শুভজিৎ সরকার
সাম্প্রতিক সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবার সামনে এসেছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ। ছাত্র সংসদের ভোট হবে বলে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলের ছাত্রদের সভায় বলেছেন। এই প্রতিশ্রুতি আদৌ রক্ষা করা হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
পরাধীনতার কালেও ছাত্র আন্দোলনের জোর কম ছিল না। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কলকাতার রাজপথে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ছাত্ররা মিছিল করেছে। কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ পথ দেখিয়েছে গোটা দেশের ছাত্র সমাজকে কীভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সংগঠিত করে ছাত্রদের বক্তব্যকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে জোরালো করা যায়। স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করার পাশাপাশি আমাদের দেশের ছাত্ররা সরকারের অঙ্গুলিহেলনে চলতে চায়নি বলেই স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ছাত্র মননের উপর অনবরত আঘাত আনার চেষ্টা করে গিয়েছে বিভিন্ন সরকার। ষাট-সত্তরের দশকে বাংলার ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনকে এবং সামাজিক প্রগতিশীলতার অভিমুখে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জরুরি অবস্থার সময়েও ছাত্রদের ভুমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল। বাস্তবের মাটিতে বাংলায় বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়া এবং জনগণের লড়াইয়ের বার্তা প্রতিটা কোণায় পৌঁছানোয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে ছাত্র সমাজ। ছাত্র রাজনীতি একজন ব্যক্তিকে জীবন জীবিকার লড়াইয়ে শাণিত করে, গড়ে তোলে। একটা গাছকে গড়ে তুলতে গেলে যেরকম পর্যাপ্ত জল, হাওয়া, রোদের প্রয়োজন হয় তেমনই একজন মানুষের গড়ে ওঠার পিছনে তার চারপাশের সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক জীব হিসাবে রূপান্তরিত হওয়ার লড়াইটা অনেকটা কঠিন। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব এখানেই। আমরা কেবল পুঁথিগত শিক্ষা শিখি না এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে। এখানে আমাদের সামাজিকীকরণ হয়। এই সমাজে থাকার, বসবাস করার, একে অপরের সাথে কথা বলা এবং নতুন কোনও সিনথেসিস তৈরির রসদ শেখায় ক্লাসরুম। একটা প্রতিষ্ঠানে যেমন ক্লাসরুম থাকে, তেমনই থাকে ক্যান্টিন, ইউনিয়ন রুম, কমন রুম, লাইব্রেরি, খেলার মাঠ। এই সবগুলি আমাদের বিভিন্নভাবে সমাজিকীকরণের প্রক্রিয়া প্রভাবিত করে।
সাম্প্রতিক সময়ের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নবাগত ছাত্রের খুনের ঘটনা আমাদের সামনে অনেক কিছু তুলে এনেছে। কেবল যাদবপুর নয় রাজ্যের সর্বত্র যে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আছে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে একেবারে গুরুত্ব না দিয়ে বর্তমান সরকার ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে কিছু শিক্ষা মাফিয়াদের লালন পালন করে বড় করার দায়িত্ব নিয়েছে। তৃণমূল সরকারে এসে প্রথম যে কাজ এরা করে সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট, সিন্ডিকেট, গভর্নিং বডিগুলি থেকে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের সরিয়ে দেওয়া। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন তিনি শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত করবেন। কিন্তু সেটার পর দেখা গেল আস্তে আস্তে রাজনীতিটা শিক্ষামুক্ত হয়ে পড়ল। কলেজের গভর্নিং বডিতে ছাত্র প্রতিনিধি নেই। এদিকে এলাকার তৃণমূলের জমি মাফিয়া, তোলাবাজরা গভর্নিং বডির সভাপতি হয়েছে। যাদের সাথে শিক্ষার ন্যূনতম যোগাযোগ নেই তারা নাকি কলেজের নিয়ন্ত্রক শক্তি! কলেজের বিভিন্ন বড় অনুষ্ঠানকে এরাই দলীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করছেন। রাজনৈতিক দলের অফিস করে দিচ্ছে কলেজটাকে।
