রাখঢাকের বালাই নেই, তীব্র গতিতে যেভাবে বিপক্ষের ডিফেন্স তছনছ করেন, তেমনই ফরাসি জনগণকে সরাসরি চরম দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানালেন কিলিয়ান এমবাপে। ফ্রান্সের রাজনীতিতে মেরিন লি পেনের দক্ষিণপন্থী দলের উত্থানকে রুখে দেওয়াই যে লক্ষ্য, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তাঁর কথাতে। ইউরো কাপে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ম্যাচে নামার আগের দিনের সাদামাটা সাংবাদিক সম্মেলনকে এভাবেই রাজনীতির রং চড়িয়ে দিলেন ফরাসি অধিনায়ক। অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ম্যাচ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তারই পাশাপাশি দেশের পরিস্থিতিও যে টালমাটাল, সেকথা স্মরণ করিয়ে দিতে রবিবার রাতের সাংবাদিক সম্মেলনকেই বেছে নেন ২৫ বছর বয়সি ফরাসি স্ট্রাইকার। চরম বিভেদমূলক মতধারার বিরোধী— একথা জানাতে যেমন তিনি দ্বিধা করেননি, তেমনই দেশের নির্বাচনে ফ্রান্সের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন। একজন খেলোয়াড় যে সমাজ, রাজনীতিতে থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও সত্ত্বা নন, তা স্পষ্ট করে দিলেন এমবাপে।
ফরাসি অধিনায়কের কাছে ‘অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ম্যাচ নিয়ে কী ভাবছেন’ গোছের প্রশ্ন করলে তিনি যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি টেনে আনবেন, তা কল্পনা করতে পারেননি সাংবাদিকরা। আসলে এমবাপেকে উসকে দেয় সম্ভবত ফরাসি ফরোয়ার্ড মার্কোস থুরামের শনিবারের একটি মন্তব্য। থুরাম ফ্রান্সে দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করে ওই শক্তিকে রুখে দিতে ‘প্রতিদিন লড়াই চালাতে হবে’ বলে আহ্বান জানার দেশবাসীর কাছে। ফরাসি ফরোয়ার্ড বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর, অত্যন্ত উদ্বেগেরও।’ পরের দিন দলের অধিনায়কই থুরামের বক্তব্যের সূত্র টেনে এনে বলেন, ‘আমি মার্কোসের মতোই মূল্যবোধে বিশ্বাস করি। আমি তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করি, ছড়িয়ে দিতে চাই। একারণেই আমি দেশের বৈচিত্র, সহনশীলতা এবং মর্যাদার প্রশ্নে মুখর। সোমবার আমরা যেমন অস্ট্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছি এটা যেমন ঠিক, তা নিয়ে ভাবতেও হবে। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি আগামীকালের ম্যাচের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।’ দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান কীভাবে একজন খেলোয়াড়কে নাড়িয়ে দিতে পারে, তা বোঝা যায় এমবাপের উদ্বেগেই। তিনি বলেছেন, ‘আমি কিলিয়ান এমবাপে যে কোনও চরম মতের বিরোধী। যা মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে, সেই ভাবনারও বিরোধী। আমি ফ্রান্সের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছি, এর জন্য গর্ববোধ করি। তাই আমি এমন কোনও দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই না, যারা আমার বা আমাদের মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেবে না।’
