SCHOOL JOB SCAM CANDIDATES

যোগ্য বঞ্চিতদের চাকরির কী হবে, উদ্বেগ আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের

রাজ্য

 ‘এই সরকার যতদিন থাকবে, এমন দুর্নীতি আরও ভুরি ভুরি হবে। দুর্নীতির শিরোমণি মুখ্যমন্ত্রীর আগে মনে ছিল না যে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা যায় না? অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিৎ’। সোমবার সকাল সাড়ে দশটায় আদালতের রায় বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই একরাশ আনন্দাশ্রু মেশানো প্রতিক্রিয়া এভাবেই বেরিয়ে এসেছিল ধর্মতলায় গান্ধীমূর্তির নিচে আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে থেকে। বৃহৎ চাকরি দুর্নীতিতে প্রায় ২৬ হাজার বেআইনি চাকরি বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেন তাঁরা। কিন্তু পাশাপাশি এরপর তাঁদের চাকরির কি হবে, কবে হবে, আদৌ হবে কি- তা নিয়েও উদ্বেগ আর আশঙ্কা ঝড়ে পড়লো এই চাকরিপ্রার্থীদের বক্তব্যে।
এদিন এসএসসি নিয়ে আদালতের রায় বেরোবে–এই খবর ছিলই আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের কাছে। তাঁদের অনেকেই এদিন কলকাতা হাইকোর্টে ভিড় করেছিলেন বিচারপতিদের রায় জানতে। গোটা রায় বেরতেই অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেছিলেন- ‘এই দিনটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের এত কষ্টের লড়াই, পথে বসে, শুয়ে ১১৩৫ দিনের এই সংগ্রাম ব্যর্থ হবে না জানতাম। কমিশনের মাথায় যাঁরা বসে রয়েছেন তাঁরাই তো শাসকদলের নেতা মন্ত্রীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একযোগে এই দুর্নীতি করেছে। তাঁদের উপর নিয়োগ প্রক্রিয়ার ভার ছেড়ে দিলে আবারও এমন ঘটনা ঘটবে।’ এই আশঙ্কার কথাও শোনা গেল অবস্থানরত বঞ্চিত যোগ্য চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে। 
সোমবার এসএসসি দুর্নীতি মামালার রায়ে কলকাতা হাইকোর্ট ২০১৬ সালের  নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ ও প্রুপ সি এবং প্রুপ ডি এর নিয়োগকে অবৈধ জানিয়ে দিয়েছে। পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই বাতিল করে দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে যারা  অনৈতিকভাবে নিয়োগ হয়েছে তাদের সুদ সমেত সমস্ত বেতনের টাকাও ফেরৎ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই রায়ের পরেই দীর্ঘদিন ধরে কলকাতার রাস্তায় চাকরির দাবিতে  ধর্নায় বসে থাকা যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা আপ্লুত। অনৈতিকতার বিরুদ্ধে, চাকরি চুরির বিরুদ্ধে আদালতের এই রায়কে তারা স্বাগত জানাচ্ছেন। এসএলএসটি চাকরিপ্রার্থীদের বক্তব্য, ‘ওদের টাকা ফেরৎ দিতেই হবে, ওই টাকা তো আমাদের প্রাপ্য। আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে কতদিন চালাবে ওরা।’  
তবে তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, এই দুর্নীতির কারণে পুরো প্যানেল বাতিল হয়ে যাঁরা তাঁদের হকের চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে ভাবার দরকার আছে। দুর্নীতির পথ অবলম্বন করে, তৃণমুলের নেতা-মন্ত্রীদের লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে অনৈতিকভাবে অনেকেই চাকরি পেয়েছিলেন। অন্যদিকে যারা রাতদিন এক করে পড়াশোনা করে নিয়োগের পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন তারা তাদের হকের চাকরি না পেয়ে টানা ১১৩৫ দিন কলকাতার রাস্তায় ধর্নায় বসে রয়েছেন। এই চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে এরপর কী হবে –তা অনিশ্চিতই থেকে গেল এখনো পর্যন্ত। 
