‘আচ্ছে দিনের বদলে উঠে এল ‘বিকাশিত ভারত’র কথা! আসলে ‘আচ্ছে দিন’ উধাও, তাই এখন নরেন্দ্র মোদীর ভাষায় ‘রামরাজ্য’র স্বপ্ন ফিরি করা হলো। ঘোষিত প্রতিশ্রুতি পালনের ব্যর্থতা ঢাকতেই নয়া প্রতিশ্রুতির আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন ভারতের অর্থ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। আগামী পাঁচ বছর ছাড়িয়ে মোদীর মতোই ২০৪৭ সালের ‘দিশা’ দেখালেন তিনি। বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী বাজেট পেশের সময় মোদী সরকারের একগুচ্ছ কাজের ফিরিস্তি শোনা গেল তাঁর মুখে, বাস্তবের সঙ্গে যার মিল যৎসামান্যই। চাকরি কিংবা কর্মসংস্থানের দিশা নেই, কৃষির উল্লেখ থাকলেও কৃষক সমাজের দাবিমাফিক ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি স্বীকৃতি কথাও ধারকাছ দিয়ে গেলেন না। অবশ্য ভোটের কথা মাথায় রেখে পরিকাঠামো খাতে ১১.১১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি এও জানিয়ে দিলেন, আগামী দিনে তাঁরা ক্ষমতায় ফিরলে অর্থনৈতিক সংস্কার কিংবা উন্নয়নের গতি আরও বাড়িয়ে দেওয়া হবে কয়েক গুণ। অবশ্য এই উন্নয়নের মডেলকে ‘ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে শুষে নেওয়ার’ নীতি বলে মোদী সরকারকে বিঁধেছেন বামপন্থীরা।
‘ক্ষমতায় ফিরছেনই’, এমন এক ভান করে এদিন অর্থ মন্ত্রী অন্তর্বর্তী বাজেট পেশের সময় জানিয়ে দিলেন, ‘আগামী পাঁচ বছর অভাবনীয় উন্নয়ন এবং স্বর্ণালী সমস্ত মুহূর্ত উপলব্ধী করতে পারবেন ভারতবাসী। ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণই আমাদের লক্ষ্য।’ তিনি বলেছেন মাত্র ৫৬ মিনিট, তবে এই সামান্য সময়ে শুনিয়েছেন অনেক লম্বা-চওড়া বাণী। তিনি দাবি করেছেন, গত ১০ বছরে নজিরবিহীন বিকাশ ঘটেছে দেশে। বিজেপি-আরএসএস মেরুকরণের রাজনীতি করলেও এদিন তাঁর মুখে শোনা গেল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’-এর গল্প। মোদী সরকার ‘সংস্কার করো, কাজ করো, বদলে দাও’র নির্দেশিকা মেনে এগিয়ে চলেছে বলে দাবি করলেন তিনি। এই পথেই আগামী প্রজন্মের সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া বলে জানালেন ভাষণে। বস্তুত, এটা পূর্ণাঙ্গ বাজেট নয়। আগামী চার মাসের খরচ চালানোর অনুমোদনেই পেশ করা হয় ‘ভোট অন অ্যাকাউন্ট’ বা অন্তর্বর্তী বাজেট। ভোটের পর নতুন সরকার গঠিত হলে সম্ভবত জুলাই মাস নাগাদ পেশ হবে পূর্ণাঙ্গ বাজেট। অথচ এই বাজেট পেশেই মোদী সরকারের কাজের খতিয়ান এবং প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটালেন সীতারামন।
এদিন তাঁর পেশ করা বাজেটে গত বছরের তুলনায় খাদ্য, সার এবং জ্বালানিতে ৮ শতাংশ ভরতুকি কাটছাঁটের প্রস্তাব রয়েছে। আবার গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম হাতিয়ার ‘রেগা’য় বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি, অপরিবর্তিতই থাকছে। নগরোন্নয়নেই বরাদ্দ ছাঁটা হয়েছে। পরিকাঠামো খাতে ১১ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ১১.১১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রয়েছে। ওই অর্থ সড়ক, বন্দর এবং বিমানবন্দর নির্মাণে ব্যয় করা হবে। আবার পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে ১.৩ লক্ষ কোটি ঋণ দেওয়ার কথাও রয়েছে। ভোট অন অ্যাকাউন্ট হলেও মধ্যবিত্তের জন্য আগামী পাঁচ বছরে ২ কোটি সাধ্যের মধ্যে বাড়ি বানিয়ে দেবে সরকার বলে ঘোষণা করলেন অর্থ মন্ত্রী। ‘গোমাতা’-দের জন্যও ঘোষণা রয়েছে বাজেটে। ভারতে দুধ উৎপাদনকারী গবাদি পশুদের উৎপাদনের পরিমাণ অনেকটাই কম। এই অবস্থাকে সামাল দিতেও এবার বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু করবে কেন্দ্র। রাষ্ট্রীয় গোকূল মিশন, জাতীয় পশুসম্পত্তি মিশন ও পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে। মৎসচাষে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হবে। প্রতি হেক্টর উৎপাদন ৩ টন থেকে বাড়িয়ে ৫ টন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০২৪ সালের বাজেট। তিনি জানালেন, আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হবে আশা এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের। আয়ুষ্মান কার্ড থাকলে প্রতি বছর ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিমা পাওয়া যায় বিনামূল্যেই। দেশের ১ কোটি পরিবারকে মাসে ৩০০ ইউনিট বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে সীতারামন প্রমাণ করে দিলেন যে, ভোটের কথা ভেবেই বাজেট পেশ করছেন তিনি। আবার আয়কর নিয়ে নানা জল্পনা থাকলেও কোনও নতুন কর কাঠামোর কথা এদিন ঘোষণা করেননি তিনি। ব্যক্তিগত এবং কর্পোরেটের কর এখনও পর্যন্ত অপরিবর্তিতই রাখা হয়েছে। আবার সার্বভৌম সম্পদ তহবিল এবং পেনশন তহবিল কর-মুক্ত রাখা হচ্ছে।
২০২৩-২৪ সালে রাজস্ব আদায় গত আর্থিক বছরের তুলনায় ১৩.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও আর্থিক ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অনুমিত হিসাবের তুলনায়। আর এই সরকারি ব্যয় হ্রাসের কোপ পড়েছে কল্যাণমূলক প্রকল্পের পাশাপাশি মূলধনী ব্যয়ের ঘাড়ে। তবে এবারের অন্তর্বর্তী বাজেট ঘোষণাকালে সীতারমন মূলধনী ব্যয় এবং সামাজিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন। গত বাজেটের তুলনায় ৬.১ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে মোট ৪৭.৬৬ লক্ষ কোটি টাকার অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করেন তিনি। বাজার থেকে ১৪.১৩ লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহের কথা আছে বাজেটে। কোষাগারীয় ঘাটতিও ৫.১ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি শুনিয়েছেন অর্থ মন্ত্রী।
Comments :0