Judiciary on attack

আদালতের মুখেও লিউকোপ্লাস্ট লাগাতে চায় তৃণমূল !

ফিচার পাতা

সুপ্রিয় ব্যানার্জি

কলকাতা হাইকোর্টে এজলাস বয়কট বা কোর্টকে সন্ত্রস্ত করে রাখার প্রয়াস কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আইন ব্যবস্থা বা বিচার ব্যবস্থাকে হেনস্তা করার ঘটনা পরিকল্পিত কর্মসূচী। পছন্দের নির্দেশ আদায় এবং অপছন্দের নির্দেশ হলে বিচারপতিকে হেনস্তা করার প্রচেষ্টা অবিরত চলছে। 
হাইকোর্টে বিচারপতি রাজশেখর মানথার বিরুদ্ধে তৃণমূলের কর্মসূচি আদালতের বাইরেই তৈরি হয়েছে। বিচারপতির বাড়ির সামনে পোস্টার মারা এবং এজলাস বয়কট করার সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র আইনজীবীরাই নিয়েছেন এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। বিচারপতি মানথার বাসস্থান নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। পোস্টারে সেই বাসস্থান নিয়ে মিথ্যা রটানো হয়েছে। এই পোস্টার সাঁটানো এবং বিচারপতি এজলাসের সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মধ্যে আলাদা কোনও মাথা নেই। এই ঘটনা তৃণমূল ঘটিয়েছে এটা দিনের আলোর মতই স্পষ্ট এবং এই প্রবণতা বিচ্ছিন্ন নয়। 
শুধু বিচারপতি রাজশেখর মানথার এজলাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা পোস্টার মেরে বিচারপতির সামাজিক সম্মান নষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে, সেটা নয়। এর আগে বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাসে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি’র নির্বাচনী মামলা উঠলে তৃণমূলের আইনজীবীরা এজলাস পরিবর্তনের দাবিতে মিছিল করেছেন। বিচারপতি চন্দ মমতা ব্যানার্জির মামলার শুনানি গ্রহণ করেননি। বিচার ব্যবস্থার ওপর আক্রমণের পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। বিচারপতিদের অসম্মান এবং আতঙ্কিত করে রাখার চেষ্টা চলছে।


তবে আইন ব্যবস্থা এবং সংবিধানের বিরোধিতায় বিজেপি এবং তৃণমূল কার্যত একই পথে চলছে। 
দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর ন্যূনতম সম্মান দেখানোর মনোভাব বিজেপিরও নেই। অযোধ্যা বাবরি মসজিদ, রাম জন্মভুমি নিয়ে শীর্ষ আদালতের রায় নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে এই রায় সাদরে গ্রহণ করেছে বিজেপি। সাম্প্রতিক সময়ে নোটবন্দি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বিজেপি সরকারের পক্ষে গেছে। এতে খুশি বিজেপি। যদিও এই নির্দেশ নিয়ে শীর্ষ আদালতের বিচারপতিদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। বিজেপি’র পক্ষে নির্দেশ হলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু নির্দেশ বিপক্ষে গেলেই বিচাপতিদের বদলি এবং বিচাপতিদের সমালোচনায় মুখর আরএসএস। সংবিধানে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার যে মৌলিক উপাদানগুলির কথা বলা রয়েছে তা মানেন না রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ভাগবত বলেছেন, হিন্দু সমাজ যুদ্ধে রয়েছে, যুদ্ধের সময় আগ্রাসী মনোভাব থাকে। এই বক্তব্য কার্যত দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রছন্ন হুমকি। দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক বলে তিনি এই বক্তব্যকে সামনে রেখেছেন। ভাগবতের এই বক্তব্য দেশের সংবিধান এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ। 
অন্যদিকে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার বিচারপতি নিয়োগে যে কলেজিয়াম গঠিত রয়েছে তার সুপারিশগুলিও কার্যকরী করতে ঢিলেমি করছে। কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা এই কলেজিয়াম পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা করছেন। বিচারপতিদের সঙ্গে বিবাদেও জড়িয়ে পরছেন। সম্প্রতি জয়পুরে সংসদ এবং বিধানসভার অধ্যক্ষদের নিয়ে একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে ধনখড়ের পরিচয় রয়েছে। সেই সভায় উপরাষ্ট্রপতি এই কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে তুমুল সমালোচনা করেছেন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে এটা ঠিক কথা নয়। প্রসঙ্গত,  সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন। কিন্তু কলেজিয়ামের সুপারিশ কার্যকর করতে প্রচুর সময় নিচ্ছে সরকার। পছন্দের নাম হলে তা কার্যকরী হচ্ছে, নচেৎ ফাইল পড়ে থাকছে।