ছাত্র সংসদ এবং ছাত্র রাজনীতি
অনেকের মধ্যে ছাত্র সংসদ সম্পর্কে অনেক ধোঁয়াশা আছে। প্রথমত, ছাত্র সংসদ নির্দিষ্ট কোনও ছাত্র সংগঠনের একার সম্পত্তি নয়। সরকার এবং দলের মধ্যে যেমন পার্থক্য আছে ঠিক তেমনই ছাত্র সংগঠন এবং ছাত্র সংসদের মধ্যে পার্থক্য আছে। সরকার সকলের হয়, ঠিক তেমনই ছাত্র সংসদের কোনও দলীয় সত্তা হয় না। প্রতিটা ছাত্র যখন কলেজে/ বিশ্ববিদ্যালয়তে অ্যাডমিশন নেয় তখনই সে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ফিজ বা স্টুডেন্ট এইড ফিজ দেয়। তখন থেকেই সে ছাত্র সংসদের সদস্য। প্রতিটা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী আসলে ছাত্র সংসদের সদস্য। ছাত্র সংসদ হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের লড়াই, আন্দোলনের মঞ্চ। এই মঞ্চকে ব্যবহার করেই ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের অধিকারের কথা তুলবে এটাই স্বাভাবিক। ছাত্র সংসদ বাইরের রাজনৈতিক দলের নেতাদের দ্বারা চালিত হলে সেটা ওই নির্দিষ্ট ক্যাম্পাসের জন্যও ক্ষতিকারক। ছাত্র-ছাত্রীদের লাইব্রেরির সমস্যা, শিক্ষক নেই, ক্যান্টিনের সমস্যা, কমন রুমে পর্যাপ্ত জিনিসপত্র নেই এমনই আরও অনেক সমস্যা তুলে ধরে সেইগুলোর সমাধান করার কাজ ছাত্র সংসদের। নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি যিনি হবেন তিনি গভর্নিং বডি, সেনেট, সিন্ডিকেটের মেম্বার হবেন এবং ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসাবে তাদের কথা কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সামনে তুলে ধরবেন। এটাই ছিল ২০১১ সাল অবধি ছাত্র সংসদের কাজ।
বর্তমানে তৃণমূল সরকারের আমলে প্রতি বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। যখনই নির্বাচন হয়েছে সেই নির্বাচনটা প্রহসনে রূপান্তরিত হয়েছে। ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদ একটা সময় একটু মাতব্বরির জায়গা হয়ে উঠেছিল স্বীকারে কুণ্ঠা নেই তবে সেই প্রবণতা নগণ্য। এখন তা নির্লজ্জতা বহুগুণ বাড়িয়ে হয়ে উঠেছে টাকা পয়সা লুটের জায়গা। ছাত্র সংসদের অফিসকে আর ছাত্র সংসদের অফিস রাখেনি তৃণমূল। বেআইনিভাবে তাকে নিজেদের ছাত্র সংগঠনের অফিস করে ফেলেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় অনেক জায়গায় ছাত্র সংসদের অফিস তৃণমূলের পার্টি অফিসও হয়ে গেছে। এলাকার যুব তৃণমূলের নেতারা সেখান থেকে বসে টাকা পয়সার তোলবাজির ভাগ বাটোয়ারা করে। সঠিক সময় নির্বাচন হলে। সঠিকভাবে ছাত্র সংসদ নিজেদের কাজে লিপ্ত হলে আক্ষরিক অর্থে ছাত্র সমাজের এবং অবশ্যই বৃহত্তর সমাজের লাভ হতো।
কী দেখছি আমরা সাম্প্রতিক সময়ে? ক্যাম্পাসের ভিতরে বিরোধী সংগঠনের ব্যানার, ফ্ল্যাগ, ফেস্টুন লাগালে কর্তৃপক্ষের নাম করে এলাকার তৃণমূলের নেতারা এসে খুলে দিচ্ছে। পড়ুয়াদের হেনস্তার ঘটনা অগণিত তৃণমূলের জমানায়। শাসক দলের প্রচার না করলে বা বিরোধী কোনও সংগঠনের হয়ে কথা বললে তার পড়াশোনার ক্ষতি করেছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের চল্লিশোর্ধ্ব নেতারা। এদের বিরুদ্ধে পালটা প্রতিরোধ গড়ে তুললে এরা তখন পালিয়ে যায় এবং পুলিশ লেলিয়ে মিথ্যা মামলা দেয়। বর্তমানে পুলিশে নিজের মেরুদণ্ড বিকিয়ে তৃণমূলের নেতাদের বাজারের ব্যাগটাও বয়ে দেয়। যারা একটু সততার সাথে কাজের চেষ্টা করে তাদের একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে কাজ করতে বাধা দেয় রাজ্য সরকার। স্বাভাবিক ছাত্র রাজনীতির এত ক্ষতি করে কেন কলেজগুলি জবরদখল করে বসে আছে তৃণমূল?
