সূর্যকান্ত মিশ্র
খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি সংবাদ নিশ্চয়ই সবার নজরে পড়েছে। সেই সংবাদ বলছে নয়া ফ্যাসিবাদের অন্যতম নেত্রী বর্তমানে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসায় বেশ কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, 'দেশে দেশে আমাদের (অতি দক্ষিণপন্থী) জয় জয়কার শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমেরিকায় আমরা সফল হয়েছি। ধীরে ধীরে তা অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়বে। বামপন্থীদের আধিপত্য আমরা খতম করব। ট্রাম্পের ভয়ে সকলে কাঁপছে। আরও কয়েকটি দেশ থেকে সুখবর আসতে চলেছে'।
এই বক্তৃতা তিনি দিয়েছেন সি-প্যাক অর্থাৎ কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সে গত ২২ ফেব্রুয়ারী। উল্লেখ্য সি-প্যাক গঠিত হয় ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষণশীল দল এবং ব্যক্তিদের উদ্যোগে। এর প্রথম সম্মেলনে বক্তা ছিলেন রোনাল্ড রেগন তৎকালীন রিপাবলিকান পার্টির নেতা, যিনি পরবর্তীতে সে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সি-প্যাক আমেরিকান রিপাবলিকান পার্টি সহ ইউরোপ এবং বাকি বিশ্বের ৪৪টি অতি দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল দলকে নিয়ে সংগঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনে সারা দুনিয়ার নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার, সংহত করার চেষ্টা হয়েছে। খেয়াল রাখার বিষয় হল, এই মঞ্চে কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিই অংশগ্রহণ করেছে এমনটা নয়, কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশও রয়েছে। ব্রাজিলের বোলসেনারো, ফ্রান্সের মেরিল ল্যে পেন, আর্জেন্টিনার অতি দক্ষিণপন্থী ও মার্কিনপন্থী রাষ্ট্রপতি জাভিয়ের মিলেই, এরাও এখানে রয়েছেন। এরা সকলে এক জায়গায় এসেছে, আরও কাছাকাছি আসতে চাইছে। এদের অভিযোগ হল বামপন্থী ও উদারবাদীরা চিরকাল বাক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অজুহাতে কাঁদুনি গেয়ে এসেছে। মেলোনি বলেছেন, ‘আমি, ট্রাম্প কিংবা মোদী কিছু বললেই তাকে ঘৃণাভাষণ বলে দেখানো হয়।…… অথচ ট্রাম্প, মোদি, মিলেই এবং আমি গণতন্ত্র রক্ষা করি, হুমকি দিই না’।
বিগত পার্টি কংগ্রেসে নির্বাচনী রণকৌশল ব্যাখ্যা করার সময়ই আমরা বলেছিলাম, বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, পরাস্ত করতে হবে। এই ছিল দেশের জনসাধারণের সামনে আমাদের আহ্বান। এবারের পার্টি কংগ্রেসকে সামনে রেখে রাজনৈতিক প্রতিবেদনের খসড়া প্রতিবেদনের সঙ্গে গত কংগ্রেসে নির্ধারিত কাজের সমীক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এ দুটি দলিলে উল্লিখিত বক্তব্য নিয়ে পার্টি কর্মী, সমর্থক এমনকি সাধারণ মানুষও নিজেদের মতামত জানাতে পারেন। এই পদ্ধতি আর কোন দলে আছে?
