বাঁকুড়া জেলার একটা বড় অংশের মানুষের জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল জঙ্গল। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে আদিবাসী উন্নয়নে সামূহিক গোষ্ঠী ‘ল্যাম্পস’-এর মাধ্যমে জঙ্গল থেকে কেন্দুপাতা সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করা হত এবং সেগুলি নিয়মিত নিলাম করা হতো। এখন সব ল্যাম্পসকে অকেজো করে রেখেছে তৃণমূল।
শীতকাল কেন্দুপাতার মরশুম। কিন্তু নিলাম না হওয়ার ফলে কোটি কোটি টাকার কেন্দুপাতা স্রেফ নষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে নানান আছিলায় প্রায় প্রতিদিনই ধ্বংস করা হচ্ছে বনাঞ্চল। এর ফলে একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাচ্ছেন আদিবাসী মানুষ, অপরদিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আদিবাসী অংশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কমেছে তৃণমূলের। ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২১’র নির্বাচনে বামপন্থীদের এলাকাছাড়া করে রাখায়, সেই ক্ষোভের ফসল তুলেছে বিজেপি।
এর পাশাপাশি বেআইনি ভাবে বালি খনন করে দ্বারকেশ্বর, কংসাবতীর মতো নদীগুলিকে কার্যত আইসিইউতে পাঠিয়েছে তৃণমূল আশ্রিত সিন্ডিকেটগুলি। তারফলে ফি বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলে ভাসে জেলার একের পর এক ব্লক।
জেলার কৃষি ভীষণ ভাবে সেচ নির্ভর। সেচের জলের মূলত আসত কংসাবতী জলাধার থেকে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে এই জলাধারের জলে খারিফ মরশুমে প্রায় ৩ লক্ষ হেক্টর জমি সেচ করা হত। রবি মরশুমে সেটা ছিল ৪৫ হাজার হেক্টর এবং বোরো মরশুমে প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের জল পৌঁছত। বর্তমানে সবটাই বন্ধ। কেন?
কারণ রাজ্য সরকার কংসাবতী জলাধারের সংস্কারে হাত দিয়েছে। স্থানীয় স্তরে অভিযোগ, এই সংস্কারের ‘গুড়’ খাচ্ছেন নির্দিষ্ট একজন ঠিকাদার- জয়ন্ত মিত্র। তিনি একসময় তৃণমূল পরিচালিত খাতড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে বিজেপিতে। গুঞ্জন শোনা যায়, তিনি ফের তৃণমূলে ফেরার তদ্বির করে চলেছেন।
তাঁর তৃণমূলে ফেরার বিষয়ে এখনও স্পষ্ট না হলেও, তাঁর ‘করে খাওয়ার’ পথে বিন্দুমাত্র বাধা সৃষ্টি করতে নারাজ তৃণমূল। যদিও তারফলে সেচের জল না পেয়ে কার্যত সর্বস্বান্ত হওয়ার জোগাড় বাঁকুড়া জেলার কয়েক লক্ষ ক্ষুদ্র এবং মাঝারি কৃষক।
যত দিন গিয়েছে, ততই স্পষ্ট হয়েছে, তৃণমূল আর বিজেপি আদপে জয়ন্ত মিত্রের মতো লোকেদেরই অবাধ আনাগোনার ‘কমন’ ক্ষেত্র। যাঁরা স্রেফ অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে দলবদল করে চলেছেন। এই দুই দলের বিকল্প হিসেবে স্বাভাবিক ভাবেই জেলাজুড়ে নতুন করে বামপন্থীদের সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়েছে । এবং তারফলেই আমূল বদলাতে শুরু করেছে ২০১৮,২০১৯ কিংবা ২০২১ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। রাঢ় বাংলার ‘নিশ্চিত’ জেলা হাতছাড়া হওয়ার ভয় ইতিমধ্যেই ঢুকে গিয়েছে বিজেপির অন্দরে।
সেই ভয় আরও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণ- গ্রামীণ জনতার জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে নিয়ে পুরোনো ঘাঁটিগুলিতে ফের নড়াচড়া শুরু হয়েছে লালঝান্ডার। যেমন সারেঙ্গার হাবড়া অঞ্চল। ২০০৯ সালে মাওবাদী জোট বাহিনীর হাতে এই অঞ্চলে খুন হন বাণেশ্বর মুর্মু এবং রামদাস মুর্মু। তৎকালীন মাওবাদীদের গোপন ডেরায় খাবার পৌঁছে দিয়ে আসা তৃণমূল কর্মীরাই আজ সারেঙ্গার অধিকাংশ পঞ্চায়েত চালান। একই ছবি রাণীবাঁধের ঝিলিমিলি, রুদড়া, অম্বিকানগর সহ জঙ্গলঘেরা জনপদগুলিতে। এই অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ দীর্ঘদিন মাওবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিলেন। সেই আক্রোশে প্রায় প্রতিটি জায়গায় ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন তাঁরা। এই সমস্ত জায়গায় গোটা নভেম্বর মাস জুড়ে পদযাত্রা চালিয়েছেন বামপন্থীরা। বহুক্ষেত্রে চাপে পড়ে পঞ্চায়েতের তরফে কাজ দেওয়ার দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। জনরোষে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে বেশ কিছু জায়গার তৃণমূলী নেতৃত্ব বামপন্থী নেতাদের পুরোনো ‘ভুল বোঝাবুঝি’ ভুলে যাওয়ারও অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই ‘অনুরোধ’ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে বামপন্থী আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকরা। ঠেলায় পড়ে জরিমানার টাকাও ফেরানো শুরু হয়েছে।
জেলায় কাজ না পেয়ে বাঁকুড়ার কয়েক লক্ষ যুবক পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে পাড়ি দিয়েছেন ভিন রাজ্যে। কোভিড এবং লকডাউনের সময় তাঁরা নতুন করে সিপিআই(এম)’র সংস্পর্শে আসেন। সেই যোগাযোগ আরও গাঢ় হয়েছে দেড়-দুই বছরে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় তাঁরাও আবার নিজেদের কাজের জায়গায় ফিরে গিয়েছে। কিন্তু যাওয়ার আগে দিয়ে গিয়েছেন আশ্বাস- ভোটের সময় ‘কাজ’ করতে গ্রামে ফিরব আমরা। সেই ‘কাজের’ অভিঘাত অনুমান করে ইতিমধ্যেই ভয় ঢুকে গিয়েছে তৃণমূলের ভোট লুটেরাদের ভিতরে।
তৃণমূলের ভোট লুট এবার সহজ হবে না, বোঝাচ্ছেন গ্রামবাসীরাই।
Comments :0