অনিন্দ্য হাজরা
‘‘ একটা বুথে হাজারটা ভোট। তার মধ্যে যদি ২৫-৩০টা ছাপ্পা আমরা মেরেও থাকি, তাতে কি গেল এল? সিপিআই(এম) শুধু বাজার গরমের চেষ্টা করছে।’’
দক্ষিণ দমদম পৌরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের জওহরলাল নেহরু স্কুলের গেটের উল্টোদিকে দাঁড়ানো তৃণমূলের নেতার গলায় একরাশ বিরক্তি। এবং সেই ভাব প্রকাশের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট, গত ১৩ বছর রাজ্যে গণতন্ত্রের কী হাল। একইসঙ্গে এদিন পুলিশ-তৃণমূল নিঁখুত যোগসূত্র আরও একবার পরিষ্কার হয়েছে দমদম লোকসভা কেন্দ্রেও।
ছাপ্পাকে ভোটের অবিচ্ছেদ্য অংশ ভেবে ফেলা তৃণমূলকে যদিও দৌড়ে পালাতে হয়েছে। দমদম লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে দৌড় করিয়েছেন ছাপ্পা দিতে আসা বাহিনীকে। প্রার্থীর চাপে কিছু দেরিতে হলেও পুলিশ আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। প্রথমে পুলিশ ছাপ্পার অভিযোগ মানতে চায়নি। পুলিশকে চেপে ধরেন ২৪৮ নম্বর বুথের সিপিআই(এম) এজেন্ট লিডিয়া চাকি। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁকে বুথ থেকে তুলে দেওয়ার জন্য কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করা হয়। পোাশাক খুলে নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।
এজেন্ট নিজে অভিযোগ জানালেও পুলিশ আধিকারিক প্রথমে মানতে চাননি। তারপর সমবেত সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা একযোগে চেপে ধরায় সুর বদল করেন ওই আধিকারিক।
শনিবার দমদম লোকসভা কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নির্বাচনী পটচিত্র ছিল এমনই। একদিকে তৃণমূলের চাপ। অপরদিকে দাঁতে দাঁত চেপে সিপিআই(এম) পোলিং এজেন্টদের লড়াই।
দমদম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত খড়দহ বিধানসভা। এই কেন্দ্রের বিলকান্দা-২ পঞ্চায়েতে ভোটের নামে প্রহসন হয়ে এসেছে গত ১৩ বছর ধরে। মানুষ ভোট দিতে পারেন না। এবার পেরেছেন। এবং পেরেছেন মৃত্যুঞ্জয় কুড়ির মত সিপিআই(এম) এজেন্টদের অদম্য জেদ ও সাহসের জন্য।
কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের উপর মৃত্যুঞ্জয় কুড়ির বাড়ি ও লাগোয়া দোকান। শুক্রবার রাত থেকে বাড়িতে হামলা করেছে তৃণমূল। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কাঠের টুকরো মেরে বাড়ির টিনের দরজা ফুটো করে দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়ের স্ত্রী সুমনা কুড়িকে তৃণমূলের জেলা পরিষদ সদস্য সোমা ঘোষের দল শাসিয়েছে, মৃত্যুঞ্জয় বুথে বসলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে লাশ ফেলে দেওয়া হবে।
তারপরেও শনিবার সকালে বিলকান্দার শশিভূষণ হাইস্কুলের বুথে বসেছেন মৃত্যুঞ্জয়। প্রথমে পারেননি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর সহযোগিতায় তাকে বুথে বসতে দেওয়া হয়নি। পরে প্রার্থীর হস্তক্ষেপে তিনি বুথে বসেন। শশিভূষণ হাইস্কুলের বাকি ৪টি বুথেও বসেন সিপিআই(এম) পোলিং এজেন্টরা। একই ধরণের জেদ ও সাহসের পরিচয় দিয়ে।
