শ্যামল কুমার মিত্র
২৫,৭৫২ জন শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের যে 'রায়' সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছে তা অবশ্যই 'রায়', কিন্তু তা 'ন্যায়' বা 'বিচার' কোনটাই নয়৷ এসএসসি কলকাতা হাইকোর্টে জানিয়েছিল, ২০১৬-র এসএসসি নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে যে ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর চাকরি হয়েছিল তার মধ্যে ওএমআরশিট কারচুপি ও র্যা ঙ্ক জাম্প করে ৪,৩২৭ জন, এসএসসি’র সুপারিশ ছাড়াই ২,৮২৩ জন, প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে ১,১৭৪ জন (সর্ব মোট ৮,৩২৪ জন) চাকরি পেয়েছিলেন৷ অর্থাৎ এই ৮,৩২৪ জন 'ঘুষ' দিয়ে বেআইনি ও দুর্নীতিমূলক উপায়ে চাকরি পেয়েছিলেন। বাকি ১৭,০০৩ জনের মধ্যেও বেআইনি ও দুর্নীতিমূলক নিয়োগ থাকতে পারে৷ কলকাতা হাইকোর্টে মাননীয় বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও মহম্মদ সব্বর রশিদির ডিভিসন বেঞ্চ এই ২৫,৭৫২ (১জনের চাকরি বহাল ছিল) জনের গোটা প্যানেল বাতিল করে দেয়। দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরিপ্রাপক ৮,৩২৪ জনকে প্রাপ্ত সমস্ত বেতন ১২% সুদ সহ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন তারা।
এই রায়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ন অংশ, "State Govt. has accepted that, there were widespread illegalities in the Selection Process and the number of persons who received appointments illegally could not be determined with exactitude. " অর্থাৎ 'with exactitude' নিয়োগ প্রাপ্তদের মধ্যে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ও যুক্ত নয়— এই পৃথক পৃথক তালিকা এসএসসি, রাজ্য সরকার, সিবিআই দিতে পারেনি বলেই আদালত গোটা প্যানেল বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। রাজ্য হাইকোর্টে রিভিউ পিটিশন করে আদালতগ্রাহ্য নির্ভুল পৃথকীকৃত তালিকা দিতে পারতেন। তাতে ১৭,০০৩ জন যোগ্য শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর চাকরি বেঁচে যেত। সুপ্রিম কোর্টে ২০ দিন শুনানি হয়েছে, সরকার সুপ্রিম কোর্টেও আদালতগ্রাহ্য নির্ভুল পৃথকীকৃত তালিকা জমা দিতে পারত, তাতে এই ১৭,০০৩ জন যোগ্য, মেধার ভিত্তিতে, দুর্নীতিমুক্ত পথে চাকরি পাওয়া শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর চাকরি বহাল থাকতেই পারতো।
কিন্তু রাজ্য সরকার ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া ৮,৩২৪ জনের চাকরি বাঁচাতে এতটাই মরিয়া ছিল, যে জেনে বুঝে গোটা প্যানেলটাই বাতিল করতে সুপ্রিম কোর্টকে বাধ্য করল। হাইকোর্টে যখন প্যানেল বাতিলের আদেশ হয়েছিল, সুপ্রিম লোর্টের রায়কে তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। হাইকোর্টের রায়ের পর রিভিউ পিটিশন করে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের 'স্বেচ্ছাকৃত ভুল' সংশোধনের সুযোগ ছিল, বর্তমানে তা এতটাই সীমিত যে, কার্যত মহামান্য রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ অথবা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সুপ্রিম কোর্ট তার রায় সংশোধন না করলে, এই সংশোধন অসম্ভব। রিভিউ পিটিশনের ক্ষেত্র অতি সীমিত, রায়ের কোনও মৌলিক পরিবর্তন করা যায় না, ছোটখাট ত্রুটি বিচ্যুতির সংশোধনই সম্ভব। কোন ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর দুর্নীতির কারণে প্যানেল বাতিল হয়নি, হয়েছে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতিমূলক হওয়ায় তা সংবিধানের ১৪ ও ১৫ নম্বর ধারা বিরোধী। সে কারনে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষায় দেওয়া রায় পরিবর্তন আদৌ সম্ভব? একই কারণে আরও একাধিক প্যানেল বাতিলের 'রায়' দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট, সে ক্ষেত্রে সেগুলি পুনর্বিবেচনার পিটিশন জমা পড়বে। মুখ্যমন্ত্রী অযোগ্যদের রক্ষা করতে যোগ্যদের বলি দিলেন।
