লোকসভা নির্বাচন যতোই এগিয়ে আসছে বিজেপি’র রাজনৈতিক বিরোধিতার বদলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ততোই সিপিআই (এম) এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ন্যায়যাত্রা পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার পর থেকেই তৃণমূল তার বিরোধিতা করেছে। তৃণমূলের সরকার এই কর্মসূচিকে প্রতি পদক্ষেপে বাধা দিয়েছে, অসহযোগিতা করেছে। এমনকি এরাজ্যের বুকে রাহুল গান্ধীর গাড়িতে পাথর ছুঁড়ে গাড়ির কাচ ভেঙে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী এসবের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলেননি। উলটে তিনি এই কর্মসূচির জন্য কংগ্রেসকেই দুষেছেন। কলকাতার রেড রোডে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে ধরনা অনুষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু সেখান থেকেও বিজেপি বিরোধিতার চেয়ে কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)’র বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন বেশি। সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করেছে বলে যে বস্তাপচা আজগুবি অভিযোগ তিনি দীর্ঘদিন করতেন সেটাও পুনরায় বলেছেন। কিন্তু বিজেপি বিরোধী সর্বভারতীয় মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র গুরুত্বপূর্ণ শরিক কংগ্রেস আদৌ তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক আসন পাবে না বলে মমতা ব্যানার্জি যে মন্তব্য করেছেন তাতে বিজেপি ছাড়া আর কারো উল্লসিত হওয়ার কথাও নয়। এই সব কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রী কার স্বার্থ পূরণ করতে নেমেছেন?
বিজেপি’র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ‘ইন্ডিয়া’ বিজেপি বিরোধীদের একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ব্লক। বিহারের নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ তাতে থাকলেও অতি সম্প্রতি ছেড়ে চলে গিয়েছে ফের বিজেপি শিবিরে। মমতা ব্যানার্জির ধারাবাহিক আচরণেও তাই এই সন্দেহ স্বাভাবিক যে তাঁর গন্তব্য কোনদিকে হবে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ঘোষণা করে জানিয়ে দিচ্ছেন যে তিনি ইন্ডিয়ার সঙ্গে এবং কংগ্রেস দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করছেন। আরও হাস্যকর ঘটনা হলো এর জন্য তিনি সিপিআই(এম)’কে দায়ী করছেন। সিপিআই(এম) ‘ইন্ডিয়া’কে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ করছেন। কিন্তু তৃণমূল তৈরি হওয়ার পরে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টকে হারানোর জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে থাকা ছাড়া আর কোনও লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল ছিল না। ১৯৯৯ এবং ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ছিল বিজেপি’র সঙ্গী। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালেও মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন না। অর্থাৎ তৃণমূলের অতীত রেকর্ডই চিনিয়ে দিচ্ছে তার স্বাভাবিক মিত্রকে। তৃণমূল এবং বিজেপি’র সেই সম্পর্কের পিছনে দুই দলেরই তীব্র সিপিআই(এম) বিরোধিতা এবং বাংলা থেকে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার তাগিদ থাকতে পারে, কিন্তু আজকের দিনে মমতা ব্যানার্জির রাজনীতিতে যদি সত্যিই বিজেপি বিরোধিতা থাকে তাহলে সিপিআই(এম) কীভাবে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মাঝখানে বাধা সৃষ্টি করতে পারে তার ব্যাখ্যা মিলছে না। গুজরাট গণহত্যার পরেও মমতা ব্যানার্জির মোদীকে ফুল পাঠানোর কোনও ব্যাখ্যা নাকি প্রয়াত তৃণমূল সাংসদ কৃষ্ণা বসু খুঁজে পাননি। নিজের আত্মজীবনীতেই কৃষ্ণা বসু লিখে গিয়েছেন, ‘গুজরাট গণহত্যার পরে মমতা ও দলের নীরবতার ব্যাখ্যা আমার অজানা।’
নীতীশ কুমারের ডিগবাজির ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব যেমন নীতীশ কুমারের, তেমনই ইন্ডিয়া থেকে দূরত্ব বাড়ানোর ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব তৃণমূলের, এবং নির্দিষ্টভাবে মমতা ব্যানার্জির। অন্যথায় এই নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই থাকে না যে বিজেপি বিরোধীদের রাজনৈতিক অভিযানের ইন্ডিয়া মঞ্চে যাত্রাসঙ্গী হয়েছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁর গন্তব্য আলাদা। বিজেপি’র বিরোধিতার বদলে বিজেপি’র সুবিধা করে দেওয়ার লক্ষ্যেই তিনি ইন্ডিয়াতে ঢুকেছিলেন এবং এখন বের হওয়ার পথ তৈরি করছেন, ভবিষ্যতেও বিজেপি’র সুবিধা অনুযায়ী নিজের অবস্থান নির্ধারণ করে নেবেন। কেন্দ্রের শাসকদলের হাতে সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতো নাচা ছাড়া তৃণমূলের যে অন্য কোনও উপায় নেই সেটা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দলটির নেতাদের লাইন দিয়ে জেলযাত্রা দেখলেই বোঝা যায়। দুর্নীতির তদন্ত থেকে বাঁচার তাগিদে দল এবং দলের রাজনীতিকে মমতা ব্যানার্জি বন্ধক দিয়েছেন, তাই বিজেপি বিরোধিতার নাটকের আড়ালে ইন্ডিয়ার থেকে দূরত্ব বাড়ানো ছাড়া তাঁর অন্য কোনও গতি নেই।
Comments :0