CHILD MARRAIGE BENGAL 'LANCET'

রাজ্যে বাল্য বিবাহে বৃদ্ধিতে উদ্বেগ এবার আন্তর্জাতিক স্তরেও

রাজ্য

প্রতীম দে

প্রায় তিন দশকে দেশে কমেছে বাল্যবিবাহ। কিন্তু সাতটি রাজ্যে গুনতিতে বেড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। 
রাজ্যে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার তথ্য রাজ্য বা জাতীয় স্তরেও প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত গবেষণা পত্রিকা ‘ল্যানসেট’-র গবেষণাতেও প্রকাশিত হয়েছে উদ্বেগজনক এই প্রবণতা। সেক্ষেত্রে ‘কন্যাশ্রী’-র মতো প্রকল্প কাজ করছে না কেন, উঠেছে সেই প্রশ্ন। 
সারা দেশের তথ্যই বিবেচনা করেছে ‘ল্যানসেট’। ১৯৯৩ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তথ্যের নিরিখে দেখা গিয়েছে দেশে মাথা গুনতিতে কমেছে ৫০ লক্ষের কিছু বেশি বাল্যবিবাহ। হ্রাসের হার ২৭.২ শতাংশ। 
ল্যানসেটের এই রিপোর্ট সামনে আসার অনেক আগে রাজ্যে বাল্য বিবাহের ভয়ঙ্কর চেহারা ধরা পড়েছিল। পঞ্চম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা যায় যে ২০-২৪ বছত বয়সী প্রায় ৪১ শতাংশ যুবতীর বিয়ে হয়েছে নাবালিকা থাকা অবস্থায়। যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। 
পশ্চিমবঙ্গে এই পর্বে মাথার গুনতিতে বেড়ে বাল্যবিবাহ। প্রায় ৩২ শতাংশ বৃদ্ধির হিসেব মিলছে রাজ্যে। মহামারীর পর দেশেই বাল্যবিবাহ ফের বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা চিহ্নিত করেছে গবেষণা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির সংখ্যা অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় বেশি। ঝাড়খণ্ড শতাংশের বিচারে সবচেয়ে বেশি, ৫৩ শতাংশ।   
পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের চার রাজ্য মোট বাল্য বিবাহের প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী। পশ্চিমবঙ্গে দেশের ১৫.২ শতাংশ, বিহারে ১৬.৭ শতাংশ, উত্তর প্রদেশে ১২.৫ শতাংশ এবং মহারাষ্ট্রে ৮.২ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম এবং ছেলের ২১ বছরের কমে বিয়ে হলে বাল্যবিবাহ ধরা হয়। ‘ল্যানসেট’ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পাঁচটি রিপোর্টের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছে প্রতি ৫ জন মেয়ের ১ জন এবং প্রতি ৬ জন ছেলের ১ জনের বিয়ে হয়েছে দেশের আইনে নির্দিষ্ট বয়সসীমার আগে। 
রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে মোট বাল্য বিবাহের ১৫.২ শতাংশ এই রাজ্যে। অথচ এ রাজ্যে চালু রয়েছে কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে চালু হয়েছে কন্যাশ্রী প্রকল্প। প্রথমে স্কুলের ছাত্রীরা এই প্রকল্পের আওতায় থাকলেও এখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাও এই প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের রাজ্য বাজেট অনুযায়ী ৮১ লক্ষ পড়ুয়া এই কন্যাশ্রীর আওতায় পড়ছে। 
এই প্রকল্পের বার্ষিক বৃত্তি ১০০০/- টাকা, এককালীন ২৫০০০/- টাকা বৃত্তি এবং মাসিক ২০০০-২৫০০/- টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। বার্ষিক বৃত্তির জন্য ছাত্রীর বয়স ১৩ বছরের বেশি ও ১৮ বছরের কম হতে হবে। ছাত্রীকে অন্তত অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত হতে হবে।
ছাত্রীর পারিবারিক আয় বাৎসরিক অনধিক এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা হতে হবে। তবে বর্তমানে এই শর্ত তুলে দেওয়া হয়েছে । সরকারি বা সরকার অনুমোদিত বা সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বিদ্যালয়ে পাঠরত যে কোনও ছাত্রী এই সুযোগ পাবে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই ভাতার জন্য ছাত্রীকে ছাত্রীকে অবিবাহিতা হতে হবে।