কলকাতা হাইকোর্ট ৬,৮৬১ টি supernumerary post তৈরির রাজ্য মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত বাতিল করে রায়ে বলেছিল, "They had resolved to create supernumerary posts to accommodate the illegal appointees. In other words, State has resolved to expend tax payers' money to accord sanction an employment secured dishonestly. " নির্দেশ বলা হয়েছিল ,যারা এই কাজের জন্য দায়ী তাদের,প্রয়োজনে কাস্টডিতে নিয়ে, সিবিআই তদন্ত হবে। রাজ্যের প্রতিটি মানুষ জানেন ঘুষ দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছেন, তাদের চাকরির আইনি বৈধতা দিতে মন্ত্রীসভা অতিরিক্ত পদ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট এই নির্দেশ খারিজ করে দিয়েছেন এই যুক্তিতে, "মন্ত্রীসভা নিজে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি, এসএসসি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রাজ্যপাল অনুমোদন দিয়েছিলেন, তাই মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত অভিপ্রেত নয়।" সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ ও তাতে শিল্প স্থাপনের প্রস্তাব পূর্বতন মন্ত্রীসভার কাছে পাঠিয়েছিল শিল্প দপ্তর ও রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম, মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রাজ্যপাল এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছিলেন। তাহলে একই যুক্তিতে সুপ্রিম কোর্ট কেন সেই সিদ্ধান্ত বহাল না রেখে জমি ফেরতের নির্দেশ দিয়েছিলেন? দুটি ক্ষেত্রে সুপ্রিম অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন কেন?
গত ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, "মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী চান না ১ জনেরও চাকরি যাক। ১জনের চাকরি গেলে তার উপর নির্ভরশীল ৪/৫ জন মানুষ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন, আবার তিনি এটাও চান না, কারো ক্ষতি হোক। তাই কেউ যাতে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য প্রয়োজনে supernumerary post তৈরি করে সকলকে নিয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী"৷ কে না জানে মুখ্যমন্ত্রীর 'ইচ্ছা প্রকাশ' মানেই তাঁর আদেশ। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই এসএসসি 'তথাকথিত প্রস্তাব’ পাঠিয়ে ছিল, এ প্রস্তাব এসএসসি’র নয়, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর৷ এ কথা সুপ্রিম কোর্ট জানতেন না? মুখ্যমন্ত্রী যে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরিপ্রাপকদের চাকরি বজায় রাখতে অতিরিক্ত পদ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন— এই সত্য কেন বোঝানো গেল না সুপ্রিম কোর্টকে? একদিকে সুপ্রিম কোর্ট ১৭,০০৩ জন নিরপরাধ শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর স্থায়ী চাকরি কেড়ে নিল সরকারের অপরাধে, অন্যদিকে supernumerary post সংক্রান্ত কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ খারিজ করে এই দুর্নীতির কিং পিন মুখ্যমন্ত্রী সহ গোটা মন্ত্রীসভাকে সম্ভাব্য গ্রেপ্তারি ও তদন্তের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল৷
বলা হয়ে থাকে, "Justice must be seen to be done." এক্ষেত্রে 'Justice' দেখা গেল না৷ সুপ্রিম কোর্টের একাধিক প্রধান বিচারপতি বলেছেন, "সুপ্রিম কোর্ট শেষ কথা, কারণ সে অভ্রান্ত।" এই কথা সত্য নয়। সত্য হলো,"সুপ্রিম কোর্ট অভ্রান্ত,কারণ সে শেষ কথা।" অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টেরও 'ভুল' হয়। এ ক্ষেত্রেও হয়েছে। কারণ যে 'রায়' ১৭,০০৩ জন নিরপরাধকে শাস্তি দেয়, যে মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রী, সরকার এই নজিরবিহীন সংবিধান বিরোধী দুর্নীতি করেছে, তারা জেলের বাইরে থাকে, সে 'রায়' সঠিক, ন্যায় বিচার হতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট নিজেই নিজের রায় সংশোধন করেছেন এমন নজির আছে (সংরক্ষণ ইস্যুতে ইডব্লুউএস-দের জন্য অতিরিক্ত ১০% সংরক্ষণ)৷ সুপ্রিম কোর্ট নিজেই এই রায় সংশোধন করলেই একমাত্র এই ১৭,০০৩ জন যোগ্য শিক্ষক শিক্ষাকর্মী তাদের চাকরি ফিরে পেতে পারেন, অন্য কোনও আইনি উপায় নেই৷
