মধুসূদন চ্যাটার্জি- বাঁকুড়া
কয়েক‘শ মাইল দুর থেকে তিনদিন আগেই পাঁচমুড়ার লালবাঁধের বাড়িতে এসেছেন আলমগীর মন্ডল, মইদুল ইসলাম ভুঁঞয়া, বক্সেদ আল খাঁন, রেংটাখুলার মৈনুদ্দিন খাঁনরা। কয়েকদিন পরই তাঁদের ফের ফিরে যেতে হবে উড়িশার নানা প্রান্তে। এঁরা সবাই পরিযায়ী শ্রমিক। শরীরটাকে নিঙড়ে যে সামান্য রোজগার করেন তার উপর নির্ভর করে এঁদের পরিবার চলে। সেই কাজ সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেই বৃহস্পতিবার এঁরা তালডাংরার গ্রামে ছুটে এসেছেন একটাই কারণে, ইনসাফ যাত্রায় পা মেলাতে হবে। ঘরে এসে কেউ বসে থাকেননি। গ্রামের বাকি যুবকদের বাড়ি বাড়ি গেছেন এঁরা। বুঝিয়েছেন আমরা এত কষ্ট করে হাজার মাইল দূর থেকে যদি মিছিলে হাঁটার জন্য আসতে পারি, তাহলে তোমরা কেন ঘরে বসে থাকবে? তোমাদের হাতে কি কাজ আছে? যদি কাজ না থাকে তাহলে তো কাজ চাইতে হবে। কেউ তো অফিসে নিয়ে গিয়ে কাজ দেবেনা, যে কাজ পাওয়া যেত সেই মাটি কাটার ( রেগার) কাজও বন্ধ। তাহলে কেন তোমরা বসে থাকবে। রবিবার চল সবাই তালডাংরায়। আমাদের মতো যুবকদের উপর সরকারের আচরনের ইনসাফ চাই আমরা, তাই ইনসাফ যাত্রা। এই যাত্রার দাবির কথা আরও সোচ্চারে উচ্চারিত হবে হবে ৭জানুয়ারি বিগ্রেডে। আলমগীর, সাবির, বক্সারের কথার যুক্তি নাড়া দেয় সইফুদ্দিন শেখ, জগন্নাথ দাসদের।
সকাল ১১ টায় লালবাঁধ গ্রাম থেকে একদল যুবক তালডাংরায় এসে হাজির হন। যোগ দিলেন ইনসাফ যাত্রায়। আলমগীররা জানান, উড়িশার একাধিক জায়গায় তাঁরা রাজমিস্ত্রির জোগাড়িয়া হিসাবে কাজ করেন। বেতন পান ৩০০টাকা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই নির্মান শ্রমিকের কাজ করতে হয় তাঁদের। তালডাংরায় কাজ থাকলে কি বাইরে যেতে হত আমাদের? আমরা এলাকায় কাজ চাই। যখনই শুনিছি কাজের দাবিতে ইনসাফ যাত্রা হচ্ছে তখনই আমরা চলে এসেছি।
রবিবার সকালে বাঁকুড়া জেলার ওন্দার রামসাগর থেকে ইনসাফ যাত্রা শুরু হয়। তালডাংরায় পৌঁছানের কথা ছিল বেলা সাড়ে এগারটায়। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যায়। মানুষ কিন্তু সকাল ১১টা থেকেই তালডাংরায় হাজির হয়েছিলেন। সেই এলাকার মানুষও তো একই যন্ত্রণায় ভুগছেন। দুপুরের খাবারের সময় পেরিয়ে গেলেও কেউ এলাকা ছাড়েননি। অপেক্ষায় থাকেন বহু মানুষ। এই সেই তালডাংরা যেখানে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার দুদিনের মধ্যেই কৃষক নেতা অজিত লোহারকে খুন করেছিল তৃণমূলবাহিনী। ২০১৬ সালে খুন করা হয় যুব কর্মী অরুন সর্দারকে। বহু মানুষকে বছরের পর বছর ধরে ঘর ছাড়া থাকতে হয়। এর ইনসাফ চান মানুষ। সন্ত্রাস কবলিত আমডাংরা, শালতোড়া অঞ্চল থেকেও বহু মানুষ এদিন হাজির হয়েছিলেন তালডাংরায়। এদিন মিছিলে হাজির হওয়া ফুলমতি অঞ্চলের কাশিবনী গ্রামের খেতমজুর বাদল মান্ডি জানান, তাঁর স্ত্রী মনিকা মান্ডিও মিছিলে আসতেন। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে তিনি বাইরে ধান কাটতে চলে গেছেন। তাঁর বক্তব্য আমার এক ছেলে হাইস্কুলে অষ্টমশ্রেণিতে ও ছোটটি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্বামী, স্ত্রী দুজনেই খেতমজুর। খালি মনিকা নয়, কাশিবনী, করঞ্চপাড়া, পাত্রবাঁধ, মুগাই সহ একাধিক গ্রামের মহিলারা আজ পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে ভিন জেলায় গেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই এদিনের মিছিলে এসেছিলেন। মিছিলে এসেছিলেন ট্যাংরা মোলবনী, ডাংজুড়ি, যোশদানন্দপুর গ্রামের মানুষজন। এই গ্রামগুলি তপসীলিজাতি, আদিবাসী অধ্যুষিত। এখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করার জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এঁদের প্রশ্নে কোন অপরাধে আমাদের গ্রামের স্কুলগুলো বন্ধ হবে? ইনসাফ যাত্রায় এই কথা সোচ্চারে তোলা হয়েছে।
এদিন তালডাংরায় পদযাত্রীদের সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্যও বহু মহিলা হাজির ছিলেন। ইনসাফ যাত্রার পদযাত্রীদের দেখার জন্য, তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য ব্যাবসায়ীরা দোকান খুলে রাখেন। এদিন সকালে রামসাগর, ওন্দা, ধলডাঙ্গামোড়, নতুনগ্রাম, রতনপুর এই জায়গাগুলিতে পদযাত্রীরা মিছিল করেন। বহু মানুষ এই জায়গাগুলিতেও অপেক্ষা করতে থাকেন। কথা একটাই, শুরু হয়েছে বড় লড়াই, আমরা থামবনা এই লড়াই থেকে। যে অবিচার চলছে তার উপযুক্ত বিচার চাই। বিকালে ইসসাফ যাত্রা সিমলাপালে প্রবেশ। শুরু হল মিছিল। সিমলাপালের রাস্তার দুধারে তখন খালি মানুষ আর মানুষ। সম্বর্ধনার পাশাপাশি আগামী লড়ায়ের অঙ্গীকার নিলেন জঙ্গলমহল সিমলাপালের মানুষ। এখানেও জনসভা হয়। রাতে ইনসাফ যাত্রা ঢোকে খাতড়ায়। সেখানে আদিবাসী নৃত্য হয়। পুরো খাতড়া এদিন হাজির হয়েছিল পাম্পমোড় এলাকায়। শীতের রাতের মানুষ পদযাত্রীদের কথা শুনতে বসেছিলেন।
এদিন বিভিন্ন জায়গায় জনসভায় বক্তব্য রাখেন ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্পাদিকা মীনাক্ষী মুখার্জি, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিমাঙ্গরাজ ভট্টাচার্য্য, রাজ্য সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহা, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক অভয় মুখার্জি, জেলা সম্পাদক প্রদীপ পন্ডা প্রমুখ। বিভিন্নস্থানে পদযাত্রায় অংশ নেন প্রাক্তন যুবনেতা অজিত পতি সহ নেতৃবৃন্দ।
Comments :0