এই স্কুলে এবং পাশের শশিভূষণ জুনিয়র বেসিক স্কুলের বুথে দলীয় এজেন্টদের বসিয়ে যখন খড়দহ পৌর এলাকার দিকে রওনার তোড়জোড় করছে সুজন চক্রবর্তীর কনভয়, তখন বৃদ্ধ দাদুকে নিয়ে ভোট দিতে আসা এক যুবকের স্বস্তি, ‘‘এবার অন্তত নিজের ভোটটা নিজে দিতে পারব।’’
খড়দার বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে সিপিআই(এম)’র পূর্বতন খড়দা-টিটাগড় জোনাল কমিটির অফিসে পৌঁছন সুজন চক্রবর্তী। পার্টি অফিসের উল্টোদিকে মুদিখানার দোকান। দোকানির কথায়, ‘‘এবারে বামেদের প্রচার চোখে পড়েছে। সুজন চক্রবর্তীকেও সাংসদের মতোই মনে হয়। উনি জিতলে এলাকার মানুষের লাভ।’’
পার্টি অফিসের উল্টো দিকের দোকান, সিপিআই(এম) সমর্থক না হয়ে যায়? ভুল ভাঙিয়ে বিক্রেতার বক্তব্য, ‘‘আমি কিন্তু সিপিআই(এম) সমর্থক নই। ভৈরব গাঙ্গুলী কলেজে পড়ার সময় আমি টিএমসিপি করতাম।’’
লোকসভা কেন্দ্রের আরও এক চক্কর লাগিয়ে দুপুর ৩টে নাগাদ চক্রবর্তী পৌঁছন কামারহাটি পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কামারহাটি হাইস্কুলের বুথে। বুথের ২০ মিটারের মধ্যে দলবদল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় তৃণমূল নেতার ক্ষোভ, ‘‘এত সাংবাদিকের কনভয় নিয়ে ঘুরছে কেন? এখনই এমপি হয়ে গিয়েছে নাকি?’’
সেই বেআইনি ভিড়কে না সরিয়ে, প্রার্থীর সঙ্গে থাকা কামারহাটি থানার দুই সাব ইন্সপেক্টরকে দেখা যায় তৃণমূলের সেই বাহুবলীর সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠতে। এক পুলিশ অফিসার বলেই ফেলেন, ‘‘বাজার তো আপনারই। ওয়ার্ডের যেখানেই যাই, আপনার বক্তৃতা শুনতে পাই।’’
পুলিশ-বাহুবলী-শাসকদলের বোঝাপড়া থাকলে মানুষের বোঝাপড়াও স্পষ্ট। কামারহাটি হাইস্কুলের তোরণের উল্টোদিকের গলি ৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। নির্বাচনের দিনেও একতরফা লাল ঝান্ডা উড়ছে সেখানে। স্থানীয়দের বক্তব্য, ‘‘এলাকার রাজনৈতিক বিন্যাসে পরিবর্তন এসেছে। সব ভোট একতরফা তৃণমূলে পড়ছে না। আর সংখ্যালঘু এলাকায় বিজেপির ভোট টানার ক্ষমতা সীমিত। তাই লালের বাক্সের দিকেও ভালো টান আছে।’’
সেই টানের চিহ্ন গোটা দমদম লোকসভা জুড়েই খালি চোখে ধরা পড়েছে। গলি থেকে রাজপথ, উড়ছে লালঝান্ডা। কোথাও একচেটিয়া, কোথাও আবার তৃণমূলের ঢাউস সিল্কের পতাকার সঙ্গে টক্কর দিয়ে হলেও উড়েছে।
সেই সঙ্গে মনে হয়েছে, বিজেপি প্রার্থী শীলভদ্র দত্তের মতোই থেকেও নেই বিজেপির রাজনৈতিক প্রভাব। পতাকা সীমিত, দেওয়াল লিখন সীমিত, নেই চোখে পড়ার মত বুথ ক্যাম্প। সিপিআই(এম) নজরকাড়া লড়াই দিয়েছে।
কোথাও বুথ ক্যাম্পের পালটা বুথ ক্যাম্প, আবার কোথাও কল্যাণনগর মোড়ে শ’খানেক তৃণমূল কর্মীর জমায়েতকে প্রশাসনের সাহায্যে সরিয়ে দেওয়া- যেখানে যেটা প্রয়োজন, সেটাই করার চেষ্টা হয়েছে দিনভর।
এতকিছুর পরেও নির্বাচন কি ‘ফুলপ্রুফ’ হল? বিকেল পাঁচটা নাগাদ নাগেরবাজার লাগোয়া এক চায়ের ঠেকে দাঁড়িয়ে সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেল।’’
Comments :0