Migrants

হাজার টাকায় ক’বেলা চলবে, একশো দিনের কাজটাও যদি...’

রাজ্য

প্রতীকী ছবি।

রণদীপ মিত্র: রামপুরহাট
 দশ বছরের সইফ আর তিন বছরের সাইফ এখনও তাদের নানির কোল আঁকড়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে দরজার দিকে। এই বুঝি আব্বা এল এই অপেক্ষায়। দুধের দুই শিশুকে কোলে নিয়ে থেকে থেকেই চোখের পাতা ভিজে যায় খুরশিয়া বিবির। সইফ-সাইফরা না বুঝলেও খুরশিয়া তো জানেন তাঁর ছেলে অর্থাৎ নাতিদের বাবা আর ফিরবে না। 
৬০নং জাতীয় সড়কের ধারে বীরভূমের কাঁটাগড়িয়া মোড়ে পেট্রোল পাম্পের উলটো দিকেই একচিলতে ঘর খুরশিয়া বিবির। প্রৌঢ়ার কাছে মাস তিনেক আগে একদিন আচমকা দুঃসংবাদ আসে ছেলে ওয়াসিম আর নেই। পরিবারের পেটে ভাত তুলে দিতে ওয়াসিম গিয়েছিল হায়দরাবাদ। গাড়ি চালানোর কাজ করার সময় উচ্চ বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের সংযোগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মাত্র ছাব্বিশেই মৃত্যু হয় ওয়াসিম আক্রমের। কাজের তাগিদে ভিনরাজ্যে যেতে বাধ্য হওয়ার খেসারতে এই অকাল মৃত্যুর পর কী হাল হয়েছে পরিবারের? বলতে বলতে অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন সন্তান হারানো মা খুরশিয়া বিবি, ‘‘দুই নাতিকে আমার উপর ছেড়ে ছেলেটা চলে গেল। শরীরে নার্ভের রোগ। হাত-পা ঝিন ঝিন করে। বিড়ি বাঁধতে আর পারি না। পাশের দোকানে সপ্তাহে দু’দিন মাল দেওয়ার কাজ করি। ২০০ টাকা করে দেয়। নাতি দু’টোকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেব। অন্তত দু’বেলা খেতে তো পাবে।’’ 
বিপর্যয় এখানেই থেমে নেই খুরশিয়ার। অভাবের দরুণ নিজে ১৮হাজার টাকা গোষ্ঠী লোন নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলে শোধ করে দেবে। এখন মাথায় চেপে বসেছে সেই ঋণের বোঝা। জানিয়েছেন, ‘‘মাসে ১৮০ টাকা সুদ। যতদিন না আসল শুধব, সুদ দিয়ে যেতেই হবে। কত মাস দিতে পারিনি। সুদ বেড়েই চলেছে। এদিকে বারবার চাপ আসছে লোন শোধ করবার। বলেছি, কোথা থেকে পাব? ওরা বলে দিয়েছে, টাকা দিতেই হবে।’’
মুর্শিদাবাদ সীমান্তের খুরশিয়ার যন্ত্রণার মিলিয়ে দিয়েছে অপর প্রান্তের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া রাজগ্রাম ভিলেজের তাপসী মালকেও। স্বামী উত্তম মাল গিয়েছিল কান্দিভেলি। দিনমজুরের কাজ করতে। