FARMARS

আমনের ঋণই মেটেনি, জুড়ল আলুর ধারও, ঋণের জালে বাংলার কৃষক

রাজ্য জেলা

আমন চাষের নেওয়া ঋণই শোধ করতে জেরবার কৃষক। আমনের অনাদায়ী ঋণের ওপর নতুন বোঝা চেপেছে আলুচাষের ধার। সঙ্কটের এহেন চেহারা আগে কখনও পড়েনি বাংলার গ্রাম।
একর প্রতি ৩২হাজার টাকা আমন ধান চাষে কৃষি সমবায় সমিতি থেকে চাষের জন্য ঋণের সুযোগ মেলে কৃষকদের। চাষের মরশুম শুরু হওয়ার আগে এপ্রিল মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দেওয়া হয় আমনের জন্য ঋণ। আমন চাষের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করার সময় আগামী ৩১ মার্চ। 
কিন্তু এবার সেই আমন চাষের জন্য সমবায় থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে পারছেন না কৃষক। হুগলীর চণ্ডীতলা ১ নং ব্লকের মশাট গ্রাম পঞ্চায়েতের এক কৃষি সমবায় সমিতি আমন চাষের জন্য তাদের ৭৬ জন সদস্যকে ২৫ লক্ষ টাকার ঋণ মঞ্জুর করেছিল। এখনও পর্যন্ত সেই ঋণের কতটুকু আদায় হয়েছে? এখনও পর্যন্ত মাত্র ৩ লক্ষ টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। যার অর্থ, অনাদায়ী থেকে গেছে প্রায় ৮৮ শতাংশ ঋণ!
সমবায় সমিতির এক কর্মকতার কথা,‘‘ আমনের ঋণ আদায়ের সঙ্গে আমরা আলুচাষের জন্য দেওয়া ঋণও একইসঙ্গে প্রতি বছরই মার্চ মাসে আদায় করার চেষ্টা করি। কিন্তু এবার কৃষকরা আগেভাগেই জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, লোনের টাকা এবার দিতে পারব না। আমনের ঋণই মেটাতে পারছে না, তারা কীভাবে আলুর জন্য নেওয়া ধার মেটাবে! আগে কোনো বছর এই অবস্থার মুখে পড়তে হয়নি।’’ 
মার্চ মাসজুড়েই এখন কৃষকদের কাছে ফোন করে, বাড়িতে গিয়ে ঋণ পরিশোধের জন্য পৌঁছে তাগাদা করে আসছেন সমবায় সমিতি। কিন্তু চলতি বছরে অভিজ্ঞতায়, কৃষকরা ফোন ধরলে জানিয়ে দিচ্ছে, চাষের করুণ অবস্থার কথা। হুগলীরই মশাট গ্রামের বাসিন্দা এবার আলুচাষের জন্য সমবায় সমিতি থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ কো অপারেটিভ থেকে বহু বছর ধরে লোন চলছে। কোনোবার আমাদের বলতে হয়নি। অফিসে গিয়ে টাকা শোধ করে এসেছি। কিন্তু এবার অবস্থা শোচনীয়। আমাদের আত্মসম্মান আছে। চিন্তায় আছি।’’ 
আসলে চলতি মরশুমে মাঠ থেকে আলু ওঠার পর দাম পায়নি কৃষক। কার্যত অভাবী বিক্রির পথে যেতে বাধ্য হয়েছেন আলুচাষিরা। রাজ্য সরকার কৃষকদের অভাবী বিক্রি ঠেকাতে আলুর কুইন্টাল পিছু ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ৯০০ টাকা ঠিক করেছে। কৃষকদের অভিযোগ, সরকারের বেঁধে দেওয়া সহায়ক মূল্যের দাম আসলে অভাবী বিক্রির রাস্তাই খুলে দিয়েছে। 
