MANIPUR VIOLENCE

ভাগাভাগির রাজনীতিতে বিধস্ত মণিপুর
দেখলেই গুলির’ নির্দেশ

জাতীয়

MANIPUR COMMUNAL VIOLENCE BENGALI NEWS

বুধবার থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুনে জ্বলছে মণিপুর। পরিস্থিতি সামলাতে বুধবার থেকে নামানো হয়েছে সেনা। দেখা মাত্র গুলি বা ‘শুট অ্যাট সাইট’-এর নির্দেশও জারি হয়েছে।  উত্তরপূর্ব ভারতের এই রাজ্য এই মুহূর্তে সংরক্ষণ ইস্যুতে দুইভাগ। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেদের অতি পরিচিত চেনা ছকেই বিভাজনের রাজনীতি করছেন সেরাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। বারুদের স্তূপে এসে দাঁড়িয়েছে মণিপুর।

এই সঙ্কটের মূল লুকিয়ে রয়েছে মণিপুরের ভূগোলে। রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল শহর একটি উপত্যকায় অবস্থিত- ইম্ফল উপত্যকা। এই উপত্যকায় মূলত মেইথেই সম্প্রদায়ের বসবাস। মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশই মেইথেই সম্প্রদায়ের মানুষ। মণিপুরের মোট ভূমির মাত্র ১০ শতাংশ নিয়ে ইম্ফল উপত্যকা তৈরি। কিন্তু জনঘনত্ব বেশি হওয়ায় ৬০ আসনের বিধানসভার ৪০জন বিধায়ক এই অঞ্চল থেকেই নির্বাচিত হন। ফলতঃ বিপুল রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করেন মেইথেইরা।  এই সম্প্রদায় মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। রাজধানীর কাছাকাছি থাকার ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকেও শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন মেইথেইরা।

ইম্ফল উপত্যকাকে ঘিরে রয়েছে লুসাইয়ের মতো ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের উল্টোপারে বার্মা। ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়গুলিতে বাস কুকি সহ অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর। জনসংখ্যার শতাংশে তাঁদের অংশীদারিত্ব ঢের কম। একইসঙ্গে আর্থ-সামাজিক দিক থেকেও তাঁরা পিছিয়ে। কুকি গ্রামগুলিতে ঢুঁ মারলেই দারিদ্র চোখে পড়ে। এই আদিবাসী উপজাতিগুলি মূলত খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী।

মণিপুরের সাম্প্রতিক সমস্যা দানা বেঁধেছে মণিপুর হাইকোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করে। আদালতে মেইথেই সম্প্রদায়ের তরফে আর্জি জানানো হয়, তাঁদেরকেও আদিবাসী বা এসটি সংরক্ষণের আওতায় আনতে হবে। আবেদনকারীদের দাবি ছিল, ১৯৪৯ সালের আগে মেইথেই সম্প্রদায়ও আদিবাসী হিসেবেই চিহ্নিত হতেন। ১৯ এপ্রিল আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয়, মেইথেই সংরক্ষণের বিষয়ে সুপারিশ জমা দিতে হবে। 

আদালতের এই সিদ্ধান্তে অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগতে শুরু করেছেন কুকি সহ অন্যান্য আদিবাসীরা। তাঁদের আশঙ্কা, এবার তাঁদের গ্রামে এবং লোকালয়ের জমি দখল করা শুরু করবেন মেইথেইরা। আইন অনুযায়ী, মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতি নন, এমন কেউ জমি কিনতে পারে না। আদিবাসীদের আশঙ্কা, স্বীকৃতি মিললে মেইথেই ব্যবসায়ীরা বিনা বাধায় পাহাড়ি জমি দখল করতে শুরু করবেন। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী মেইথেইদের রোখার কোনও সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থাকবে না পাহাড়ি উপজাতিদের। 

আদিবাসীদের দাবি, মেইথেইরা ওবিসি সংরক্ষণ পেয়ে থাকেন। তাঁরা কোনও সাংবিধানিক সংরক্ষণের আওতায় নেই, এই দাবি ভুল। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সামাজিক পুঁজির আধিকারী মেইথেই সম্প্রদায়কে সংরক্ষণের আওতায় আনার ফলে সরকারি চাকরি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বেন কুকি সহ বাকি উপজাতিগুলি। কার্যক্ষেত্রে সংরক্ষণের মৌলিক ধারণাই লঙ্ঘিত হবে এই ক্ষেত্রে। 

