Sanchar Sathi

মোদীর নজরদারিতে দেশের সব নাগরিক

সম্পাদকীয় বিভাগ


আধুনিক সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। সুস্থ ও স্বাভাবিক সামাজিক পরিমণ্ডলের জন্য ক্ষতিকারক নয় এমন যেকোন ধরনের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আচরণ, কার্যকলাপ এমন উদার গণতান্ত্রিক সমাজে স্বীকৃত। আসলে ব্যক্তি পরিসরের গোপনীয়তা, স্বতঃস্ফূর্ত আচরণের স্বাধীনতা না থাকলে কোনও মানুষের দক্ষতা, প্রতিভা, সৃজনশীলতার উন্মেষ ও বিকাশ সম্ভব নয়। মনের আনন্দে, আপন খেয়ালে যদি মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ না পায় তাহলে সম্ভাবনাই কুঁড়িতে শুকিয়ে যাবে। তাই যেকোনও রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান কাজ নাগরিক চেনতার ও সৃষ্টিশীলতার পথ সুগম ও প্রশস্ত করা। উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই পথেই অগ্রসর হয় এবং সেই পথেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করে ও নিয়ম বিধি তৈরি করে। রাষ্ট্র বা সরকার সমাজকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করবে তবে সেটা একটা সীমা পর্যন্ত। কোনও অবস্থাতেই আধিপত্যকামী বা কর্তৃত্ববাদী হতে পারে না। এমন উদার সমাজ বিকশিত হয়ে ওঠে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। এখানে নাগরিকদের সরকার কড়া নজরদারির মধ্যে রেখে নিয়ন্ত্রণ করে না সরকার। নাগরিকদের ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলায় না। ব্যক্তি স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করে না।
স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলনই গুরুত্ব পেয়েছে। মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত তা প্রত্যহৃত বা সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থে‍‌কে দ্রুত পালটাতে শুরু করেছে চিত্রপট। এই জমানায় নাগরিকদের গৌণ করে রাষ্ট্রকে মুখ্য করা হচ্ছে। দেশকে উচ্চাসনে বসিয়ে দেশবাসীকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা হচ্ছে। এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে যে নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের জন্য নাগরিক। দেশবাসীর জন্য দেশ নয়, দেশের জন্য দেশবাসী। স্বাধীনচেতা, সচেতন, উদ্ভাবনপ্রিয় মানুষ তাই এই জমানার চোখে বিপজ্জনক। এরা শাসকের অন্ধ ভক্ত হয় না, এরা যুক্তি‍‌, বিজ্ঞানকে বেশি গুরুত্ব দেয়, এরা পদে পদে শৃঙ্খলকে সহ্য করে না। এই মানুষের হাতে বেড়ি পরিয়ে রাষ্ট্র তথা শাসকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে। এমনটাই নজরদারি রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। মোদীরা ভারতকে নজরদারি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। যেখানে কোনও নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। নাগরিকের প্রতিদিনে জীবন-ধারণের প্রতিটি পদক্ষেপ রাষ্ট্রের গোচরে উন্মুক্ত থাকবে। ডিজিটাল যুগে ইন্টানেট ব্যবস্থায় কোনও নাগরিক যে তথ্য-মতামত পাঠাবেন বা গ্রহণ করবেন, মোবাইলে ব্যক্তিগত বা একান্তই নিজস্ব বলে রক্ষিত সব কিছুই মোদীর সরকার দেখতে চায়। কোনও নাগরিকের কোনও কিছু গোপন থাকুক মোদী সরকার চায় না।
এরজন্যই ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ ভারতে ব্যবহৃত প্রতিটি মোবাইলে বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ এসেছে। কেউ বা কোনও মোবাইল যাতে এই আওতার বাইরে না থাকে তাই মোবাইল নির্মাতা কোম্পানিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তৈরির সময়ই এই অ্যাপ ঢুকিয়ে দিতে যাতে একে নিষ্ক্রিয় বা মুছে ফেলা না যায়। তেমন পুরানো ফোনগুলিতে সিস্টেম আপডেট হলেও নিজে থেকে এই নরজদারি অ্যাপ ঢুকে যাবে। গোপন নজরদারির পাঠ ঢুকিয়ে দিয়ে মোদী সরকার প্রকাশ্যে প্রত্যেক নাগরিককে রাষ্ট্রীয় কড়া নজরদারির আওতায় নিয়ে এসেছে। অতি দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ত প্রবণতার এটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এরা নাগরিকদের বিশ্বাস করে না, শত্রু ভাবে, সন্দেহ করে, ভয় পায়। তাই নাগরিকদের যাবতীয় গতিবিধির উপর কড়া নজর রেখে কড়া শাসনে অনুগত করে রাখতে চায়।

Comments :0

Login to leave a comment