আলুচাষের জন্য কৃষকদের সমবায় সমিতি একর পিছু ৮০ হাজার টাকা ঋণ দেয়। সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হয় আলুচাষের জন্য ঋণ। চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে শোধ করার সময় আলুচাষের জন্য নেওয়া ঋণের। কৃষি সমবায় সমিতি থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য কৃষকদের ৭ শতাংশ হারে সুদ গুণতে হয়। কিন্তু সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে পারলে সরকার ৩ শতাংশ সুদের টাকা ভরতুকি হিসাবে দেয়। কিন্তু সময়সীমা পার হলে সেই ঋণের জন্য কৃষকদের গুণতে হয় সাড়ে ১০ শতাংশ ঋণের বোঝা।
কিন্তু এবার আলুর মাঠ থেকেও দাম না মেলায় তীব্র সঙ্কটের মুখে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষকদের আশা ছিল, হিমঘর খোলার পর আলুর দাম কিছুটা উঠতে পারে। কিন্তু সেই আশাই শেষ পর্যন্ত মেলেনি। ১ মার্চ হিমঘর খোলার পর আলুর দাম বস্তা পিছু(৫০ কেজি) কোথাও ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু দু দিনের মধ্যে সেই দাম পড়তে শুরু করে। এখন হুগলী আলুচাষের এলাকা থেকে হুগলী-বর্ধমান সীমান্তের পূর্ব বর্ধামান জেলার আলু অধ্যুষিত এলাকায় ৪২০-৪৩০ টাকা বস্তায় বিক্রি হচ্ছে আলু। কৃষকদের অভিযোগ, ‘‘ মাঠ থেকে আলু কেনার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনও সাড়া নেই। তার কারণ, গত বছর রাজ্য সরকার হিমঘর থেকে আলু ভিনরাজ্যে পাঠানো বন্ধ করার ফল শেষ পর্যন্ত ভুগতে হচ্ছে কৃষকদেরই।’’
ফলে এখন বাধ্য হয়েও কৃষকরা হিমঘরে আলু মজুত করছেন। হুগলীর ধনিয়াখালির আলুচাষি বিপ্লব হালদার ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন,‘‘ হাসপাতালে রোগী মরণাপন্ন হলে যেমন ভেন্টিলেশনে ঢুকিয়ে দেয়, আমরাও এখন আমাদের চাষের আলু ভেন্টিলেশনে ঢুকিয়ে রাখলাম। এখন আলু বিক্রি করতে হলে বিঘাতে ৯ হাজার টাকা করে লস হচ্ছে চাষিদের। রোগীর পরিবারের মতো আলুকে ভেন্টিলেশনে(হিমঘর) রেখে আমাদের আশা দেখছি, যদি দাম বাড়ে।’’ ৮ বিঘা জমিতে আলুচাষ করার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ২ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু চাষের খরচের হিসাব দিতে গিয়ে কৃষক জানাচ্ছেন,  ৮ বিঘা জমির জন্য বীজ লেগেছে ৪০ বস্তা। খরচ হয়েছে ১লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। চাষের সময় সারের জন্য খরচ হয়েছে ৪৮ হাজার টাকা। তারপর বিঘা প্রতি জলের খরচ, কীটনাশকের খরচ হিসাব করে কৃষক দেখিয়ে দিচ্ছেন ক্ষতির পরিমাণ। হিমঘরে আলু রাখার থেকে প্রান্তিক কৃষক  সবসময়ই চায়, মাঠ থেকে লাভজনক দর পেলে আলু বিক্রি করার। কারণ, বিক্রির অর্থের টাকায় ঋণ শোধের পাশাপাশি সংসার খরচের টাকার ব্যবস্থা। কিন্তু সেই পথ বন্ধ হওয়ার ফলে বিপন্ন কৃষক।
ক্ষুব্ধ কৃষকরা তাই বলছেন, ‘‘ সরকার পুজোর জন্য বিদ্যুতের ভরতুকি দিতে পারে। আর আমাদের গলা কেটে জলের জন্য বিদ্যুতের খরচ তুলে নিচ্ছে। এই সরকার কৃষকদের মারতে এসেছে। গ্রামীণ অর্থনীতি শেষ।’’

Comments :0

Login to leave a comment