‘কান টানলে মাথা আসে’ এটা বাংলার একটি চালু প্রবাদ বাক্য। সাম্প্রতিককালে শাসক দলের ছত্রছায়ায় দেদার চুরি, পাথর চুরি, বালি চুরি, মাটি চুরি, এমনকি চাকরি চুরিকে কেন্দ্র করে তদন্তের প্রেক্ষাপটে প্রবাদবাক্যটির ব্যবহার অনেকটাই বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি-সিবিআই দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত করছে। কখনো তদন্তের গতি বাড়ে, কখনো ঝিমিয়ে পড়ে। লুটের টাকা কোথায়, কীভাবে, কাদের মাধ্যমে পাচার হয়েছে তদন্তর লক্ষ্য সেটাই। কিন্তু অদৃশ্য সুতোর টানে তদন্তকারি সংস্থাগুলি রাঘববোয়াল ধরার বদলে চুনোপুঁটিদের নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করছে। তাই বামপন্থীরা বারংবার অসন্তোষ প্রকাশ করে বলবার চেষ্টা করেছে শুধু কান টানাটানি নয়, ধরতে হবে মাথাকে। ইডি সম্ভবত এবার মাথার দিকে হাত বাড়িয়েছে। নানা অলিগলি ঘুরে তারা পৌঁছে গেছে কালীঘাটে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির দোরগোড়ায়।
দক্ষিণ কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার এক প্রোমোটারের অফিসে হানা দিয়ে নগদ প্রায় দেড় কোটি টাকার পাশাপাশি এমন সব নথি উদ্ধার করেছে তাতে এই প্রোমোটারের সঙ্গে সম্পর্ক মিলেছে এক ধাবা-হোটেল ব্যবসায়ীর। তিনি আবার তৃণমূলের নেতা। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে এই ব্যবসায়ীর যৌথ ব্যবসা ও যৌথ সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে। রাজ্যে ও রাজ্যের বাইরে দুজনের একাধিক হোটেল আছে বলেও জানা গেছে। সবটাই হয়েছে মমতা জমানায়। ভ্রাতৃবধূ আবার স্থানীয় কাউন্সিলরও। ভোটের সময় তার বিপুল সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। একজন স্বঘোষিত সমাজসেবী ও গৃহবধূর এই বিপুল সম্পত্তির উৎস কি তার উত্তর আজও মেলেনি। ইডি-র ইঙ্গিত কয়লা পাচারের টাকা প্রোমোটারের ব্যবসায়, ধাবা-হোটেলে লগ্নি হয়েছে। এই অবস্থায় মাথা উদ্বেগ বাড়াটাই স্বাভাবিক।
মুখ্যমন্ত্রীর বরাবরের অভ্যেস হলো ঘুরিয়ে নাম দেখানো। সোজা কথার সোজা উত্তর তিনি কখনো দেন না। ফাঁদে পড়ার ভয়ে অস্বস্তির সব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে অবান্তর প্রশ্ন নিয়ে সময় কাটান। আর সবচেয়ে সহজ উপায় বিজেপি’র কলতলার ঝগড়ায় মেতে ওঠা। মানুষ তারিয়ে তারিয়ে তা উপভোগ করে। মাঝখান থেকে হাওয়া হয়ে যায় মূল প্রশ্নটি। মূল প্রশ্ন হলো কয়লা পাচারে টাকার গতিপথে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের স্ত্রীর সংযোগ আছে কিনা। তথ্য প্রমাণ হাজির করার দায়িত্ব ইডি’র। সেই দায়িত্ব তারা কতটা পালন করবে সেটা নির্ভর করছে মোদী-মমতার বোঝাপড়ার গতি প্রকৃতি এবং নাগপুরের মনোভাবের উপর। কিন্তু অভিযোগ যখন উঠেছে সত্যি জানার অধিকার আমজনতার আছে। আর সত্য জানানোর দায় মুখ্যমন্ত্রী অস্বীকার করতে পারেন না। বিশেষ করে যখন অভিযোগের তির তাঁর পরিবারের দিকে তাক করেছে। এক্ষেত্রে বিজেপি তাঁর ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীকে দলে টানা চেষ্টা করেছিল বলে সস্তার গল্প হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলে চলে না। যদি তেমন ঘটেও থাকে তবে তা এতদিন গোপন রেখেছিলেন কেন? তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে যাবে আবার বিজেপি থেকে তৃণমূলে আসবে এতে নতুনত্ব কিছু নেই। যে পরিবার টালির ঘরে থেকে, ২০১১ সালের আগে যাদের ছিল টানাটানির সংসার ক্ষমতায় আসার পর এক দশ যেতে না যেতে সেই পরিবারের অর্থ-সম্পদের পাহাড় জমে কোন যাদু মন্ত্রে? পাড়ার এবং আশেপাশের পুরানো বাসিন্দাদের তাড়িয়ে সব সম্পত্তির তারা মালিক হন কি করে? বৈধ পথে এমন কোন পেশা আছে যাতে রাতারাতি কোটি কোটি টাকা আয় হতে পারে? একজন গৃহবধূ সমাজসেবী এত টাকা-সম্পত্তির মালিক হন কি করে? এত বিপুল সম্পদের উৎস তো পরিবারের প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতে হবে। কাজরী ব্যানার্জি পরিবারের অন্যান্যদের প্রতিটি সম্পত্তি কিভাবে অর্জিত তা জানাতে হবে। সততা বা স্বচ্ছতার ন্যাকামি করে পার পাওয়া যাবে না।
Comments :0