চন্দন দাস
রামমন্দিরের উদ্বোধন হবে আগামী ২২জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করবেন। তারপর কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট হওয়ার কথা। তারপর— হতে পারে লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা। আমরা নির্বাচনী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ব। মমতা ব্যানার্জি ২২জানুয়ারি কলকাতায় মিছিল করবেন কালীঘাটে পুজো দিয়ে। যদিও বাবরি মসজিদ ভেঙে মন্দির বানানোর লক্ষ্য ঘোষণা করে প্রকাশিত এনডিএ’র ইশ্তেহারে সই ছিল তাঁর।
কিছুদিন আগে, গত ৭জানুয়ারি বিরাট সমাবেশ হলো। সাহসী পদযাত্রার পর বিপন্ন সময়ের দাবি স্পষ্ট দাখিল করেছে জনপ্লাবন— ব্রিগেডে। এখন, এই পরিবেশে তার কী হবে?
অনেকের আশঙ্কা আগামী ২২জানুয়ারির পর রাজনীতির যাবতীয় অ্যাজেন্ডা ম্লান হয়ে পড়বে। মানুষের সব দাবি, আকাঙ্ক্ষা চাপা পড়ে যাবে পৌরাণিক রামচন্দ্রর ঘর পাওয়ার সমারোহে। সঙ্ঘ, বিজেপি তাই চায়, সেটিই তাদের কৌশল। দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম বিজেপি’র প্রচার যন্ত্র হয়ে উঠেছে। ফলে এই পরিস্থিতিতে ‘মন্দির নির্মাণ’কে করে তোলা হবে প্রধান আলোচ্য বিষয়— আশঙ্কা এমনই। ‘মন্দির নির্মাণের সাফল্য’-র ভিত্তিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রচারে বিজেপি সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। পিছনে আছে সঙ্ঘ পরিবার। ইতিমধ্যেই মোবাইল, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ খুললে পাওয়া যাচ্ছে নানা লিঙ্ক, বিভিন্ন গ্রুপ— যারা লাগাতার এই রাজ্যে হিন্দুত্ব, মন্দির-মহিমা, মোদী-মাহাত্ম্য প্রচার করছে। ব্রিগেড গীতা পাঠের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রাজ্যে প্রায় ৭০০ গ্রুপ তৈরি করেছে সঙ্ঘ পরিবার। যেগুলি অন্তত আগামী লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত প্রবল সক্রিয় থাকবে। প্রতিটির লক্ষ্য এক— হিন্দুত্বের প্রচারে সব ঢেকে দাও। যাবতীয় প্রশ্ন, ক্ষোভ, রাগ— উড়িয়ে নিয়ে যাও হিন্দু পুনর্জাগরণের নিনাদে।
তৃণমূলের পক্ষে এই বিপদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। কারণ— প্রথমত, মমতা ব্যানার্জি তৃণমূল তৈরিই করেছিলেন সঙ্ঘ পরিবারের সাহায্যে, বিজেপি’র সুবিধার্থে। জাতীয় রাজনীতিতে ‘বিজেপি অচ্ছ্যুৎ নয়’— এই বক্তব্য প্রথম শোনা যায় মমতা ব্যানার্জির মুখ থেকে। তাও আনুষ্ঠানিকভাবে তৃণমূল তৈরির আগে— ১৯৯৭-র ডিসেম্বরে। দেশের বামপন্থী আন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটিতে কমিউনিস্টদের যেনতেনপ্রকারেণ কোণঠাসা না করতে পারলে দেশে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুর্বল করা যেত না। তাই খুন করে, অস্ত্রের জোরে এলাকা দখল করে, ‘শিশুদের পা চিরে ভাসিয়ে দেওয়া’-র মতো মিথ্যা প্রচার চালিয়ে, কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে ঘৃণা তৈরি করে এগিয়েছে তৃণমূল— আরএসএস’র পরিকল্পনা মাফিক।
দ্বিতীয়ত, এনডিএ জোটের শরিক হিসাবে তিনি অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে ছিলেন। ২০০৪-র ৮ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে এনডিএ’র নির্বাচনী ইশ্তেহার প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে রামমন্দির নির্মাণকে এনডিএ’র অন্যতম লক্ষ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আর সেই ইশ্তেহারে স্বাক্ষর করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সেই ইশ্তেহার প্রকাশ করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। ইশ্তেহার প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মঞ্চে জর্জ ফার্নান্ডেজের পাশে হাজির ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কেন স্বাক্ষর করলেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন,‘‘আরে, রামমন্দির তো সাব জুডিশ ম্যাটার।’’ তাতে কী রামমন্দির নির্মাণ স্লোগানের চরিত্র বদলে যায়? ওই ২০০৪-র ১১ এপ্রিল সিপিআই(এম) তৎকালীন রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড অনিল বিশ্বাস মমতা ব্যানার্জি-আরএসএস’র বোঝাপড়া সম্পর্কে বলেছিলেন,‘‘আরএসএস’র পরগাছা হয়ে রাজ্যে কাজ করছে তৃণমূল কংগ্রেস।’’
আজ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেও মমতা ব্যানার্জি সঙ্ঘের ধারাপাত মেনেই এগচ্ছেন। মানুষের করের টাকায় মন্দির বানানো, ধর্মীয় অনুষ্ঠান চালানো তৃণমূল সরকারের প্রকল্প হয়ে উঠেছে। তিনিই জানিয়েছেন, ধর্মীয় সংস্থাকে দেদার জমি দেওয়া ছাড়াও ৭০০কোটি টাকা খরচ করেছেন মন্দিরের জন্য। দীঘায় জগন্নাথের সরকারি মন্দির প্রায় তৈরি। তিনি সঙ্ঘের বিরোধিতা করছেন না। সঙ্ঘের পথে চলছেন। সঙ্ঘের রাস্তা আরও চওড়া করতে নেমেছেন রাজ্যে।
২০১১-য় মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই তাই স্বাগত জানিয়েছিল আরএসএস। ‘প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে দিন’-র পরামর্শ পাঠিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। রাজ্যে গত ১২ বছরে সঙ্ঘর তৎপরতা বেড়েছে। মমতা ব্যানার্জিও সঙ্ঘের ব্লু প্রিন্ট অনুসারে এগিয়েছেন। শাসক দলের নেতারা রামনবমীতে অস্ত্র হাতে নেমেছেন, মমতা ব্যানার্জি সরকারি টাকায় মন্দির বানিয়েছেন। তিনি নিজেই সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, ৪০০ কোটির বেশি টাকা তিনি মন্দিরগুলির জন্য খরচ করেছেন। আবার সংখ্যালঘুদের গত লোকসভা নির্বাচনের পরে ‘দুধ দেওয়া গোরু’ও বলেছেন। সব মিলিয়ে সমাজে ধর্মের নামে ভাগাভাগির অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে তৃণমূল। যা হিন্দুত্বর দর্শনের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। দ্বিতীয়ত, রাজ্যে বিজেপি’র দেখানো পথেই সরকার চলেছে। ২০১১-র আগে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। ওডিশা, গুজরাটের মতো রাজ্যগুলিকে বিনিয়োগে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল। এখন, গত ১২ বছরে পশ্চিমবঙ্গ মূলত অন্য রাজ্যের জন্য সস্তা শ্রমের বাজার হয়ে উঠেছে। কম মজুরিতে লেবার পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গে। এখানে কাজ নেই। শিল্পের উদ্যোগ নেই— কেবল মুখ্যমন্ত্রীর অবাস্তব ঘোষণা আছে। তৃণমূল চুরি করেছে। সেই সুযোগে বিজেপি রাজ্যে একশো দিনের প্রকল্প বন্ধ রেখেছে। রাজ্যে রেগায় কাজ না পেয়ে আরও গ্রামবাসী ভিন রাজ্যে ছুটেছেন। রেগার কাজে খরচ কমানো বিজেপি’র দীর্ঘদিনের লক্ষ্য। তাদের সুবিধা করে দিয়েছে তৃণমূলের চুরি। আবার বিজেপি’র অর্থনীতি মেনেই রাজ্যে স্থায়ী নিয়োগ বন্ধ করেছেন মমতা ব্যানার্জি। ২০১৮-র জুনে রাজ্য সরকার তৈরি করেছে ‘স্টেট লেবেল কমিটি অন র্যা শানালাইজেশন অ্যান্ড অপটিমাল ইউটিলাইজেশন অব হিউম্যান রিসোর্স।’ যার লক্ষ্য শূন্য পদগুলি অবলুপ্ত করা। ঘুষ নিয়ে শিক্ষকের চাকরি দিতে গিয়ে রাজ্যের কয়েক হাজার যোগ্য যুবকের ভবিষ্যৎ প্রায় অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রীরা। যাঁরা ২০১১-তে তথাকথিত ‘পরিবর্তন’-র স্লোগানে বিশ্বাস করে মমতা ব্যানার্জিকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের বড় অংশ তৃণমূলকে ‘বেইমান’ বলছেন। তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে।