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি প্রসঙ্গে আলোচনা করার সময়েও আমাদের নয়া ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। এ বিপদ সম্পর্কে এখনও পার্টির সর্বস্তরে যথাযথ সচেতনতা রয়েছে এমন নয়। এমন কেউ কেউ রয়েছেন যারা বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস ও আরএসএসকে সমান গুরুত্বে বিবেচনা করেন। বিশ্বজুড়ে নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে মোদী সরকার কিভাবে এগোচ্ছে তাকে পর্যালোচনা করার সময় কোনও একটি আঞ্চলিক দলকে বিজেপির সঙ্গে এক গুরুত্বে বিবেচনা করা সঠিক নয়। এভাবে বিজেপির বিপদকে খাটো করে দেখার ফলেই তৃণমূল কংগ্রেসকে হারানোর জন্য বিজেপিকে বিকল্প ভেবে নেওয়া হয়। আমাদের কর্মী সমর্থকদের একাংশের মধ্যে এমন ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে। এটাই মতাদর্শের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এর প্রভাবে একদিকে যারা কোনদিন বিজেপিকে ভোট দিতে পারবেন না তাদের সাথে আমাদের বিচ্ছিন্নতা বেড়ে চলেছে, আবার অন্যদিকে আদিবাসী, তফশিলি মানুষের মধ্যে বিজেপির প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, মতাদর্শগত ভাবে বিজেপি’র অবস্থান সম্পর্কে কর্মী সমর্থকদের একাংশ দৃঢ় অবস্থান নিতে না পারার কারনে।
আজকের পরিস্থিতিতে আক্রমণ বহুমুখী। আক্রমণ বহুমুখী হলে লড়াই করতে হয় সমস্ত ফ্রন্টে। মতাদর্শ, রাজনীতি (অর্থাৎ রণনীতি ও রণকৌশল), সংগঠন - এই সমস্ত ক্ষেত্রে আক্রমণের মোকাবিলা করার উপযুক্ত সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। সংগঠনকে সেই লক্ষ্যে সাজিয়ে তুলতে হয়, উপযুক্ত করতে হয়। সময়ের চাহিদা সবটা আমরা পূরণ করতে পারছি না, একে আত্মসমীক্ষার দৃষ্টিতেই বিচার করতে হবে। হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বলে যা চলছে তার মূল কথা সাম্প্রদায়িক, পুরুষতান্ত্রিক উচ্চবর্ণের শাসন। এর প্রভাব যে মানুষের চেতনার গভীরে কতদূর অবধি প্রসারিত তাকে সবসময় চেনা যায় না। মনে রাখতে হবে হিন্দু আর হিন্দুত্বের অর্থ এক না। একথা আমাদের নয় - সাভারকার, গোলওয়ালকার'রা অনেক আগে নিজেরাই স্পষ্ট কথায় লিখেছিলেন, ‘হিন্দু ও হিন্দুত্ব এক নয়, হিন্দুত্ব হল এক রাজনৈতিক প্রকল্প’। হিন্দুত্বের রাজনীতির মোকাবিলা করার সময় হিন্দু ধর্মে আস্থাশীল সাধারণ মানুষকে আঘাত, অপমান করা চলে না। কিছু কিছু অতি বিপ্লবী রয়েছেন যারা হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে হিন্দুদের আক্রমণ করে বসেন, এটা মোটেই আমাদের বোঝাপড়া না।
মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন এগুলিই হল কমিউনিস্টদের হাতিয়ার। আজকের পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের চারটি ক্ষেত্রে মূল দুর্বলতা কোথায়? আশু ও আদায়যোগ্য দাবিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, অগ্রাধিকার দিতে হবে। অনেক ন্যায্য দাবীর মধ্যে যে আহ্বানে সবচেয়ে ব্যাপক ও সবচেয়ে দ্রুত মানুষকে সংগঠিত করা যায় সমবেত করা যায়, সেটাই আশু দাবী। এমন সব দাবীতে লড়াই করতে হবে, যা আদায় করা যাবে। এর অর্থ আমাদের মৌলিক দাবীকে পরিত্যাগ করা নয়। মৌলিক দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রামের আগে ছোট বড় একাধিক আশু ও আদায়যোগ্য দাবীকে আদায় করতে হয়।