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে সহকর্মীদের সাথে রাতে ঘুমিয়েছিলেন। ঘুমের ঘোরেই কোনোভাবে পড়ে যান নিচে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় শরীর। সেই খবর গ্রামে আসতেই থম মেরে যায় গ্রাম। রাধে আর অজয়–দুই ছেলেকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েছেন স্ত্রী তাপসী মাল। এখন বিড়ি বাঁধছেন। মজুরি হাজারে ১৪০টাকা। একদিন পর পর কাজ মেলে। তাপসী মালের কথায়, ‘‘আজ গাঁয়ে কাজ থাকলে স্বামীকে এভাবে যেতে হতো না। বড় ছেলেটার ব্রেনের রোগ আছে। চিকিৎসা দরকার। এখানে হবে না। বাইরে যাব কী দিয়ে!’’ ‘লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার’ পান? তাপসীর উত্তর, ‘‘ওই হাজার টাকায় আর ক’বেলা চলবে। মুদির দোকানে একবার গেলেই তো ওর থেকে ঢের বেশি খরচ হয়ে যায়। একশো দিনের কাজটাও যদি থাকত।’’ 
স্রেফ খুরশিয়া কিংবা তাপসী নন— এরকম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পরিবারে সংখ্যা শুধু বীরভূমেই বহু। গত ছ’সাত মাসে ভিনরাজ্যে শুধু বীরভূমের পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৫। কিন্তু তারপরেও জীবনের ঝুঁকি ঝুঁকি নিয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক সেই ছুটছেন ভিনরাজ্যেই। উপায় নেই। পেটের ভাত জোগাড়ের তাগিদ যে মাথায়। প্রকাশিত হওয়া রাজ্যের শ্রম দপ্তরের তথ্যে সেই উদ্বেজনক পরিসংখ্যানেরই উল্লেখ মিলেছে। সরকারের তথ্য বলছে, হিন্দু কিংবা মুসলিম, মতুয়া কিংবা রাজবংশী-রাজ্যের সব অংশের মানুষ মিলেছেন ‘পরিযায়ী’র দলে। আর এই পরিযায়ীদের কর্মসংস্থান, জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবি নিয়েই লোকসভা নির্বাচনে জোরালো আওয়াজ তুলছেন বামপন্থীরা। যেমনটা দেখা গেছে, মঙ্গলবার মুরারইয়ে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী মিলটন রশিদকে নিয়ে পরপর জনপদে হওয়া দীর্ঘ প্রচারে।
পরিযায়ীদের জন্য এত উৎকণ্ঠা কেন? রাজ্য সরকারের শ্রম দপ্তরের তথ্য বলছে, এখনও পাওয়া হিসাব অনুযায়ী পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২০লাখ ৪৭হাজার। বাস্তবে সংখ্যা এর থেকে বেশি বলে জানিয়েছেন খোদ মাইগ্রান্ট ওয়েলফেয়ার বোর্ডের চেয়ারম্যান তথা তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম। বলেছেন, ‘‘২৮ লাখের মতো হবে।’’ তবে তিনি দাবি করেছেন, ‘‘মাত্র ছ’সাত মাসের বোর্ড যা কাজ করেছে তা অন্য কোথাও হয়নি। পোর্টালে রেজিস্টার্ড পরিযায়ীরা মৃত্যুর জন্য ২লাখ, দুর্ঘটনার কবলে পড়লে ১লাখ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ, মৃতদেহ আনার জন্য ২৫হাজার টাকা‘হাজার টাকায় ক’বেলা চলবে,
একশো দিনের কাজটাও যদি...’


