সাড়ে ছয় বছর আগে ৮ নভেম্বর সন্ধেবেলায় সেজেগুজে টিভি’র পর্দায় হাজির হয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নাটকীয় ভঙ্গিমায় সকলকে চমকে দিয়ে তখনকার চালু ১ হাজার টাকার ও ৫০০ টাকার নোট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন নির্বোধ সিদ্ধান্তের পরিণতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল সেটা ভাবলে আজও মানুষ শিউরে ওঠেন।
তখন চালু মোট নগদের প্রায় ৯০ শতাংশই ছিল ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে। প্রধানমন্ত্রীর মাস্টারস্ট্রোকে এক লহমায় বিপুল নগদ বাজার থেকে উধাও হবার ফলে নগদের অভাবে কার্যত থমকে যায় দেশের অর্থনীতি, স্তব্ধ হয়ে যায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। নোট বন্দির সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ছাড়া হয় নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের ২০০০ টাকার নোট। টিভি’র ভাষণে মোদী জানিয়েছিলেন তাঁর এই নোট বন্দির মোক্ষম ঘায়ে দেশ থেকে কালো টাকা নির্মূল হয়ে যাবে, সন্ত্রাসবাদীদের কোমর ভেঙে যাবে জাল টাকা জোগান বন্ধ হয়ে।
এটাও বলেছিলেন এতে দুর্নীতিও বন্ধ হয়ে যাবে। বুক ফুলিয়ে গর্ব করে জানিয়েছিলেন ২০০০ টাকার নোট এমন এক প্রযুক্তিতে তৈরি হবে যাতে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখলে ধরা পড়ে যাবে।
নরেন্দ্র মোদীর সেই সাধের ২০০০ টাকার নোট সাড়ে ছয় বছর পর বাতিল বলে ঘোষণা করে দিল তাঁরই অতি অনুগত ও বিশ্বস্ত শক্তিকাণ্ডের পরিচালনাধীন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এবার আর নিজে সেজেগুজে টিভি’র পর্দায় মুখ দেখাননি। এমনকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণা সময় ত্রিসীমানাতেও ছিলেন না। চলে গেছেন জাপানের হিরোশিমায়। অবশ্য কোন লজ্জায় মুখ দেখাবেন।
তাঁর খামখেয়ালিপনার জেরে শুধু কয়েকশো মানুষের অকাল মৃত্যু হয়নি, সমগ্র ভারতবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কত ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং কত শত সহস্র মানুষকে জীবিকাচ্যুত হতে হয়েছিল তার কোনও সীমা পরিসীমা ছিল না। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সরকারকৃত এমন ভয়ঙ্কর ও ব্যাপক যন্ত্রণার আর কোনও নজির নেই। এক একাধিপতি শাসকের খেয়ালের মূল্য এভাবেই চোকাতে হয়েছিল ভারতের জনগণকে।
স্বাধীন ভারতের দীর্ঘকালপর্বে নানা ডিজাইনে নানা মূল্যমানের নোট চালু হয়েছে। কিন্তু কোনও নোটেরই এত কম বয়সে মৃত্যু ঘণ্টা বাজেনি। নরেন্দ্র মোদীকে সেই কাজটা করতে হয়েছে নিজেকে আড়ালে রেখে। কিন্তু এত ঢাকঢোল পিটিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ আশ্বাস দিয়ে যে টাকা বাজারে এনে অপার কৃতিত্ব জাহির করা হয়েছিল সেই নোটে এই পরিণতি কেন?
নোট বন্দির সময় বড়গলা করে বলেছিলেন কালো টাকার কারবারিরা নাকি বস্তা বস্তা কালো টাকা লুকিয়ে রেখেছে। সেই টাকা সব বাতিল কাগজ হয়ে যাবে। বাজারে জাল নোট বলে কিছু থাকবে না।
সন্ত্রাসবাদীদের মজুত টাকাও অচল হয়ে যাবে। বদলে তিনি যে ২০০০ টাকার নোট চালু করছেন সেটা নাকি জাল করা যাবে না, কালোটাকা রূপে মজুতও করা যাবে না। বাস্তবে দেখা গেছে মোদীর নতুন ২০০০ টাকার নোট চালুর এক মাসের মধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে মোদীর রাজ্য গুজরাটে জাল ২০০০ নোট পাওয়া গেছে। ধীরে ধীরে জাল ২০০০ টাকার নোট ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। পাশাপাশি যত্রতত্র থেকে উদ্ধার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ২০০০ টাকার নোটে।
কালো টাকা মজুতে সবচেয়ে লোভনীয় ও সুবিধাজনক নোট ২০০০ টাকার। এই অবস্থায় নিয়ে ফেলা থুথু নিজেকেই চেটে বাতিল করতে হলো সেই নোট। কিন্তু এই বাতিল ঘোষণাকালে নিজে হাজির হবার সাহস দেখাতে পারেননি। কারণ তাহলে অনেক অপ্রিয় প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। কিন্তু পালিয়ে কি বাঁচা যাবে? জবাব তাকে দিতেই হবে। আজ না হয় কাল স্বীকার করতে হবে নোট বন্দি ছিল মোদী সরকারের অপদার্থতম পদক্ষেপগুলির অন্যতম।
Comments :0