ঠিক একইভাবে রাজ্যে তৃণমূল আইন ব্যবস্থাকে পরোয়া করে না। আরএসএস’র বন্ধু শক্তি টিএমসি বিচারপতিদের চরম হেনস্তা করার পথেই চলছে। 
কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি রাজশেখর মানথার এজলাস গায়ের জোরে বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে তৃণমূল। এক কথায় তৃণমূল মনে করেছে শুভেন্দু অধিকারীকে বিচারপতি মানথা আইনি সুরক্ষা দিয়েছেন। অভিষেক ব্যানার্জি এবং তাঁর পরিবারকে এই সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। এর আগে বেশ কয়েকটি মামলায় এজলাস বদলের দাবি তুলে বিচারপতিদের বয়কট করার চেষ্টা হয়েছে। বিচার ব্যবস্থাকে সন্ত্রস্ত করে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে তৃণমূল। এই কাজে তারা ব্যবহার করছে কলকাতা হাইকোর্টে বার অ্যাসোসিয়েশনের নাম। যদিও বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অরুণাভ ঘোষ বলেছেন, এজলাস বয়কটের প্রস্তাব বারের কোনও সভায় গৃহীত হয়নি। এনিয়ে কোনও সভাই হয়নি। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিদের সন্ত্রস্ত করার ঘটনা মনে করিয়ে দেয় আসানসোলে সিবিআই আদলতের বিচারককে হুমকি চিঠি পাঠানোর কথা। তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের জামিন মামলায় আসানসোলের সিবিআই আদালতের বিচারক হুমকি চিঠি পেয়েছিলেন। ওই চিঠিতে বিচারক এবং তাঁর পরিবারকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। বিচারপতি রাজশেখর মানথাকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র বলেছেন, ‘‘এটা কী হচ্ছে? এবার তো ওরা বিচারপতিদের মারধর করবে।’’ আইনজীবী জয়ন্ত মিত্র তৃণমূল আমলেই অ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। তৃণমূল আমলে বহু প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্বভার পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউই পূর্ণসময় কাজ করতে পারেননি। এঁদের মধ্যে রয়েছেন আইনজীবী বিমল চ্যাটার্জি, আইনজীবী কিশোর দত্ত সহ অনেকেই। কলকাতা হাইকোর্টে তৃণমূলের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি বলেছেন, ‘‘ভারতের সংবিধান এবং বিচার ব্যবস্থা কোনও ঠুনকো বিষয় নয়। কেউ এই ব্যবস্থাকে সন্ত্রস্ত করতে পারবে না। বিচারপতিরা এর বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ করবেন।’’
শাসক দলের অনুগামী আইনজীবীদের এই পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালত অবমাননার স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু হয়েছে হাইকোর্টে। বিচার প্রক্রিয়ায় জোর করে বাধা দেওয়ার কারণে বিচারপতি রাজশেখর মানথার এজলাসে এই মামলা রুজু হয়েছে মঙ্গলবার। ওই দিনই প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ভট্টাচার্য বলেন, দেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী এই আদালতের গরিমা রয়েছে। বার অ্যাসোসিয়েশনের উচিত এব্যাপারে দায়িত্ব নেওয়া। বিচারপতি রাজশেখর মানথা’র এজলাস বয়কটের দাবিতে বিক্ষোভের বিরোধিতা করে কলকাতা হাইকোর্টে বহু আইনজীবী একত্রিত হয়ে প্রধান বিচারপতির ঘরে আদালত অবমাননার পৃথক একটি মামলার দায়ের করেছেন। এই দুটি মামলার এক সঙ্গে শুনানি হবে। সাধারণত এই বিষয় নিয়ে মামলার শুনানির গ্রহণের জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠিত হয়ে থাকে। প্রধান বিচারপতি গোটা বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে বেআইনি নিয়োগের ঘটনা সামনে আসার সময় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস বয়কট এবং এজলাস বদলের দাবি নিয়ে তৃণমূলের আইনজীবীরা একই কায়দায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল।


বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা রুজু হওয়ার পর আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন— এই গোটা তৃণমূল দলটাই আইন মানে না, যুক্তি মানে না। গুন্ডামির পথে বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ে যেতে যায়। এটা একটা পরিকল্পিত ফ্যাসিস্ত কায়দার প্রয়াস। আদালতের নির্দেশ তাদের পক্ষে না গেলেই বিচারপতিদের অপমানিত করা, বিচারপতিদের আতঙ্কিত করে রাখার চেষ্টা শুরু হয়েছে। বিচার ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই এই ঘটনার মোকাবিলা হবে। তবে মানুষের কাছে তৃণমূলের মুখোশ খোলার কাজেও নামতে হবে।
 

Comments :0

Login to leave a comment