফোরণ হয় বা উদ্ধার হয় তার থেকে ভয়াবহ ছবিটা আন্দাজ করা কঠিন নয়। শাসক দলের প্রয়োজনেই রাজ্যে বোমা শিল্পের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি। যেহেতু অন্য কোনও শিল্প নেই, বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই তাই বেকারে বেকারে ছেয়ে গেছে রাজ্য। কাজের এই হাহাকার থেকে পরিত্রাণ পেতে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন পাড়ি দেন ভিন রাজ্যে কাজের সন্ধানে। যারা যেতে পারেন না, রাজ্যে থেকে ১০০ দিনের কাজও পান না তাদের অনেকে পেটের দায়ে বেছে নেন এই মারণ শিল্পকে। সামান্য মজুরিতে তারা কাজ করেন বাজি কারখানায়। আর এই কারখানা থেকেই তাদের পরিবারে যায় বিস্ফোরণের সংবাদ। হাহাকার শুরু হ‌য় অসহায় পরিবারগুলিতে।
তথাকথিত বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ এবং তাতে মৃত্যু এখন নতুন কিছু নয়। নতুনত্ব কত বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে সেটা। দত্তপুকুরে ৯ জনের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় হলেও অচিরেই সব চাপা পড়ে যাবে। লোক দেখানোর জন্য কয়েকজন গ্রেপ্তার হবে। কিছুদিন পর ছাড়া পেয়ে ফের বোমার কারাখানা চালু করবে। মৃতদের কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া হবে। তিন মাস আগে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের পর থেকে অন্তত ১৫টি ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ঘটনার লাগাম টানার কোনও ব্যবস্থা নেই। এগরার ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক করে রাজ্যের সর্বত্র অবৈধ বাজি কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিছু বাজি আটক করা হলেও কোনও অবৈধ কারখানা বন্ধ হয়নি। দু’একজন আটক হলেও যথারীতি ছাড়া পেয়ে গেছেন। কোনও ব্যবস্থা যে নেওয়া হয় না তার প্রমাণ ১৬টি ঘটনা। অবৈধ বাজি কারখানায় বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যুর পর কোনও অপরাধী শাস্তি পায় না। ধরা হলেও এমন ধারায় কেস দেওয়া হয় যাতে ছাড়া পেতে পারে। ২০১৫ সালে পিংলার বিস্ফোরণের সাজা এখন ঘোষণা হলেও কারখানা বন্ধ হয়নি। তৃণমূল, পুলিশ, দুষ্কৃতী যোগসাজশে যে বোমা শিল্পের রমরমা তার রাশ টানা কোনদিনই সম্ভব নয় এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে। অতএব মৃত্যুর মিছিল চলবেই।

Comments :0

Login to leave a comment