POst Editorial on Manipur

বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতির শিকার মণিপুর

উত্তর সম্পাদকীয়​

দীপ্তজিৎ দাস
গ্রাম, শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে লেলিহান শিখা। জ্বলেছে বাড়িঘর, দোকানপাট। প্রাণভয়ে বসতভিটে ছাড়ছে আতঙ্কিত মানুষ। বারংবার বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির উসকানিতে শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে উত্তর পূর্বের সেভেন সিস্টার স্টেটের অন্যতম মণিপুরে। বিচ্ছিন্নতার সুর আজ দাঙ্গার দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মণিপুর জুড়ে। 
কেন এমন হলো? 
মেইতেইদের উপজাতি স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ 
দীর্ঘদিন ধরে মেইতেইরা মণিপুরের বাসিন্দা। মূলত কৃষিকাজের মাধ্যমেই জীবনধারণ তাদের। রাজ্যের জনসংখ্যার ৫৩% মেইতেই সম্প্রদায়ভুক্ত। অপর দিকে রাজ্যের বাসিন্দাদের ৪০% বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য নাগা ও কুকিরা। পশুপালন ও পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জীবিকাই তাদের রোজনামচা। ১৯৯১ সাল থেকেই মেইতেইরা অন্যান্য অনগ্রসর জাতির অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে আদিবাসীরা উপজাতির অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানের অতিরিক্ত সুবিধার জন্য মেইতেইরা উপজাতি তকমার দাবি জানায়। ২৭ মার্চ মণিপুর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এম ভি মুরলিধরণ এই মামলার রায়ে মেইতেইদের উপজাতিভুক্ত করার জন্য রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রের কাছে ৪ মাসের মধ্যে আবেদন করতে নির্দেশ দেন। এন বীরেন সিংয়ের বিজেপি সরকার তৎক্ষণাৎ বিধানসভায় সেই প্রস্তাব পাশের জন্য বিল আনতে সচেষ্ট হয়। এই উদ্যোগে আদিবাসীরা নিজেদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে প্রমাদ গোনে। মণিপুর বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ৪০টি আসনই মেইতেই সংখ্যাধিক্য। তাই সঙ্কীর্ণ ভোট কৌশল থেকেই পরোক্ষে বিধানসভার ভোটের আগে বিজেপি মেইতেইদের এই দাবিতে ইন্ধন জোগায়। বিজেপি সরকারের এই ভূমিকায় রাজ্যের মানুষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল এই সংরক্ষণের পক্ষে অপরদল সংরক্ষণের বিপক্ষে পথে নামে। দুই পক্ষের সংঘর্ষ রাজ্যে হিংসা ত্বরান্বিত করে।
মেইতেই ও আদিবাসী উভয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতা 
রাজ্যের বৃহৎ জনগোষ্ঠী হলেও মেইতেইদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করতে থাকে সাম্প্রতিককালে। মেইতেই নিবিড় ইম্ফল উপত্যকা রাজ্যের ভূমির মাত্র ১০%। অপরদিকে প্রায় ৯০% ভূমিভাগ পার্বত্য অঞ্চলে। সংবিধানে ৩৭১ সি ধারা অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলের জমি মেইতেইরা কিনতে পারে না। অপরদিকে আদিবাসীরা সমতলে জমি কিনতে পারে। জনসংখ্যার চাপ থেকেই নিজেদের বসতি প্রসারণের তাগিদ অনুভব করে মেইতেইরা। কিছুটা নিরাপত্তাহীনতা থেকেই তারা মোদী সরকারের কাছে ইনার লাইন পারমিটের জন্য দাবি করে। ২০১৯ সালে মণিপুর ভ্রমণের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ মণিপুরে ইনার লাইন পারমিটের কথা ঘোষণা করেন। অন্যদিকে ভোট বৈতরণী পেরোনোর জন্য এই অঞ্চলে আদিবাসীদের সম্পর্কে ভ্রান্ত প্রচার শুরু করে বিজেপি-আরএসএস। মেইতেইদের বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনে নামে উপজাতি স্বীকৃতির জন্য। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে অনুন্নত পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা অনুভব করে উপজাতি তকমা তাদের কাছে সংবিধান প্রদত্ত রক্ষাকবচ। নিজেদের চাকরি ও জমির সুযোগের একমাত্র সুযোগ এই সংরক্ষণ। মেইতেইরা এই সুযোগ পেলে তারা বঞ্চিত হবে।পাশাপাশি বিজেপির ভোট পূর্ববর্তী বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি এই রেষারেষিতে নতুন মাত্রা যোগ করে।

জাতি বিদ্বেষে সাম্প্রদায়িক মোড়ক 