গান্ধী মূর্তির পাদদেশে অবস্থানরত  একাদশ- দ্বাদশে সফল বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী স্বরূপ বিশ্বাস এদিন বলেন, আদালতের রায়ে আমরা খুশি। চুরি, দূর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতের এই রায়ে আইনি ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা ভরসা অনেকটা বেড়ে গেল। একাদশ- দ্বাদশের নিয়োগ পরীক্ষায় সফল অপর একজন  চাকরিপ্রার্থী  দেবযানী মন্ডলের কথায়, কিন্তু ওই দুর্নীতির দায় আমাদের কেন পোহাতে হবে? আমরা তো কোনও দুর্নীতি করিনি, নিয়োগ পরীক্ষায় স্বচ্ছতার সঙ্গে সফল হয়েছি। আমাদের জন্য আদালত কিছু ভাবনা চিন্তা করবে আশা করি। যোগ্য বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী মৌসুমি ঘোষ দাস এদিন বলেন, আমরা বরাবর আইনের পথেই যেতে চেয়েছি, এই রায়কে স্বাগত। আদালত বলেছে, ১৭ রকমের দুর্নীতি হয়েছে। এতগুলি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা মুখ্যমন্ত্রীর আগে মনে ছিল না? তাঁর তো এখনই পদত্যাগ করা উচিৎ। গোটা দেশের কাছে তো এ রাজ্যের মাথা হেঁট করে ছাড়লেন উনি। 
এ প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা ইন্দ্রজিৎ ঘোষ এদিন বলেন, তৃণমুল সরকারের এই চুরি, দুর্নীতির জন্য  রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই কালো দিন দেখতে হচ্ছে। তিনি আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, অযোগ্যদের বাদ দিয়ে যোগ্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে দ্রুত সদর্থক ভুমিকা নিতে হবে। এই রায়ের ফলে বেশ কিছু যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হলো। তিনি বলেন, প্যানেল পূর্নমূল্যায়ন হওয়ার পর বর্তমান যারা চাকরি পাবেন, তাদের সার্ভিস কন্টিনিউ করতে হবে। 
গত ১১৩৫ দিন ধরে রোদ ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গান্ধী মূর্তির নিচে চাকরির দাবিতে আন্দোলনরত রয়েছেন যোগ্য বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা। ২০১৬ সালে নবম থেকে দ্বাদশ শিক্ষক নিয়োগে বেনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার তাঁরা। মেধা তালিকায় প্রথম দিকে থাকা প্রার্থীদের নিয়োগ না করে তালিকার পেছনে থাকা প্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়-এর প্রতিবাদে নবম থেকে দ্বাদশের অপেক্ষমাণ সমস্ত বিষয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রার্থীরা ধর্মতলায় ধরনায় বসেন ২০১৯ সালে। প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরেও কোনো সমাধান হয়নি। 
মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের অনশন মঞ্চে গিয়ে স্বচ্ছ নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু তার কোনো সুরাহা হয় না। ফলে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন চাকরিপ্রার্থীরা। একসময়ে পুলিশি অত্যাচারের শিকারও হন তাঁরা। তবুও এই ভাবী শিক্ষকরা আন্দোলন চালিয়ে ১১৩৫ দিন পার করেছেন। তাঁদের ধর্নামঞ্চে গিয়ে বারবারই আশ্বাস দিয়েছিলেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সহ বামফ্রন্টের বিভিন্ন নেতৃত্ব ও কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা। অবশেষে এদিনের রায়ে অনেকটাই স্বস্তি এসেছে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের। একইসঙ্গে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, অযোগ্যদের চাকরি বাতিল হল ঠিকই কিন্তু যোগ্যদের চাকরির কী হবে।      

Comments :0

Login to leave a comment