এ কারণেই আমরা বলি শক্তিশালী বুথ সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন। অনেকে বুথ বলতে নির্বাচন বোঝেন, নির্বাচনী সংগ্রাম বোঝেন। এমন মনোভাব আসলে স্লোগান সম্পর্কে অর্ধেক উপলব্ধি। বুথ মানে শুধু নির্বাচন না, বুথ মানে এক একটি নির্দিষ্ট এলাকা। সেই এলাকায় অনেক পাড়া, অনেক ছোট গ্রাম থাকে। দুর থেকে দেখে যাকে একটা আস্ত এলাকা বলে মনে হয়, তার এক একটি অংশ অন্যের থেকে আলাদা হয়ে বসবাস করে। বাইরের দিকে বড় রাস্তার ধারের বাড়িগুলি অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ঘর, অনেকে ঐ অবধি পৌঁছেই থেমে যান। ভিতরে ঢোকেন না। ঢুকলে দেখবেন আদিবাসীদের পাড়া, মুসলমান সংখ্যালঘুদের এলাকা। সেই সব এলাকার দাবীকে চিনতে হয়, চিহ্নিত করতে হয়। গণসংগঠন বিশেষ করে ছাত্র, যুব, মহিলারা প্রথমে ইনসাফ যাত্রা এবং তারপরে ব্রিগেড সমাবেশ আয়োজন করার সময় সেই কাজ করেছিল।
গনসংগঠনের পাশপাশি চালাতে হবে শ্রেণীসংগঠনগুলির লড়াই। আগামী এপ্রিল মাসে শ্রেণী সংগঠনগুলির ঐক্যবদ্ধ আহ্বানে ব্রিগেডে সমাবেশ হবে। এমন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনায় মূল দায়িত্ব পালনের প্রশ্নে আমরা নিজেদের বোঝাপড়ায় স্থির করেছিলাম যে, এলাকায় যে সংগঠনের শক্তি বেশি সেই হবে মূল আহ্বায়ক, সংগঠক। এভাবেই কৃষক, খেতমজুর, বস্তি এবং ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্ট যে যার নিজস্ব ভূমিকা পালন করে এগিয়ে চলবে।
মার্কসবাদের জন্মলগ্নের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে মার্কস এঙ্গেলস নিজেদের প্রাথমিক পর্বের রচনায় অনেকবার ‘মাস’ (অর্থাৎ জনসাধারণ) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মার্কস যে সময়ে লিখেছেন, ‘মাস’ বলতে তখন যাদের বোঝানো হত, তার একশো বছর আগে ঐ শব্দের অর্থ ছিল অন্যরকম। পরবর্তীকালে তাদের লেখায় ‘মাস’ এর পরিবর্তে প্রলেতারিয়েত শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এরই বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে আমরা সর্বহারা শব্দের ব্যবহার শুরু করি। কমিউনিস্ট ইশতেহারেও তাই ব্যবহৃত হয়েছে। আজকের প্রেক্ষিতকে উপলব্ধি করতে ইশতেহারে দেওয়া ব্যাখ্যাকে আমাদের স্মরণে রাখতে হয় - সর্বহারা হল আধুনিক শ্রমিক শ্রেণী। উৎপাদনের কোনও উপকরণেরই মালিকানা তাদের নেই, বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রি করতে তারা বাধ্য। একথা উল্লেখ করছি কেন? কারণ আগামী ব্রিগেড সমাবেশের আয়োজনের জন্য যে চারটি সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাদের সদস্যেদের মধ্যে ব্যাপক অংশই আজকের ভারতে সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত।
আমাদের পার্টি কর্মসূচিতে গরীব চাষী সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা রয়েছে তাতে এদের সর্বহারা বলতে কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয়। এদের জমি প্রায় নেই বললেই চলে, অল্প যেটুকু যা রয়েছে তারা সেসব লিজ দিতে বাধ্য হয়। একটা সময় ছিল যখন চাষীরা লিজে জমি নিত। এখন আর পশ্চিমবঙ্গে সেই পরিস্থিতি নেই, রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটেছে। খেতমজুর ও গরীব চাষী আর গ্রামে থাকতে পারছেন না। গ্রামের