এই তৃণমূল আদপেই বিজেপি-র বিরোধী নয়। বিজেপি-ই রক্ষা করতে পারে মমতা ব্যানার্জির রাজ্যপাট। আবার পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের প্রতি আস্থা ক্রমাগত বাড়তে মানুষের কিছু অংশকেও ভুল অ্যাজেন্ডায় টেনে নিয়ে গিয়ে বিজেপি’র সুবিধা করে দেওয়ার দায়িত্বও আছে মমতা ব্যানার্জির কাঁধে।
এই পরিস্থিতিতেই এসেছিল ৭ জানুয়ারি— ব্রিগেড সমাবেশ। রাজ্যে বামপন্থী শক্তির চেহারা যেমন কিছুটা স্পষ্ট করেছে ৭জানুয়ারি, তেমনই রাজ্য তথা দেশের সমস্যা এবং সমাধান সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য হাজির হয়েছে সেই ব্রিগেডেই— মঞ্চ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষের ভাষ্য।
সমাবেশের পরে মাঠ পরিষ্কার করেছেন ছাত্র, যুব আন্দোলনের নেতা, কর্মীরা। কিন্তু যে দাগ ৭জানুয়ারির ব্রিগেড কেটে দিয়ে গেছে তার চিহ্ন পৌঁছেছে প্রতিটি জেলায়, প্রত্যেক গ্রাম, শহরে। তাৎপর্যপূর্ণ হলো, সমাবেশের আগে পঞ্চাশ দিন পদযাত্রা করেছে রাজ্যের সংগ্রামী তরুণরা। গত ৩ নভেম্বর শুরু হয়েছিল কোচবিহার থেকে। যাদবপুরে শেষ হয়েছিল গত ২২ডিসেম্বর। পদযাত্রার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে ব্রিগেডে। পদযাত্রার সময় ‘টু-ওয়ে কমিউনিকেশন’ হয়েছে। অর্থাৎ, ছাত্র, যুব নেতৃত্ব বিভিন্ন জায়গায় সভা করেছেন। সেখানে তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের স্লোগানের মাধ্যমে পথে তাঁদের দাবি, বক্তব্য পৌঁছেছে গ্রাম, শহরবাসীর কাছে। কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ যেটি ঘটেছে তা হলো— বিভিন্ন জায়গায় মানুষ তাঁদের কথা পদযাত্রীদের বলেছেন। স্থানীয় অনেক সমস্যার বিবরণে পুষ্ট হয়েছে পদযাত্রার ভাণ্ডার। তাছাড়া প্রধান যে সমস্যাগুলির কথা পদযাত্রীদের শুনতে হয়েছে, তা হলো কাজের অভাবের প্রশ্ন। ইনসাফ যাত্রার যে বিবরণ পদযাত্রীরা লিখেছেন, সেগুলিতে চোখ রাখলেও দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থানের অভাবই বিপর্যস্ত করে দিয়েছে বাংলার সমাজজীবনকে। এছাড়া বাড়ি, পানীয় জল, স্কুলগুলির দুর্দশার মতো রাজ্যের গরিব, মধ্যবিত্তর জীবনের সমস্যাগুলিই বেশি শুনতে, বুঝতে হয়েছে পদযাত্রীদের। পদযাত্রীদের একজন ছিলেন ঐশানি বাগচী। তাঁর একটি বর্ণনায় উঠে এসেছে এক কাঙ্ক্ষিত কিন্তু অনবদ্য উপাদান। ওই পদযাত্রী জানাচ্ছেন যে, পদযাত্রার ২৪ তম দিনে তিনি খুবই ক্লান্ত। কিছুতেই উঠতে ইচ্ছা করছে না। তখন তাঁকে হাঁটতে উদ্বুদ্ধ করছেন এক পরিযায়ী শ্রমিক, যিনি লকডাউনের সময় আমেদাবাদ থেকে টানা ২৫ দিন হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন। সেই ২৫দিনের ১২দিন অভুক্ত থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
প্রশ্ন শুধু সেই মানুষটির অভিজ্ঞতা মথিত আবেগ নয়। প্রশ্ন— ইস্যু। সেটি— কাজ, কাজ এবং কাজ। আর চায় বাসস্থান, দুর্নীতিমুক্ত সরকার, শিক্ষার অধিকার। এই ইস্যুগুলি এতটাই মানুষের নিজের যে, সেই ইস্যুতে, তার দাবিতে ব্রিগেড ধারণ করতে পারে বিপুল জনস্রোত। জনস্রোতের বিপুল অংশ তাঁরা— যাঁরা পুরুলিয়া, কোচবিহার কিংবা সুন্দরবনের। কেন্দ্র, রাজ্যের আর্থিকনীতিতে তাঁরা বিপর্যস্ত, তাঁদের জীবন জীবিকা প্রবল সঙ্কটে।
ফলে ব্রিগেডে সময় তার দাবিতে ইতি টানছে না। কাজ এবং মানুষের জীবন-জীবিকা সহ অন্যান্য দাবিতে ধারাবাহিক লড়াই-ই সময়ের দাবি। একইসঙ্গে হিন্দুত্ব এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চক্রান্তের বিরুদ্ধে মানুষের ইস্যুকে প্রতিষ্ঠা করারও এই লড়াই। শাসকদের প্রচার এবং চক্রান্তের মুখোমুখি মানুষের প্রতিবাদ, আশা-আকাঙ্ক্ষার যে প্রমাণ ব্রিগেড পেশ করেছে, তা এবার বুথে বুথে প্রতিষ্ঠা করাই প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব।
Comments :0