গত ৭ এপ্রিলের সভায় মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি এখনও দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরিপ্রাপকদের সঙ্গে আছেন। চাকরিহারা ২৫,৭৫২ জনের "Legal Status" তারা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে "বহিরাগত"৷ তাই মুখ্যমন্ত্রীর "ভলান্টারি সার্ভিস" তাদের আদালত অবমাননার মামলায় ফাঁসিয়ে দিতেই পারে। ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে সংবাদপত্রের একাধিক সংবাদ ও প্রতিবেদন এবং একটি স্ট্রিং অপারেশনে (আজ পর্যন্ত প্রকাশিত সব তথ্য অসত্য এমন কথা তৃণমূল দল এবং সরকার বলেনি, বিনা প্রতিবাদে হজম করে নিয়েছে, কারণ তথ্য সত্য) যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে বলাই যায় ২০১২ ও ২০১৪ র 'টেট' আসলে 'প্রহসন'৷ তৃণমূল ভবনে তৃণমূল বিধায়ক ও দলীয় নেতানেত্রীদের বিধানসভা ভিত্তিক সুপারিশের তালিকা থেকে 'টেট'-এর 'তথাকথিত মেধা তালিকা' তৈরি হয়েছে, যে তালিকা থেকে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বিক্রি হয়েছে। ফলে ২০১২র 'টেট' এবং ২০১৪-র 'টেট' এর মাধ্যমে নিযুক্ত যথাক্রমে ১৮,৭৯৩ ও ৪২,০০০ (সর্বমোট ৬০,৭৯৩) জন প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরিও একই কারণে বাতিল হয়ে যেতে পারে। এই গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াই দুর্নীতিমূলক হওয়ায় সংবিধানের ১৪ ও ১৫ নম্বর ধারা অনুসারে বাতিলযোগ্য৷ ৩২,০০০ প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশে স্থগিতাদেশ আছে। এদের ভবিষ্যৎ যথেষ্ট আশঙ্কার।
উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের ৩,৯৮,১৫০ টি পদ শূন্য ছিল ২০২২ সালে, এখন তা আরও বেশি। ৬,২০০ স্কুলে ১ জন করে শিক্ষক। গত ১০ বছরে ৭,০১৮ টি স্কুল কমেছে, সম্প্রতি আরও ৮,২০৭ টি স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সরকার। ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর চাকরি যাওয়ার পর, আরও শতাধিক স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত শুধু সময়ের অপেক্ষা। এ রাজ্যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাটাই আক্ষরিক অর্থে তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নামের আগে জাল ডক্টরেট ডিগ্রি ব্যবহারের কৃতিত্ব যাঁর ঝুলিতে, তিনি যে এমন কাজই করবেন তা প্রত্যাশিতই ছিল।
শুভেন্দু অধিকারী এই দুর্নীতিতে ততটাই যুক্ত, যতটা যুক্ত মমতা বন্দোপাধ্যায়৷ সেই শুভেন্দুবাবু এখন নাকি চাকরিহারাদের পাশে! অসভ্যতা, নির্লজ্জতারও একটা সীমা থাকে। এই সব দলবদলু জীবগুলোর তাও নেই। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এই ৮,৮২৪ জন শিক্ষক ছাত্র পড়িয়েছেন, কি যে পড়িয়েছেন তা ঈশ্বর জানেন! আবার প্রাথমিকে এই ৬০,৭৯৩ জনের মধ্যে যে বিপুল সংখ্যায় অযোগ্য আছে, তারাও ছাত্র পড়াচ্ছেন। নিশ্চয় ভুলভাল পড়াচ্ছেন। বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য নয়, গোটা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা এবং বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে ধ্বংস করার কারিগর মমতা বন্দোপাধ্যায়কে 'নোবেল'দেওয়া যেতেই পারে। সবথেকে বড় কথা তৃণমূলের দুর্নীতি ২০১১-র পর সমস্ত নিয়োগকেই সন্দেহের তালিকায় তুলে দিয়েছে। মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমে চাকরিপ্রাপকদের কাছে তা বড় যন্ত্রণার, বড় অসম্মানের।
Comments :0