কাতার বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই চমক দেখালো সৌদি আরব। শক্তিশালী আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারিয়ে এই মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রেনার্ড ব্রিগেড।
কিন্তু কোন জাদুমন্ত্রে মেসিদের নাকানি চোবানি খাওয়ালেন আল-সেহরি, সালেম আলদওসারিরা?
এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে সেদেশের ফুটবল ডেভেলপমেন্টের মাস্টারপ্ল্যানে।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে সৌদি আরব ফুটবল ফেডারেশন, ম্যানচেস্টার সিটি এবং দক্ষিণ এশিয়া ফুটবল ফেডারেশন( সাফ)’র সঙ্গে একটি বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষর করে। মূলত জুনিয়র ফুটবলার তুলে আনার ট্রেনিং ক্যাম্পগুলিকে ঢেলে সাজানোর জন্যেই ছিল সেই চুক্তি।
২০১৮ সালের বিশ্বকাপে খুব একটা ভালো ফল করতে পারেনি সৌদি আরব। কিন্তু হাল ছাড়েননি তাঁরা। দেশের ফুটবলের উন্নতিকে একাধিক দীর্ঘমেয়াদী লক্ষমাত্রায় ভাগ করে সৌদি ফুটবল প্রশাসন। সেই পথ ধরেই ২০১৯ সালে হেডস্যার হিসেবে দলের দায়িত্ব নেন ফ্রান্সের হার্ভে রেনার্ড। সেই থেকে শুরু হয় দলকে একসূত্রে বাঁধার কাজ।
দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের অঙ্গ হিসেবে সৌদি আরব ফুটবল ফেডারেশন ‘মিশন ২০৩০’র কথা ঘোষণা করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ফুটবল মেধাকে এক ছাতার তলায় আনার কাজ শুরু হয়। সৌদি আরবের ফুটবলারদের শারিরীক সক্ষমতার ভিত্তিতে তৈরি হয় নতুন ‘প্লেইং স্টাইল’।
এই স্টাইলেরই ঝলক দেখা গিয়েছে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে।
কিন্তু শুধুমাত্র ভিশন দিয়েই কী উন্নতি সম্ভব? প্রয়োজন আর্থিক বরাদ্দেরও।
ভিশন প্ল্যান যাতে সঠিক ভাবে কার্যকরী হতে পারে, সেই জন্য আর্থিক বরাদ্দের বিষয়ে কার্পণ্য দেখায়নি সৌদি প্রশাসন। সৌদি ফুটবলের প্রতিটি স্তরেই জোর দেওয়া হয় উন্নতমানের অনুশীলনের উপর। ফুটবল শৈলীর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রযুক্তির ব্যবহার। ২১ শতকের ফুটবলের জন্য ক্রমশ তৈরি হয়ে ওঠে ‘টিম সৌদি’ ।
সৌদি আরবের ক্রীড়ামন্ত্রকের উদ্যোগে পরবর্তীতে আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সৌদি প্রফেশনাল লীগ, প্রথম ডিভিশন এবং দ্বিতীয় ডিভিশন লীগ ছাড়াও ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং হিসেবে ২০২১ সালে তৃতীয় ডিভিশনের একটি লীগের কথাও ঘোষণা করে সাফ। যার মূল লক্ষ্য ছিল আরও বেশী করে স্কুল স্তরের ফুটবলার তুলে আনা, এবং তাঁদের ‘সিস্টেমের’ অংশ বানানো।
এর ফলে গোটা দেশের ফুটবল মানচিত্রে নতুন নতুন নাম উঠে আসতে শুরু করে। এবং ফিফা ক্রমতালিকার ৩২ নম্বরে উঠে আসে সৌদি আরব।
এই নতুন মুখদের অন্যতম আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে অনবদ্য গোল করা সালেম আল দাওয়াসরি। তিনি বর্তমানে সৌদি আরব প্রফেশনাল লিগের ক্লাব আল হিলালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। গোটা সৌদি দলের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে , পুরো দল বাছাই করা হয়েছে যোগ্যতার ভিত্তিতে। জাতীয় লিগে পারফর্মেন্সের ভিত্তিতেই জাতীয় দলে ঠাঁই মিলেছে খেলোয়াড়দের।
প্রফেশনাল লিগের পাশাপাশি সৌদি ফুটসল লীগ, অনূর্ধ্ব পনেরো, সতেরো এবং উনিশ প্রিমিয়ার লীগ, কিং কাপ, সুপার কাপ ইত্যাদি থেকেও ফুটবলার তুলে আনার কাজ হয়েছে।
২০২২ বিশ্বকাপে সৌদি আরব দলের মূল চালিকাশক্তি মাঝমাঠ এবং আক্রমণভাগ। ঘরোয়া লিগ থেকে উঠে আসা হাইথাম হাসিরি, সামি, সালমান আলফারাজ, নাওয়াফ আলাবিদ, আলী আলহাসান, সুলতান আলঘানাম, সালেহ আলসেহেরি সহ একাধিক নতুন প্রজন্মের ফুটবলার দাপিয়ে খেলছেন জাতীয় দলে। আলসেহেরি তো আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রথম গোলটিও করে ফেললেন। সৌদি আরবের ফুটবল ইতিহাসে যে নবজাগরণ ঘটেছে, মধ্যপ্রাচ্য এবং গোটা এশিয়ার মধ্যে তা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য।
Comments :0