রাজ্যে সংখ্যাগুরু মেইতেইরা প্রধানত বৈষ্ণব, ধর্মে হিন্দু। পক্ষান্তরে আদিবাসীরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। আরএসএস যুগে যুগে খ্রিস্টানদের শত্রু মনে করে এসেছে। বড়দিনের সময় বিজেপি শাসিত কর্নাটক, মধ্য প্রদেশ সহ বিভিন্ন রাজ্যে গির্জায় আক্রমণের ঘটনা তার প্রমাণ। ২০১৭-এ বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আরএসএস তাদের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সূক্ষ্ম মেকানিজমে মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে খ্রিস্টান বিরোধী মানসিকতা গড়ে তোলে। সাম্প্রতিক কালে মণিপুর হাইকোর্ট ‘অবৈধ গির্জা’ সংক্রান্ত মামলায় রাজ্য সরকারের বিবেচনার রায় দেয়। এই রায়ের সুযোগে ইম্ফল উপত্যকায় সরকার ৩টি গির্জা ধ্বংস করে। স্বাভাবিক নিয়মেই আদিবাসীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আদিবাসী নিবিড় অঞ্চলে প্রতিক্রিয়াশীলরা এবুধও পাখাংবা মন্দিরে ভাঙচুর চালায়। স্বভাবতই ঘটনা সাম্প্রদায়িক মোড়ক নেয়। এরপর থেকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে গির্জা অথবা মন্দিরগুলি। ধর্মের মোহে অন্ধ মানুষ বাড়াতে থাকে দাঙ্গার প্রাবল্য।
বন সংরক্ষণ ও সমীক্ষার নামে আদিবাসী উচ্ছেদ 
এন বীরেন সিংয়ের বিজেপি সরকার বনভূমি সংরক্ষণ ও সমীক্ষার নামে আদিবাসী নিবিড় জেলাগুলিতে উচ্ছেদের কাজ শুরু করে। জনসংখ্যার চাপ বাড়তে থাকায় কুকি, নাগা সম্প্রদায়ের মানুষরা পাহাড়ের সংলগ্ন গ্রামগুলিতে তাদের বসতি গড়ে তুলেছিল। সেখানেই তারা শান্তিতে বসবাস করছে ৫০-৬০ বছর ধরে। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট, ১৯২৭ অনুযায়ী বন দপ্তরের আধিকারিকরা সংরক্ষিত বনভূমির তালিকা তৈরি করেছিলেন। মানুষের বসতির কথা ভেবে তারা নির্দিষ্ট গ্রামগুলিকে সেই তালিকায় বাতিল করেন। কিন্তু বর্তমান বিজেপি সরকার সেই তালিকা বাতিল করে দেয়। ২০২২ সালে এক ঘোষণা অনুযায়ী চুড়চাঁদপুর ও নোনী জেলায় ৩৮টি গ্রাম তারা সংরক্ষিত বনভূমির আওতাভুক্ত করে। এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের কোনও বন্দোবস্ত সরকারের তরফে করা হয়নি। আরএসএস বিজেপি’র ব্রাহ্মণ্যবাদের নির্লজ্জ স্বরূপ এভাবেই উন্মোচিত হয়েছে মণিপুরে। তার জেরেই আদিবাসীদের মধ্যে তৈরি হয় ব্যাপক ক্ষোভ। এমনকি সাইকোট কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক পাওলিয়েনলাল হাওকিপ এই বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সরকার কর্ণপাত করেনি। এই একপেশে মনোভাবের ফায়দা তুলে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি রাজ্যকে নিয়ে গেছে হিংসার দিকে। 
অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত ভ্রান্ত প্রচার
সাম্প্রতিককালে বার্মায় সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে জীবন-জীবিকার স্থিরতার আশায় হাজার হাজার মানুষ দেশান্তরী হচ্ছেন। কিছু মানুষ সীমান্ত টপকে মণিপুরে এসেছেন একথা অনস্বীকার্য। সাথে কুকি সম্প্রদায়ের সাথে তাদের উৎসগত সাদৃশ্য থাকায় তারা এই অংশের মানুষের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল। এই ঘটনাকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে বিজেপি মানুষের মধ্যে বিভেদের বীজ বুনেছে। পার্বত্য অঞ্চলের বিক্ষিপ্ত হিংসার ঘটনাই প্রচার পেয়েছে বার্মার উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মদতে মণিপুরে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হিসাবে। সাথে সমগ্র আদিবাসী সম্প্রদায়কে দায়ী করা হয়েছে ড্রাগের চোরাচালানের জন্য। একাধিক জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে আফিম চাষের অপবাদ দিয়ে। এই ঘটনা মেইতেইদের মধ্যে আদিবাসীদের প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। অপর দিকে বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষের কারবারের দায় সমগ্র উপজাতির উপর চাপানো আদিবাসীদের কাছে হয়ে উঠেছে অপমানজনক। দুই সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসের বাতাবরণেই মাথা তুলেছে বৈরিতার প্রাচীর।
শান্তি চুক্তি প্রত্যাহার
