মণ্ডা মিঠাই
সাঁওতাল বিদ্রোহ ও হুল দিবসের মাহাত্ম্য
সৌম্যদীপ জানা
নতুন বন্ধু
নতুনপাতা
“বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান"
সাঁওতাল বিদ্রোহ ,যা সাদাসিধে সাঁওতালদের হাতে অস্ত্র উঠে আসা তা আক্ষরিক অর্থেই প্রমাণ করে দেয় এই পংক্তিটি। তুমি শাসক তোমার কাজ প্রজাগনকে সুখে স্বাচ্ছন্দে রাখা। তাদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া। রাজা ছাড়া প্রজা অসম্পূর্ণ । প্রজা ছাড়া রাজা। কিন্তু শাসক যখন অত্যাচারী হয়ে ওঠে তখন সরল সাদাসিধে মানুষও পরিণত হতে পারে বিদ্রোহী অগ্নিস্ফুলিঙ্গে।
সময়টা ১৮৫৫ সাল। ব্রিটিশ শাসকরা ভারত দখল করেছে তাও ১০০ বছর হলো। ব্রিটিশদের স্বভাবই হলো সম্প্রসারণ, কিন্তু সম্প্রসারণের সুন্দর পর্দার আড়ালে যে কি কুৎসিত চক্রান্ত জড়িয়ে আছে তা সরল সাদাসিধে সাঁওতালরা প্রথমে বুঝতেই পারেনি। সাঁওতালরা বনচারী আদিবাসী জনজাতি। তাদের কাজই হল বনে পাহাড়ে উপত্যকায় বসবাস করা, অস্থায়ী কৃষিকাজ, ফলমূলসংগ্রহ ,শিকার ইত্যাদি করা। সাধারণ সভ্য মানুষের কাছে তাদের কোনো দাবিদাওয়া ছিল না। তারা চেয়েছিল কেবল তাদের এলাকার স্বায়ত্তশাসন এবং সামান্য কিছু রুজির সন্ধান। কিন্তু সেই সামান্য চাহিদা ব্রিটিশ সরকার মেটাতে তো পারেইনি উল্টে তাদের নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে তাদের অধিকৃত ফসলের জমি, জঙ্গল এমনকি ঘরবাড়ি পর্যন্ত অধিগ্রহণ করতে লাগলো।
তারা যুক্তি দেখালো এইসব সরকারি জমি, সাঁওতালরা বেআইনিভাবে তা দখল করেছে। তাই সরকারি হুকুম অনুযায়ী তাদের এই জমি ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সাঁওতালদের জমির পরিবর্তে একটা পয়সাও দেওয়া হয়নি। অতএব তাদের ধন-প্রাণে উচ্ছেদ করাই ছিল ব্রিটিশ সরকার এবং দেশীয় মহাজনদের প্রধান উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ সরকারকে এই উচ্ছেদের কাজে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল দেশীয় মহাজন এবং অত্যাচারী জমিদাররা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিরক্ষর সাঁওতালদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের রাজ্যে বেগার খাটানো এবং তাদের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
অতঃপর ব্রিটিশ কোম্পানি এবং দেশীয় মহাজন জমিদারদের ত্রিমুখী চাপে সাঁওতালদের জমি ছাড়তে বাধ্য হতে হয়। অনেক সময় সরল সাঁওতালদের নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে তাদের অর্থলোভ দেখিয়ে টিপ ছাপ দিয়ে জমির অধিকার নিয়ে নিত ব্রিটিশ সরকারের বা দেশীয় মহাজনরা। এই অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তৎকালীন সময় গোটা সাঁওতাল সমাজ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই সময় বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাহেবগঞ্জ জেলায় এক সাঁওতাল গ্রামে একই পরিবারের ছয় ভাই- বোন সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, ফুলমণি এবং রানু মুর্মু ব্রিটিশ সরকার এবং দেশীয় মহাজন যাদের সাঁওতালি ভাষায় দিকু বলা হত তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সাহেবগঞ্জ থেকে শুরু হওয়া এই বিদ্রোহ পরবর্তীকালে উত্তরে ভাগলপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। শুধুমাত্র বিহার ই নয় বাংলার মুর্শিদাবাদ,বীরভূম ,পুরুলিয়া ইত্যাদি অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই আন্দোলনের প্রভাব।
কেবলমাত্র সাঁওতাল মানুষদের অধিকারের ক্ষেত্রেই এই আন্দোলন গুরুত্বপূর্ন নয়। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামেও এই আন্দোলনের প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবশেষে এই আন্দোলনের সাফল্য সাঁওতালরা পেয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হলে পরবর্তীকাল ব্রিটিশ সরকার সাঁওতাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে নিয়ে সাঁওতালদের আলাদা পরগনা সাঁওতাল পরগনা রাজ্য গঠন করেছিল। সেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে কত হাজার হাজার সাঁওতালের প্রাণ অকালেই ঝরে গিয়েছিল। কত সাঁওতাল মায়ের কোল খালি হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ সিপাহীদের এক গুলিতেই। সিধু সর্দার তো ব্রিটিশ সিপাহীদের গুলিতেই শহীদ হন। পরবর্তীকালে কানুর ফাঁসিও হয়। সাঁওতালদের সারল্যকে ব্রিটিশরা হেয় করেছিল।
কিন্তু এই সরল সাদাসিধে বনচারী আদিবাসীরাও যে এত বিদ্রোহী হতে পারে তা ব্রিটিশ সরকার কল্পনাও করতে পারেনি। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ৩০ শে জুন থেকে প্রতিবছর হুল দিবস পালিত হয়ে আসছে। এই দিন সমগ্র ভারতবর্ষের নানান জায়গায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষেরা গর্বের সঙ্গে হুল দিবস উদযাপন করেন এবং তাদের পূর্বপুরুষদের অসাধারণ বীরত্বকে স্মরণ করেন। প্রতিবছর ৩০ শে জুন দেশের বিভিন্ন জায়গায় সিধু ও কানুর মূর্তিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ।
আজও প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিম্ন শ্রেণীর বনচারী আদিবাসীরা লাঞ্ছিত,পীড়িত। কিন্তু এই বনচারী আদিবাসীরাই ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রথম পদক্ষেপের গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা পালন করেছিল তা ভারতবাসী আজীবন স্মরণ করবে।
অষ্টম শ্রেণী, কল্যাণ নগর বিদ্যাপীঠ
খড়দহ, ডাঙ্গাপাড়া, খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা, মো: ৮৬৯৭১৬৯৪৭০
Comments :0