এমবাপে সহ দলের অন্যরা ইউরো খেলতে এলেও যে স্বস্তিতে নেই, তা তাঁদের মন্তব্যেই স্পষ্ট ধরা পড়েছে। এর কারণ অবশ্যই গত সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভোটে দক্ষিণপন্থী লি পেনের ন্যাশনাল র্যা্লি পার্টির কাছে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর পর্যদুস্ত হওয়া। ইউরোপীয় সংসদের নির্বাচনের ভোটে লে পেনের ন্যাশনাল র্যা লি ৩১- ৩২ শতাংশ ভোট পাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ম্যাক্রোঁর রেনেসাঁ পার্টি অনেক কম ভোট পেতে পারে। এই পূর্বাভাস ফ্রান্সের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ফ্রান্সের সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রোঁ। সরাসরি ফরাসি জনগণের মতামত নিতে চাইছেন রাষ্ট্রপতি। আগামী ৩০ জুন ও ৭ জুলাই দু’দফায় সংসদের মেয়াদ পূর্ণের আগেই নির্বাচন হতে চলেছে ফ্রান্সে।
একারণেই ইউরোপের সেরা হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেও মাথা থেকে দেশের পরিস্থিতি ভুলতে পারছেন না এমবাপেরা। দেশ যে এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের অপেক্ষায়, সেটা আঁচ করেই দেশবাসীর কাছে আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখতে দ্বিধা করলেন না তাঁরা। তিনি সরাসরি চরম দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন কী না জানতে চাওয়া হলে এমবাপে বলেন, ‘এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখে দেশ। আমাদের ফুটবলজীবনে ইউরো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ফুটবলার হতে পারি, তবে আমরা সবার আগে দেশের নাগরিক। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই বলে থাকেন ফুটবলের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলা ঠিক নয়। কিন্তু আমরা ফ্রান্সের পরিস্থিতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারি না। মনে হয় গোটা বিশ্বের সঙ্গে আমরা সংযোগবিহীন হয়ে পড়লে ভাল হবে না। একারণেই ফ্রান্সের অধিবাসী এবং বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে আমি অনুরোধ করছি। আমরা তরুণরাই পারি পরিস্থিতি বদলে দিতে। দেখতে পাচ্ছি, ক্ষমতালোভী দক্ষিণপন্থীরা দরজায় কড়া নাড়ছে। ফলে এখনই দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ আমাদের সামনে উপস্থিত।’ সমগ্র তরুণ প্রজন্মকে বেরিয়ে এসে ভোট দেওয়ার আরজি জানিয়ে ফরাসি অধিনায়ক বলেছেন, ‘পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে হবে। আশা করি, আমার কন্ঠস্বর যত দূর সম্ভব অনুরণিত হবে। আমার বিশ্বাস, আমরা সঠিক সিদ্ধান্তই নেব। আমি আশাবাদী, ৭ জুলাই এই জার্সিটাই আবার পরতে পেরে গর্বিত হব।’
ফুটবলার এবং অংশগ্রহণকারী দলগুলির রাজনৈতিক মন্তব্যের ক্ষেত্রে কড়া অবস্থান নিয়ে থাকে উয়েফা। এসংক্রান্ত বিধিনিষেধ আছে তাদের। এমনকি ফ্রান্সের ফুটবল ফেডারেশনও ফুটবলারদের নিরপেক্ষ থাকার বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল শনিবার। এসব উপেক্ষা করেই নিজের রাজনৈতিক অবস্থান জানাতে বিন্দুমাত্র টলে যাননি এমবাপে। সুনির্দিষ্ট দলের প্রতি অবস্থান স্পষ্ট না করলেও তাঁর প্রতিটি বক্তব্যে রাজনীতির ছোঁয়া ছিল। মাঠে যেমন ক্ষিপ্র, অনায়াস গতির সঙ্গে দুরন্ত স্কিলে ডিফেন্ডারদের নাজেহাল করে ছাড়েন, তেমনই ঋজু তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা। অবশ্য এই প্রশ্নে তিনি থুরামের মতোই পাশে পেয়ে গিয়েছেন দলের কোচ দিদিয়ের দেশঁকে। তিনি ফুটবলারদের রাজনৈতিক ভাবনাকে যে শ্রদ্ধা করেন, তা অকপটে স্বীকার করেছেন। দেশঁ বলেছেন, ‘এটা ওঁদের মুক্ত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। ওঁরা বড় ফুটবলার এটা যেমন মেনে নিই, তেমনই ভাবতে হবে যে ওঁরা ফ্রান্সের নাগরিকও। ফলে দেশের পরিস্থিতি মেনে নিতে কিংবা নির্লিপ্ত থাকতে পারেন না ওঁরাও।’
Comments :0