২০১৭ সালে বিভিন্ন কুকি-জোমি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে বিজেপি মধ্যস্থতা শুরু করে নির্বাচনকে মাথায় রেখে। নির্বাচনের পর দল ভাঙানোর মাধ্যমে বিজেপি সরকার গঠিত হলে কেন্দ্র-রাজ্য ও গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ত্রিপাক্ষিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গোষ্ঠীগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট, ন্যাশনাল কুকি অর্গানাইজেশন। এবছর ১০ মার্চ বিধানসভায় আনা প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাজ্য সরকার এই চুক্তি প্রত্যাহার করে নেয়। এই ঘটনায় কুকি সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয়। এর পর হাইকোর্টের মেইতেইদের উপজাতি সংরক্ষণের প্রশ্নে ইতিবাচক রায় প্রদানের সমালোচনার ফলে অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মণিপুরের সভাপতিকে কোর্ট শো-কজ করলে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। আদিবাসীদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ও বিভিন্ন পার্বত্য জেলার পুলিশ কর্তাদের সাসপেন্ড করা হয়। সমগ্র ঘটনাবলী জনজাতিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
অনুন্নয়ন ও বেকারত্ব
বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। তিনি নিজে মেইতেই সম্প্রদায়ভুক্ত। গত ৫ বছরে রাজ্যের অধিকাংশ উন্নয়নের কাজই সীমাবদ্ধ থেকেছে সমতল অঞ্চলে। পার্বত্য অঞ্চল থেকেছে অবহেলিত। স্বভাবতই আদিবাসীদের মধ্যে বঞ্চনার মনোভাব দানা বেঁধেছে। এই ঘটনা বিজেপি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ।
গত এপ্রিলে দেশজুড়ে বেকারত্বের হার ছিল ৮.১১%। তুলনায় মণিপুরে সেই হার ৯.৫%। সমগ্র উত্তর - পূর্বাঞ্চলে দ্বিতীয় সর্বাধিক বেকারত্ব এই রাজ্যে। কর্মহীন হতাশাগ্রস্ত মস্তিষ্কই আরএসএস’র বরাবরের লক্ষ্যবস্তু। তাদেরই লেলিয়ে দেওয়া সম্ভব একে অপরের বিরুদ্ধে। এই সমীকরণ থেকেই বিজেপি মেইতেইদের মধ্যে প্রচার চালায় সংরক্ষণের বলে তাদের চাকরি, ব্যবসা দখল করছে আদিবাসীরা। আবার আদিবাসীদের মধ্যে তারা প্রচার চালায় মেইতেইদের জন্যই তাদের বঞ্চিত হতে হচ্ছে। আরএসএস বিজেপি’র বিষাক্ত বিভাজনের রাজনীতির নব্য গবেষণাগার হয়ে উঠে আজ রক্তাক্ত মণিপুর।
বিজেপি সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা 
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে প্রথম পর্বে বারবার প্রশ্নের মুখে এসেছে বীরেন সিংয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদক্ষেপ। বিভিন্ন একপেশে পদক্ষেপের পাশাপাশি ভ্রান্ত নীতিও দায়ী আজকের পরিস্থিতির জন্য। প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠক দেখনদারির জন্য পার্বত্য অঞ্চলে করলেও কাজের বিষয়ে পার্বত্য অঞ্চলে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি ইম্ফল উপত্যকার বিভিন্ন সংগঠনের চাপে মণিপুর অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট অ্যাক্ট (২০২১) বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিধানসভায় পেশ করেনি বিজেপি সরকার। এই বিশ্বাসঘাতকতা থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
কেন্দ্র সরকারের ব্যর্থতা 
আর্মড ফোর্স (স্পেশাল পাওয়ার) অ্যাক্ট, ১৯৫৮-র বিভিন্ন অপব্যবহার ঘটিয়ে এলাকার জনজীবনে ব্যাঘাত ঘটানোর অভিযোগ বহুদিন ধরেই সেনার বিরুদ্ধে। প্রসঙ্গত শর্মিলা চানুর দীর্ঘ ১৬ বছরের অনশন আলোড়ন ফেলেছিল বিশ্ব জুড়েই। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আফস্পা প্রত্যাহারের। পরবর্তী ৯ বছরে সে বিষয়ে কিছু বিক্ষিপ্ত ছাড় ব্যতীত কোনও অগ্রসর হয়নি। ২০১৯ সালে এক বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত পথচারীদের সেনাদের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনায় এই ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। ২০১৬ সাল থেকেই বিজেপি বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ বাড়াতে শুরু করে। মোদী, অমিত শাহরা বারবার বিভিন্ন উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সাথে শান্তি চুক্তির