মণিপুরের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, মেইথেই সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ বর্ণ হিন্দু। পুরান মহাভারতে বর্ণিত মণিপুরের রাজ পরিবারের সঙ্গে নিজেদের যোগসূত্রের বিশ্বাস রয়েছে একাংশের। আরএসএস এবং বিজেপির প্রভাবও এই অংশটির মধ্যে বিরাট। তাঁরা পাহাড়ে বসবাসকারী খ্রিষ্টান উপজাতিদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। এর পাশাপাশি ইম্ফল উপত্যকায় জমির পরিমাণ বাড়ন্ত। কিন্তু পাহাড়ের জমিতেও হাত দেওয়া সম্ভব ছিল না মেইথেইদের পক্ষে। ফলে আদিবাসী সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মেইথেই সম্প্রদায়ের জন্য। 

এর পাশাপাশি বহু মেইথেই ব্যবসায়ী এবং উদ্যোগপতি বিজেপির নির্বাচনী ব্যয়ভার বহন করেছেন। তাঁদের আশা, বিজেপি জিতলে পাহাড়ে বিনিয়োগের রাস্তা খুলে যাবে। সব মিলিয়ে ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কায় ভুগছেন পাহাড়ি আদিবাসী মানুষরা। 

এই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা প্রমাণ করেছে বিজেপি সরকারের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত। এরমধ্যে সাম্প্রতিকতম হল চূড়াচন্দ্রপুর-খৌপুম সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ইস্যু। ৪৯০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয় সরকারের তরফে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই জঙ্গলে বসবাসকারী উপজাতি অংশের মানুষকে অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে উচ্ছেদ করা শুরু হয়। কুকি সংগঠনগুলির অভিযোগ, আদিবাসীদের জমি দখল করতেই এই চক্রান্ত। 

এর পাল্টা ২৭ এপ্রিল চূড়াচন্দ্রপুরে বিক্ষোভ দেখান কুকিরা। সেই বিক্ষোভ হিংসাত্মক আকার নেয়। একটি জিম এবং স্পোর্টস কমপ্লেক্সে অগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। সেইদিন চূড়াচন্দ্রপুর সফরের কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের। পরিস্থিতির চাপে তিনি সফর বাতিল করেন। চূড়াচন্দ্রপুর ইন্টারনেট সংযোগও বাতিল করা হয়।

এই ঘটনার রেশ মেলাতে না মেলাতেই বুধবার মেইথেই সংরক্ষণের প্রতিবাদে বিষ্ণুপুর এবং চূড়াচন্দ্রপুর জেলায় মিছিল করেন আদিবাসী ছাত্র সংগঠনগুলি। পালটা মিছিল করেন মেইথেইরা। দুই মিছিল থেকে সংঘর্ষ বাঁধে। 

পরিস্থিতি সামলাতে গোটা রাজ্য জুড়ে জারি হয় কারফিউ। ৫ দিনের জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

ইম্ফল উপত্যকার বহু জায়গায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি এবং দোকানে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। 

ইতিমধ্যেই মণিপুরে সেনা এবং আধাসেনা মোতায়েন হয়েছে। সেনা ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছেন সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ। ভারতীয় সেনার মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মহেন্দ্র রাওয়াত জানিয়েছেন, অবস্থা সামাল দিতে মণিপুরে বাড়তি সেনা এবং আসাম রাইফেলস’র জওয়ান মোতায়েন করা হয়েছে। 

অপরদিকে ঘটনার জন্য দুই সম্প্রদায়ের ভুল বোঝাবুঝিকে দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। তাঁর দাবি, পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তিনি বলেন, অংশগুলির দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ প্রশমনে ব্যবস্থা নেবে সরকার। 

প্রসঙ্গত, মণিপুরে উগ্রপন্থা মোকাবিলায় দীর্ঘদিন ধরে জারি রয়েছে আফস্পা। সামরিক বাহিনীর সেই বিশেষ ক্ষমতা নিয়েও আদিবাসী এলাকায় রয়েছে বিপুল ক্ষোভ। সংরক্ষণ ইস্যুতে ঘটেছে তারও বহিঃপ্রকাশ। 

অপরদিকে টুইটারে হিংসা থামানোর আর্তি নিয়ে একটি পোস্ট করেন অলিম্পিকে সোনা জয়ী বক্সার মেরী কম। তিনি বলেন, ‘‘ আমার রাজ্য মণিপুর জ্বলছে। দয়া করে সাহায্য করুন।’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বেশ কয়েকটি সাংবাদমাধ্যমকে ট্যাগ করে ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি জানান তিনি।

Comments :0

Login to leave a comment