এর উত্তর সহজ। ইদানীং সময়ে আরও স্পষ্ট হয়েছে। এডুকেশন স্ক্যাম বর্তমানে অন্যতম বড় দুর্নীতি। গত বারো বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে অ্যাডমিশনের নাম করে প্রায় তিরিশ হাজার কোটি টাকা তোলা তুলেছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতারা। এই টাকার অংশ নিচ থেকে উপর অবধি গেছে বলেই শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখনও চুপ রয়েছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেন হচ্ছে না
ছাত্র সংসদ নির্বাচন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রতি বছর হতো। এর কারণ প্রতি বছর ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস পরিবর্তন হয় এবং তারা একটা শ্রেণি থেকে আরেকটা শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। সেই কারণে প্রতি বছর সংসদ নির্বাচন হতো। এর জন্য হাইকোর্টে হয়ে নির্বাচন করানোর জন্য আলাদা পিটিশন করতে হতো না। নির্বাচনের দাবিতে রাস্তায় নামতে হতো না বিরোধী সংগঠনগুলিকে। বরং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কলেজের অভ্যন্তরে প্রচার করত সকলে। এসএফআই হেরেছে এবং একটানা বিরোধী ছাত্র সংগঠন সেখানে ছাত্র সংসদ চালিয়েছে এরকম নজির প্রচুর আছে। খাস কলকাতার বুকে সিটি কলেজ, যোগমায়া কলেজ, মুরলীধর কলেজ, বঙ্গবাসী কলেজে, আরও অনেক কলেজে এসএফআই বামফ্রন্ট সরকারের আমলে হয় দু’-একবার জিতেছে বা জিততে পারেনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে ১৯৭৬ সালের পর থেকে স্বাধীন মঞ্চ ইউনিয়ন চালাচ্ছে। আর্টসে এবং সায়েন্সে এসএফআই জিতেছে এবং হেরেছেও। প্রেসিডেন্সি কলেজে (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) এসএফআই জিতেছে মোট ৫বার বামফ্রন্টের আমলে (১৯৮০ এর দশকে একবার, ২০০২,২০০৩,২০০৯,২০১০) এবং বামফ্রন্ট সরকার যাওয়ার পর একবার (২০১৯)।
যারা বলে বাম আমলে গণতন্ত্র ছিল না তারা আসলে গল্পের গোরুকে গাছে তোলে। তাহলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করছে না কেন সরকার? এর প্রধানত দুটো কারণ। এক) নির্বাচন হলে কয়েকটা জায়গায় হলেও বিরোধীরা জিতবে এবং ছাত্র সংসদ তৈরি করবে। সেই জায়গাগুলোতে টাকা পয়সা লুটের কাজ করতে পারবে না তৃণমূল। দুই) ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র সরিয়ে দিয়ে কেবল নিজেদের এক অনুগামী এবং পৃষ্ঠপোষক বাহিনীকে দিয়ে একেবারে অরাজনীতির রাজনীতিকে সূক্ষ্মভাবে মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। সাধারণ ঘর থেকে আসা ছেলে মেয়েদের রাজনীতির ময়দানে আসতে বাধা দেওয়ার প্রয়াস। তাদের বাড়ির লোকেদের কাছে এমন বার্তা দেওয়া যে রাজনীতিতে আসলে খুন হবে, ভাঙচুর হবে, মিথ্যা মামলা হবে। এইসব করলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ভীত হয়ে ছেলেমেয়েকে রাজনীতির ময়দানে আসতে বাধা দেবে। ধীরে ধীরে নর্মালাইজ করবে সরকার যে ছাত্র রাজনীতি মনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নয়। ছাত্র রাজনীতি মানে মমতা মমতা করা! আক্ষরিক অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজ, ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা ছাত্র রাজনীতিতে না এলে পড়ার হাত কাটা, কানকাটারা, চোর, গুন্ডা, মাফিয়ারা মেইন স্ট্রিম পলিটিক্সের নেতা হবে এবং এরাই পরবর্তীকালে বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী হবে।
শেষবার ২০১৯ সাল এবং ২০২০ সালের শুরুতে কেবল প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর এবং রবীন্দ্রভারতীতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। এসএফআই বিপুলভাবে প্রেসিডেন্সি এবং যাদবপুরের আর্টসে জয়লাভ করে। যাদবপুরের আর দুটি ফ্যাকাল্টিতে অন্য দুটি মঞ্চ জয়লাভ করে। তৃণমূল এবং বিজেপি নিজের নামে যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সিতে সুবিধা করতে পারেনি। রবীন্দ্রভারতীতে জবরদখল করে বিরোধী প্রার্থীকে ভোট না দাঁড়াতে দিয়ে সংসদ দখল করে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। প্রেসিডেন্সি এবং যাদবপুরে হারের কাঁপুনির পর তৃণমূল সরকার অন্য কলেজে নির্বাচন করার সাহস পায়নি। ২০১৭ সালে রাজ্যের বাকি কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষবার ভোট হয়েছিল। ২০১৮ পর থেকে সেগুলো অবৈধ। কিন্তু বলপূর্বক ওই প্রতিষ্ঠানের ইউনিয়ন রুমগুলো দখল করে বসে তৃণমূলের এলাকার মস্তানরা।
রাজ্য সরকার অবিলম্বে ওই ইউনিয়ন রুমগুলোতে তালা লাগিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করুক। এসএফআই ভোটে লড়াই করতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। মাননীয় হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের। অবিলম্বে রাজ্যের সর্বত্র ছাত্র সংসদ নির্বাচন করানোর দাবি ছাত্রদের গণতান্ত্রিক দাবি।
Comments :0