রণদীপ মিত্র: রামপুরহাট
৭ মে— দশ বছরের সইফ আর তিন বছরের সাইফ এখনও তাদের নানির কোল আঁকড়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে দরজার দিকে। এই বুঝি আব্বা এল এই অপেক্ষায়। দুধের দুই শিশুকে কোলে নিয়ে থেকে থেকেই চোখের পাতা ভিজে যায় খুরশিয়া বিবির। সইফ-সাইফরা না বুঝলেও খুরশিয়া তো জানেন তাঁর ছেলে অর্থাৎ নাতিদের বাবা আর ফিরবে না। 
৬০নং জাতীয় সড়কের ধারে বীরভূমের কাঁটাগড়িয়া মোড়ে পেট্রোল পাম্পের উলটো দিকেই একচিলতে ঘর খুরশিয়া বিবির। প্রৌঢ়ার কাছে মাস তিনেক আগে একদিন আচমকা দুঃসংবাদ আসে ছেলে ওয়াসিম আর নেই। পরিবারের পেটে ভাত তুলে দিতে ওয়াসিম গিয়েছিল হায়দরাবাদ। গাড়ি চালানোর কাজ করার সময় উচ্চ বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের সংযোগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মাত্র ছাব্বিশেই মৃত্যু হয় ওয়াসিম আক্রমের। কাজের তাগিদে ভিনরাজ্যে যেতে বাধ্য হওয়ার খেসারতে এই অকাল মৃত্যুর পর কী হাল হয়েছে পরিবারের? বলতে বলতে অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন সন্তান হারানো মা খুরশিয়া বিবি, ‘‘দুই নাতিকে আমার উপর ছেড়ে ছেলেটা চলে গেল। শরীরে নার্ভের রোগ। হাত-পা ঝিন ঝিন করে। বিড়ি বাঁধতে আর পারি না। পাশের দোকানে সপ্তাহে দু’দিন মাল দেওয়ার কাজ করি। ২০০ টাকা করে দেয়। নাতি দু’টোকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেব। অন্তত দু’বেলা খেতে তো পাবে।’’ 
বিপর্যয় এখানেই থেমে নেই খুরশিয়ার। অভাবের দরুণ নিজে ১৮হাজার টাকা গোষ্ঠী লোন নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলে শোধ করে দেবে। এখন মাথায় চেপে বসেছে সেই ঋণের বোঝা। জানিয়েছেন, ‘‘মাসে ১৮০ টাকা সুদ। যতদিন না আসল শুধব, সুদ দিয়ে যেতেই হবে। কত মাস দিতে পারিনি। সুদ বেড়েই চলেছে। এদিকে বারবার চাপ আসছে লোন শোধ করবার। বলেছি, কোথা থেকে পাব? ওরা বলে দিয়েছে, টাকা দিতেই হবে।’’
মুর্শিদাবাদ সীমান্তের খুরশিয়ার যন্ত্রণার মিলিয়ে দিয়েছে অপর প্রান্তের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া রাজগ্রাম ভিলেজের তাপসী মালকেও। স্বামী উত্তম মাল গিয়েছিল কান্দিভেলি। দিনমজুরের কাজ করতে। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে সহকর্মীদের সাথে রাতে ঘুমিয়েছিলেন। ঘুমের ঘোরেই কোনোভাবে পড়ে যান নিচে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় শরীর। সেই খবর গ্রামে আসতেই থম মেরে যায় গ্রাম। রাধে আর অজয়–দুই ছেলেকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েছেন স্ত্রী তাপসী মাল। এখন বিড়ি বাঁধছেন। মজুরি হাজারে ১৪০টাকা। একদিন পর পর কাজ মেলে। তাপসী মালের কথায়, ‘‘আজ গাঁয়ে কাজ থাকলে স্বামীকে এভাবে যেতে হতো না। বড় ছেলেটার ব্রেনের রোগ আছে। চিকিৎসা দরকার। এখানে হবে না। বাইরে যাব কী দিয়ে!’’ ‘লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার’ পান? তাপসীর উত্তর, ‘‘ওই হাজার টাকায় আর ক’বেলা চলবে। মুদির দোকানে একবার গেলেই তো ওর থেকে ঢের বেশি খরচ হয়ে যায়। একশো দিনের কাজটাও যদি থাকত।’’ 
