অনিন্দ্য হাজরা
‘বিরাসত’ এবং বিকাশের মেলবন্ধনে এগিয়ে যাবে ভারত।
শনিবার অযোধ্যার মাটিতে দাঁড়িয়ে এমনটাই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
‘বিরাসত’। হিন্দি শব্দ। বাংলায় এর মানে ঐতিহ্য। রাম মন্দিরের শেষ মুহূর্তের কাজ দেখতে শনিবার অযোধ্যায় পা রাখেন প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধন করেন অযোধ্যা বিমানবন্দরের, এবং নতুন করে সাজানো অযোধ্যা রেল স্টেশনের। তারপর প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা রোড শো। সব শেষে জনসভা।
সেই জনসভার মূল নির্যাস, আগামী দিনে ‘বিরাসত’ এবং বিকাশের যুগলবন্দীতে এগোবে ভারত।
নতুন বছরেই প্রশ্ন হলো, ঠিক কোন ঐতিহ্যের কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী?
অযোধ্যায় ৫০০ বছর পুরনো মসজিদ, ঐতিহাসিক স্মারক ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঐতিহ্য আমাদের? এটাই মোদীর নয়া ভারতের ঐতিহ্য? এটাই আমাদের ‘বিরাসত’?
জনসভায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী চন্দ্রযান প্রকল্প নিয়ে গর্বের বাণী শুনিয়েছেন। চাঁদ, তারা মঙ্গলগ্রহ অভিযানের কথা শুনিয়েছেন তিনি। অথচ চলতি বছরে স্কুলের পাঠ্যবই থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব। যেই তত্ত্বকে বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ার প্রথম ধাপ বলা হয়।
কেন? কারণ ডারউইন প্রস্তাবিত বিবর্তনবাদ বলে থাকে, বিবর্তনের ধাপে একসময় অভিন্ন পূর্বপুরুষ ছিল বাঁদর এবং মানুষের। এককোষী প্রাণ থেকে বিবর্তিত হতে হতে বর্তমান রূপ পেয়েছে প্রাণী সমাজ। ডারউইন বলেছেন, কোটি কোটি প্রাণীর ভিড়ে মানুষ কেবলমাত্র একটি প্রাণী। কিন্তু পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থ বলছে, মানুষ দেবতাদের সবথেকে উন্নত সৃষ্টি। পুরাণের সঙ্গে মেলে না বলে কোপ পড়েছে ডারউইনের উপর।
প্রাচীন ভারতে তর্কশাস্ত্রের ঐতিহ্য রয়েছে। বীজ রয়েছে বস্তুবাদের। সেই ঐতিহ্যকে পর করছে মোদীর 'নতুন ভারত'। বিরোধী স্বর থাকলেই দেশদ্রোহী!
মোদীর নয়া ভারতে আইপিসি, সিআরপিসি, এভিডেন্স অ্যাক্টের বদলে স্থান পেয়েছে ন্যায় সংহিতা। ইংরেজ আমলের দানবীয় আইনগুলিকে নতুন জামা-কাপড় পরিয়ে, আরও হিংস্র রূপ দিয়ে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে সেই সংহিতায়। উদ্দেশ্য ভিন্ন স্বর দমনেরই।
এমনিতেই ফসলের অধিকার, ন্যায্য দামের অধিকারের দাবিতে আন্দোলনরত অন্নদাতাদের শুনতে হয়েছে তাঁরা নাকি দেশদ্রোহী। খালিস্তানি। ক্যাম্পাসের মুক্তমনা পড়ুয়াসমাজ সরকারি নীতির বিরোধিতা করে দেশদ্রোহীর খেতাব পেয়েছে।
ইংরেজ আমলের আইনকে রক্ষা করা হলেও বর্জন করা হচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্যকে। সেই ঐতিহ্যের ফলে গড়ে উঠেছে ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সংবিধান। জণগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদে জবাবদিহি করবে সরকার। জনগণই সর্বোচ্চ।
সেই ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছেন মোদীজী। শীতকালীন অধিবেশনে দেড়শোর কাছে বিরোধী সাংসদকে বরখাস্ত করে পাশ করিয়েছেন এই সংহিতা।
দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মহিলা এবং দলিত, আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের ঘটনা। রবিবার খবরে এসেছে উত্তর প্রদেশের এক কন্যার কথা। দলিত জাতির সেই কন্যাকে শ্লীলতাহানীর পরে ফুটন্ত তেলের পাত্রে ঠেলে ফেলে দিয়েছে উচ্চবর্ণের দুষ্কৃতীরা।
২০২৩ সালে দেশের পদকজয়ী কুস্তিগীররা আন্দোলনে শামিল হন কুস্তি ফেডারেশন সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে। তিনি আবার উত্তর প্রদেশ থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ। অত্যাচার নামানো হয়েছে সাক্ষী মালিক, ববিতা ফোগট, বীনেশ ফোগটদের উপর। এখনও আইনের আওতার বাইরে রয়েছেন ব্রিজভূষণ।
এই ভারতে ঐতিহ্য এমনই পরাক্রমের?
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, মোদীর নয়া ভারতের ভিত্তি কী জাত-পাতের রাজনীতি? চলতেই থাকবে সামাজিক নিপিড়ন? কোটি কোটি টাকার সরকারি ব্যায়ে নির্মিত হবে মন্দির। আর দলিত অংশকে এখনও আন্দোলন করতে হবে উচ্চবর্ণের ‘এলাকা’ দিয়ে জুতো পরে হাঁটার জন্য?
দেশের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল নির্দেশমূলক নীতি সমূহ। স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্যকে মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছিল সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গ। এই নীতি অনুযায়ী, মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ অন্যায়। রাষ্ট্রের কর্তব্য সেটা রোধ করা। বর্তমানে চরম অসাম্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সরকারের বদান্যতায়। আদানি গোষ্ঠীকে নিয়ে প্রশ্ন করলে সাংসদপদ খোয়াতে হয় বিরোধী সাংসদদের।
একইসঙ্গে ভারতের সমন্বয়, বহুত্ববাদের ঐতিহ্যকেও তুলে ধরতে ভুলে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তাঁর বর্তমান ভারতে লাগামছাড়া দুর্নীতি। ধান্দার ধনতন্ত্রের লাগসই অফুরন্ত দলবদল। ভোটে কর্পোরেটের টাকা, তা আবার গোপন করতে নির্বাচনী বন্ড।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার পাব্লিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারপার্সন মুকুল রায় কোন দলের বিধায়ক রাজ্যবাসী জানেন না। মোদীর গোয়েন্দারা জমা দিতে পারেন না চার্জশিট। দিলেও বাদ যায় মাথাদের নাম। আদালত গাল পাড়লে বিচারপতির পরিবারকে নিয়ে টানাটানি করে রাজ্যের সিআইডি। সবই মোদীর মেয়াদে।
কোন ঐতিহ্য এবং কার বিকাশ?
তুমুল বেকারত্ব। মূল্যবৃদ্ধি চরমে। নয়া বাস্তবতা হল উগ্র হিন্দুত্বের জিগির তুলে ভোটে লড়া। জীবন জীবীকার সমস্ত ইস্যু গৌণ।
এটাই বিরাসত? এটাই নতুন ভারত? প্রশ্ন তুলছে নতুন বছর।
Comments :0