ঘর তালাবন্ধ করে অন্যত্র কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন, যাদের আমরা পরিযায়ী শ্রমিক বলছি তারা সর্বহারা নয় তো আর কি? মাঝারি চাষীদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এমনকি বড় চাষীদের একটা অংশের অবস্থা নিম্নগামী। আগেকার বাংলায় জমিদার, ধনী যাদের কথা আমরা শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় পড়েছি, সেই অবস্থা এখন নেই। এখন গ্রামে নব্য ধনীদের (নিও রিচ) উত্থান ঘটছে। এরা নানাভাবে বিরাট সম্পদের মালিক হয়েছে, মূলত লুটেরা পুঁজির (ক্রোনি ক্যাপিটাল) জোরে। গ্রামে বসবাসকারী এক বিরাট অংশই সর্বহারা শ্রমজীবী মানুষ। আশু আদায়যোগ্য দাবি আদায়ের ভিত্তিতেই এদের সংগঠিত করতে হবে। এই কাজে সফল হলে ব্রিগেডের সমাবেশ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।
আবার শুধুমাত্র ব্রিগেডের সমাবেশ নিয়েই আটকে থাকলে চলে না, ব্রিগেডের সমাবেশ ভালো হল কিন্তু পাড়ায় বস্তিতে গ্রামে গ্রামে লোক পাওয়া গেল না, এমনটা হলে এই লুটেরাদের রাজত্ব শেষ করা যাবে না। তাই আমরা বলছি সমাবেশের জন্য ব্রিগেডের পাশপাশি পাড়ায়, মহল্লায়, বস্তিতে ব্রিগেড তৈরি করতে হবে। সেই জমায়েত তখন গ্রামের ধনী চাষীদেরও নিজেদের দিকে টানবে। মনে রাখতে হবে আজকের অবস্থায় ধনী চাষীও উৎপাদিত ফসলের দাম পাচ্ছে না, তাই তারাও এই অবস্থার নিরসন চাইছে। সময়োপযোগী পার্টি কর্মসূচিতে আমরা উল্লেখ করেছিলাম, মধ্যবিত্ত দু’রকম, উচ্চ এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত। প্রভাত পটনায়েক লিখেছিলেন উচ্চ মধ্যবিত্তের আট শতাংশ ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামীণ শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ সমাবেশ এলাকার রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে দিতে পারে।
আরেকটি অংশ রয়েছে। যারা বিদেশে কর্মরত, এতদিন সেখানেই কাজ করেছেন, রোজগার করেছেন এবং বসবাস করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে ঐ সব কাজ আর থাকবে না। বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের দেশেই ফিরে আসতে হবে। তাই আমরা বলছি দেশজুড়ে শ্রমজীবী মানুষকে ব্যাপক আকারে সংঘবদ্ধ করার বাস্তব পরিস্থিতি রয়েছে। এই কাজই আমাদের সম্পন্ন করতে হবে।
এবার সমবেত করার কাজে সাফল্যের প্রশ্ন। একাজে আমাদের সামনে প্রধান বাধা আমাদের পুরানো অভ্যাস। এখনও আমরা ধরে নিই আমরা ডাকলেই শ্রমজীবী মানুষ ছুটে চলে আসবেন। মনে রাখতে হবে সংগ্রামের উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়ার আহ্বানেরও প্রকারভেদ রয়েছে। এমনভাবে সেই আহ্বান জানাতে হবে যা শুনে কেউ সেই ডাক ফেরাতে পারবে না, না এসে থাকতে পারবে না। তাই বলা হয় মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন ও সংগ্রাম আলাদা শব্দ হলেও, একটির থেকে অন্যটিকে আলাদা করে এদের বিচার বিবেচনা করা যায় না। এখানেই সংগঠনের কাজে সজীব, প্রাণবন্ত থাকার প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। সামনে আসে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন, অর্থনীতি ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ বিচারবাদ (মেটিরিয়ালিজম অ্যান্ড ইম্পিরিও ক্রিটিসিজম) লেখার সময় লেনিনের ভূমিকা স্মরণে