স্রেফ খুরশিয়া কিংবা তাপসী নন— এরকম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পরিবারে সংখ্যা শুধু বীরভূমেই বহু। গত ছ’সাত মাসে ভিনরাজ্যে শুধু বীরভূমের পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৫। কিন্তু তারপরেও জীবনের ঝুঁকি ঝুঁকি নিয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক সেই ছুটছেন ভিনরাজ্যেই। উপায় নেই। পেটের ভাত জোগাড়ের তাগিদ যে মাথায়। প্রকাশিত হওয়া রাজ্যের শ্রম দপ্তরের তথ্যে সেই উদ্বেজনক পরিসংখ্যানেরই উল্লেখ মিলেছে। সরকারের তথ্য বলছে, হিন্দু কিংবা মুসলিম, মতুয়া কিংবা রাজবংশী-রাজ্যের সব অংশের মানুষ মিলেছেন ‘পরিযায়ী’র দলে। আর এই পরিযায়ীদের কর্মসংস্থান, জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবি নিয়েই লোকসভা নির্বাচনে জোরালো আওয়াজ তুলছেন বামপন্থীরা। যেমনটা দেখা গেছে, মঙ্গলবার মুরারইয়ে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী মিলটন রশিদকে নিয়ে পরপর জনপদে হওয়া দীর্ঘ প্রচারে।
পরিযায়ীদের জন্য এত উৎকণ্ঠা কেন? রাজ্য সরকারের শ্রম দপ্তরের তথ্য বলছে, এখনও পাওয়া হিসাব অনুযায়ী পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২০লাখ ৪৭হাজার। বাস্তবে সংখ্যা এর থেকে বেশি বলে জানিয়েছেন খোদ মাইগ্রান্ট ওয়েলফেয়ার বোর্ডের চেয়ারম্যান তথা তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম। বলেছেন, ‘‘২৮ লাখের মতো হবে।’’ তবে তিনি দাবি করেছেন, ‘‘মাত্র ছ’সাত মাসের বোর্ড যা কাজ করেছে তা অন্য কোথাও হয়নি। পোর্টালে রেজিস্টার্ড পরিযায়ীরা মৃত্যুর জন্য ২লাখ, দুর্ঘটনার কবলে পড়লে ১লাখ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ, মৃতদেহ আনার জন্য ২৫হাজার টাকা, পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা সুদে ঋণ, স্বাস্থ্যসাথী, অবসরকালীন ভাতা সহ একগুচ্ছ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। নতুন বোর্ড। সবটা গোছাতে আর একটু সময় দিতে হবে।’’ 
কিন্তু কাঁটাগড়িয়ার খুরশিমা, কিংবা রাজগ্রামের তাপসী বা বারার মামহমুদা সহ অসংখ্য স্বজনহারারা কেউই বলতে পারছেন না সেই সুবিধার আঁচ পেয়েছেন কিনা। না পাওয়ার কথা কারণ, বীরভূমে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য ছ’জন, স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য একজন, মৃতদেহ আনার জন্য ৮জন মিলে মোট মাত্র পনেরো জনের জন্য খরচ করা হয়েছে ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা! বাকি বড় অংশের বিপন্নরা থেকে গিয়েছেন বঞ্চিতই, কারণ হয় তো তারা ‘রেজিস্টার্ড’ নন।
.................
ক্যাপশন: মুরারইয়ে প্রচারে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী মিলটন রশিদ।
, পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা সুদে ঋণ, স্বাস্থ্যসাথী, অবসরকালীন ভাতা সহ একগুচ্ছ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। নতুন বোর্ড। সবটা গোছাতে আর একটু সময় দিতে হবে।’’ 
কিন্তু কাঁটাগড়িয়ার খুরশিমা, কিংবা রাজগ্রামের তাপসী বা বারার মামহমুদা সহ অসংখ্য স্বজনহারারা কেউই বলতে পারছেন না সেই সুবিধার আঁচ পেয়েছেন কিনা। না পাওয়ার কথা কারণ, বীরভূমে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য ছ’জন, স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য একজন, মৃতদেহ আনার জন্য ৮জন মিলে মোট মাত্র পনেরো জনের জন্য খরচ করা হয়েছে ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা! বাকি বড় অংশের বিপন্নরা থেকে গিয়েছেন বঞ্চিতই, কারণ হয় তো তারা ‘রেজিস্টার্ড’ নন।
 

Comments :0

Login to leave a comment