Kudumbosree

৪৬ লক্ষ মহিলার আত্মসম্মানের ‘কুদুম্বশ্রী’

জাতীয়

পঁচিশ বছর পেরিয়ে এল ‘কুদুম্বশ্রী’। কেরালায় মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর এই প্রকল্প বিশ্বের বহত্তম বলে পরিচিত। আর দশটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করা চলে না। কৃষি থেকে উৎপাদন— এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে মেয়েদের এই গোষ্ঠী কাজ করছে না। কেরালায় গড়ে প্রতি আধ কিলোমিটার গেলেই কুদুম্বশ্রীর কোনও না কোনও ক্ষুদ্র প্রকল্প দেখতে পাওয়া যাবে। ৪৯,২০০ ক্ষুদ্র উদ্যোগ চালাচ্ছে তারা। ৩১,৫৮৯টি ব্যক্তিগত ইউনিট, ১৭,৬১১ গোষ্ঠীগত ইউনিট। প্রায় ৪৬ লক্ষ মহিলা সরাসরি এই প্রকল্পে জড়িত। এখন কুদুম্বশ্রী আর কোনও প্রকল্প নয়, এক অভিনব সামাজিক আন্দোলন। 
কেরালার বামপন্থীদেরই চিন্তাপ্রসূত এই স্বনির্ভরতার উদ্যোগ। মুখ্যমন্ত্রী ই কে নায়ানার, অর্থনীতিবিদ ও কেরালার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী থমাস আইজ্যাকের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৮-র ১৭ মে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকার দারিদ্র দূরীকরণ মিশনের অংশ হিসাবে এই প্রকল্প চালু করেছিল। ক্রমে তা হয়ে ওঠে মহিলাদের ক্ষমতায়নের জোরালো অস্ত্র। সরকার পরিবর্তন হলেও আন্দোলনের চেহারা নেওয়া এই প্রকল্প বন্ধ হয়নি। বাড়তে বাড়তে মহীরুহ হয়েছে। দারিদ্র দূরীকরণেও এই প্রকল্পের বিস্ময়কর অবদান রয়েছে। এই প্রকল্প চালুর আগে কেরালায় দারিদ্রের হার ছিল গ্রামে ২৫ শতাংশ, শহরে ২৪ শতাংশ। ২০২১-এর হিসাবে বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকে কেরালায় জনসংখ্যার মাত্র ০.৭ শতাংশ দরিদ্র। ১ লক্ষ ২৪ হাজার আদিবাসী পরিবার এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে। শুধুমাত্র আদিবাসী গোষ্ঠীই রয়েছে ৭১৩৫। 
কুদুম্বশ্রী কথার অর্থ পরিবারের কল্যাণ। এই প্রকল্পের ত্রিস্তর কাঠামো রয়েছে। নিচের স্তরে প্রতিবেশী  গ্রুপ, মধ্য স্তরে এলাকা উন্নয়ন সোসাইটি, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার পরিধিতে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি। পরিবারের একজন মহিলাই সদস্য হতে পারেন। এই মুহূর্তে প্রতিবেশী গ্রুপ বা ‘আয়ালকুটম’ রয়েছে ৩ লক্ষের বেশি। এই তিন স্তরেই নির্বাচিত কোর কমিটি কাজ করে। সব সদস্যেরই ভোটাধিকার রয়েছে। প্রতিবেশী গ্রুপের কো-অর্ডিনেটর স্থির করার জন্য প্রতি তিন বছর অন্তর সরাসরি ভোট হয়। পরের স্তরে তাঁরা আবার ভোট দেন। এই কো-অর্ডিনেটরদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র পরিবার থেকে। রাজ্য সরকার এই গোষ্ঠীগুলিকে সাহায্য করার জন্য জেলা ও রাজ্য স্তরে অফিসার ও কর্মচারীদের যুক্ত করে। 
কুদুম্বশ্রী গ্রুপ কৃষি কাজ করে, বিশেষ করে জৈব কৃষিতে তারা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। ৭৫ হাজারের বেশি গ্রুপ কৃষিতে জড়িত। কৃষি বাণিজ্যে রয়েছে ১২৩৫ ইউনিট। এছাড়াও পোলট্রি, দুগ্ধ উৎপাদন, ক্যাটারিং, পোশাক তৈরি, বিদ্যুতের বাল্ব তৈরি, স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদনের মতো অজস্র ইউনিট রয়েছে। নির্মাণকাজ করে ২২৮টি গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা ১১৮৪টি হোটেল চালান। ছোট চিকিৎসার ক্লিনিক চলে ৪০৫টি। 
শুধু অর্থনৈতিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কুদুম্বশ্রীর এই মর্যাদা থাকত না। এই প্রকল্পে মহিলারা যেমন পেশাদারি দক্ষতার প্রশিক্ষণ নেন, তেমনই মহিলাদের ক্ষমতায়নের সামাজিক পাঠও নিচ্ছেন। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা পণপ্রথা বিরোধী অভিযান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজেও সমান অংশগ্রহণ করেন। কোভিড মহামারীর সময়ে কমিউনিটি কিচেন চালিয়েছেন তাঁরা। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পাশাপাশি লিঙ্গ সমতা ও সামাজিক ক্ষমতায়নের প্রবাহ তৈরি হয়েছে। একটি উদাহরণ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নির্বাচন। ২০২০-তে এই স্তরের নির্বাচনে ১১ হাজার আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। তার ৭০৩৮ আসনেই জয়ী হয়েছেন কুদুম্বশ্রীর সদস্যরা। 
স্বীকৃতি এসেছে আন্তর্জাতিক স্তরেও। ২০২২-এ রাষ্ট্রসঙ্ঘের হ্যাবিট্যাট বেস্ট প্র্যাকটিসের বিশ্ব ১০০ তালিকায় কুদুম্বশ্রী স্থান পেয়েছে। দারিদ্র দূরীকরণ ও মহিলাদের ক্ষমতায়নের একাধিক বিশ্ব তালিকাতেই একে মডেল বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।  
এই হচ্ছে আসল কেরালা স্টোরি।

Comments :0

Login to leave a comment