রাখা দরকার। সেই সময় দুনিয়াজুড়ে বিজ্ঞানের জগতে একের পর এক বিরাট আবিষ্কার ঘটছিল। অনেকেই সেই অবস্থাকে পদার্থবিদ্যার সংকট (ক্রাইসিস ইন ফিজিক্স) বলে চিহ্নিত করেছিলেন। লেনিন বললেন, এই পরিস্থিতি আসলে পদার্থবিদ্যায় বিপ্লব (রেভলিউশন ইন ফিজিক্স)। প্রযুক্তির বিশাল অগ্রগতি হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। তবে মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তি ও তার ব্যবহারও শ্রেণি নিরপেক্ষ হয় না। যে শ্রেণি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাখে, সে তার নিজের শ্রণির মুনাফার স্বার্থেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এবং তাকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখে। এই হল কমিউনিস্ট উপলব্ধি। বিদ্যমান পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিচার ও সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ, এই উপলব্ধি ব্যাতিরেকে মতাদর্শের চর্চা হয় না, কমিউনিস্টদের কাজ এগোয় না।
সমস্ত কাজের সুর, তাল, লয়, ছন্দ থাকে। প্রত্যেক রাজনৈতিক শক্তিই নিজস্ব কাজের ছন্দে এগিয়ে চলে। এখানেও দ্বন্দ্ব রয়েছে আবার ঐক্যও রয়েছে। এ দু’য়ের আন্তঃসম্পর্ক একে অন্যকে সামনে ঠেলে দেয়, ঘটনাবলী এগিয়ে চলে। সময়ের দাবি মেনেই নির্ধারিত কাজের ছন্দ গড়ে ওঠে, সময়ের নিয়মেই আবার সে ছন্দ ভেঙ্গেও যায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, একে না বুঝে মানুষের মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না, যাবে না। অনেক সুর তাল ছন্দের মাঝে হারমনি (সমন্বয়) প্রতিষ্ঠা করতে হয়। সংগঠন সে কাজটাই করে, সময়ের দাবি পূরণে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলাফল। আমাদেরও নিজেদের কাজে সেই সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনে রাখতে হয় হাতের পাঁচটি আঙ্গুলে হারমোনিয়ামের পাঁচটি রিড একসাথে চেপে ধরলেই ছন্দ তৈরি হয় না। সুরের ছন্দ প্রকাশ করার জন্য পাঁচটি আঙ্গুলকে নিজেদের মধ্যে ছন্দ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। প্রকৃতিতে যেমন বিভিন্ন রিড, সংগঠনেও তেমনই একাধিক পক্ষ থাকে। সেই সমস্ত পক্ষের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য, বিভিন্ন মতামত ইত্যাদি থাকে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গোটা সংগঠনকে একসাথে মিলে লক্ষ্যে সফল হতে গেলে নিজেদের ছন্দবদ্ধ করতে হয়। আমাদের সেই ছন্দ আয়ত্ত করতে হবে। তবেই আঁধারের জাল ছিন্ন হয়ে আকাশভরা সূর্য তারা ফুটে উঠবে। চিন্তার ঐক্য থেকে কাজের ঐক্য নির্মাণ করতে হয়। চিন্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্যই পার্টির সম্মেলন আয়োজিত হয়, কাজের ঐক্য হল সংগ্রামের জন্য সংগঠনের সমবেত প্রয়াস।
আজকের সময় কেবল আক্রমণের ইতিহাস নয়, আজকের পরিস্থিতি শুধুই পিছিয়ে যাওয়ার দিনলিপি নয়। আজকের পরিস্থিতি লড়াই, সংগ্রাম, প্রতিরোধেরও সাক্ষী। সেই সংগ্রামকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, দেশজুড়ে শ্রমজীবী জনসাধারণের সংগ্রামী ঐক্যই লড়াইয়ের নতুন ছন্দ, নতুন ইতিহাস নির্মাণ করবে।
(ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ২৭ তম সম্মেলনে কমরেড সূর্য মিশ্র প্রদত্ত ভাষন।)
Comments :0