প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। এই সময় কো-অর্ডিনেটিং কমিটি ফর মণিপুর ইন্টিগ্রেশন (কোকোমি) মণিপুরকে বিশেষ রাজনৈতিক রাজ্য ঘোষণা করার দাবি জানালে বিজেপি তাকে ইন্ধন জোগায়। তাদের প্রতিনিধি দল অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদীর সাথে দেখা করলে তারাও তাদের এবিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেন। এই পদক্ষেপ মণিপুরের মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের জন্ম দেয়। এর সাথেই ২০১৯ সালে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলে। আদিবাসীরা উপলব্ধি করে এরপর ৩৭১ সি ধরার মাধ্যমে মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলে যে বিশেষ সুবিধা তারা উপভোগ করে তার উপর আক্রমণ নেমে আসতে পারে। কেন্দ্র সরকারের ভ্রান্ত পদক্ষেপগুলি মণিপুরে ধীরে ধীরে সৃষ্টি করেছে আজকের অরাজক পরিস্থিতি।
দাঙ্গা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপের অভাব
বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে মণিপুরের আইন শৃঙ্খলার অবনতি হলেও তাকে আমল দিতে চায়নি বীরেন সিংয়ের সরকার। বিক্ষুব্ধ মানুষের সাথে সমঝোতা দূর অস্ত, তারা স্থির থেকেছে নিজেদের ভ্রান্ত পদক্ষেপেই। হিংসাত্মক ঘটনার আগাম অনুমান করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন। সিপিআই(এম), সিপিআই বারবার সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার কথা বললেও সেই বিষয়েও তারা অহেতুক দীর্ঘসূত্রতার দৃষ্টান্ত রেখেছে। কেবল কারফিউ জারি করে, ইন্টারনেট বন্ধ করে চেয়েছে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সামাল দিতে। কিন্তু পর্যাপ্ত উদ্ধারকার্য চালানোর উদ্যোগ নিতে পারেনি। বিভিন্ন রাজ্য সরকার মণিপুর নিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের ফেরত নেওয়ার জন্য বিমান পাঠালেও তাদের ফেরানোর ব্যবস্থা করতে শুরুতে দেরি করেছে মণিপুর সরকার।
অন্যদিকে দেশের সরকার দায় সেরেছে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়েই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ঘুরে বেড়িয়েছেন অন্যান্য রাজ্যে, রবীন্দ্র জয়ন্তীতে বাংলায় এসেছেন। নরেন্দ্র মোদী ব্যস্ত থেকেছেন কর্নাটকে বিধানসভার নির্বাচনের প্রচারে। সেখানে তিনি উৎফুল্ল হয়েছেন কেরালা স্টোরির মতো প্রোপাগান্ডা সিনেমার মাহাত্ম্য প্রচারে। আর এই অপদার্থতার মাটিতেই কাটা ক্ষতের মতন চওড়া হয়েছে নিরাশার ‘মণিপুর স্টোরি’। কমিউনিস্টরা বরাবরই বলে এসেছে দমন নয় আলোচনাই হতে পারে একমাত্র সমাধানের পথ। কিন্তু নির্বাক কেন্দ্র সরকার।
দাঙ্গা হাঙ্গামার রক্তাক্ত সড়কেই ছুটে চলে ফ্যাসিবাদের দুর্বার রথ। এক সময়ের প্রভু ব্রিটিশদের মতনই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুলে’ বিশ্বাসী আরএসএস-বিজেপি। মানুষকে সঙ্কীর্ণতার চশমায় অন্ধ করে কর্পোরেটের পৃষ্টপোষকতা আর নিজেদের সাম্প্রদায়িকতার অ্যাজেন্ডা পরিপূর্ণ করাই লক্ষ্য তাদের। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে সর্বশেষ অধীনতা স্বীকার করেছিল এই মণিপুর রাজ্য। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নির্ভীক লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন পাওনা ব্রজবাসী, টিকেন্দ্রজিৎ, হাইপু জাদনাংরা। মহীয়সী নারী গাইডিনলুইর প্রতিরোধ দেখে জওহরলাল নেহরু তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘পর্বতের রাণী’। মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলার মৈরাংয়ে সুভাষ চন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর হয়ে প্রথম দেশের মাটিতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন সৌকত আলি মালিক। সেই প্রতিরোধের মণিপুর আজ বিজেপি’র চক্রান্তে বিভাজনের পথে। একই প্রক্রিয়ায় বাংলাতেও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভাজন করতে চাইছে ওরা। মানুষের ঐক্যবদ্ধতাই পারে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সমুচিত জবাব দিতে। 

Comments :0

Login to leave a comment