তেমনি এক কালীন বৃত্তির জন্য আবেদন করার দিনে ছাত্রীর বয়স আঠেরো বছরের বেশি ও উনিশ বছরের কম হতে হবে। ছাত্রীকে মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক, কারিগরি, বৃত্তিমূলক, ক্রীড়াবিষয়ক ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে নিবন্ধীকৃত প্রতিষ্ঠানের পাঠরত হতে হবে।
মাসিক বৃত্তির জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই একজন স্নাতক হতে হবে। স্নাতক পরীক্ষায় কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ নম্বর থাকতে হবে। বিজ্ঞান অধ্যয়নরত মেয়েদের প্রতি মাসে ২,৫০০/- টাকা করে দেওয়া হবে। বাণিজ্য ও কলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাসিক ২,০০০/- টাকা করে দেওয়া হবে। এই বৃত্তির জন্য বয়সের কোন ঊর্ধ্বসীমা নেই।
বিভিন্ন সময় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে রাজ্যে মাধ্যমিক উচ্চ-মাধ্যমিকে বেড়েছে মহিলা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। কিন্তু বাস্তব অনেকটাই আলাদা। ড্রপ আউট বাড়ছে।
কন্যাশ্রী পাচ্ছেন এমন ছাত্রীরাও লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কন্যাশ্রীতে বছরে দেওয়া হয় ১ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকায় একমাসের পড়ার খরচও ওঠে না।  
মুর্শিদাবাদের দেবকুণ্ড শেখ আব্দুর রাজ্জাক মেমোরিয়াল গার্লস হাই মাদ্রাসা। সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়েরা এই স্কুলে পড়েন। কিন্তু শেষ এক বছরে ব্যাপক ভাবে কমেছে ছাত্রী সংখ্যা। ওই মাদ্রাসার এক শিক্ষিকার কথায়, ‘‘লকডাউনের পর থেকে অনেক ছাত্রী স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে হয় কারুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে বা কেউ বাইরে চলে গিয়েছে কাজের জন্য।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে কখনও বাল্য বিবাহ আটকানোর জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা কয়েক জন ছাত্র ছাত্রীকে নিয়ে বাল্য বিবাহ আটকানোর জন্য চেষ্টা করেছি। অতীতে সেই কাজ আমরা সফলও হয়েছি। কিন্তু দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে যোগাযোগ নষ্ট হওয়ায় সেই কাজে খামতি দেখা দিয়েছে।’’
‘ল্যানসেট’-র সমীক্ষা জানাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসাম, বিহার, গোয়া, মণিপুরে বেড়েছে বাল্যবিবাহের হার। সারা দেশেই সবচেয়ে বেশি সাফল্য মিলেছিল ২০০৬ থেকে ২০১৬ পর্বে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০’র মধ্যে বাল্য বিবাহ মুক্তি সমাজ গড়তে হবে। বাল্য বিবাহ বিবেচিত হয় মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যৌন অত্যাচারের সূচক হিসেবে। 

সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক কনীনিকা ঘোষ বোসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "সংগঠণের কাজ করতে গিয়ে আমরা খালি চোখে এই বাল্য বিবাহের বিষয়টি উপলব্ধি করেছি। রাজ্য সরকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করেছে। সেই প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা অনেকে পাচ্ছে। কিন্তু সেই টাকার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটার কোন তদারকি নেই। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যত উঠে গিয়েছে। কে নজরদারি করবে?"
তিনি আরও বলেন, "গ্রামের দিকে অভিভাবকরা বাধ্য হচ্ছেন তাদের অর্ত সমাজিক পরিস্থিতির জন্য অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে। সংগঠনের পক্ষ থেকে এই নিয়ে আমরা আগে অনেকবার সরব হয়েছি। এই সমীক্ষা সেই কথা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।"

Comments :0

Login to leave a comment