কেন্দ্র সরকারের বড় বড় দাবির পরেও কেন দেশের ভেতরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেল না, তার জবাবদিহি তো করতে হবে। কে দায়িত্ব নেবে এই ঘটনার? প্রশ্ন তুলেছেন সিপিআই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং কুলগামের বিধায়ক মহম্মদ ইউসুফ তারিগামি। রবিবার শ্রীনগরে একটি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাতকারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন প্রবীণ নেতা। পাশাপাশি দেশের মানুষকে কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য এগিয়ে আসার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তারিগামি বলেন, আমি এইসব বিষয়ে এখনই কিছু বলতে চাইছি না। পাকিস্তান তো আমাদের ভারত সরকারের আওতায় নয়। পাকিস্তান কখন কী করে আমরা জানি। কিন্তু এখানে কী হবে সেটা তো ভারত সরকারের হাতে। এতদিন ধরে সরকার চালাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। আগের বছরগুলি যদি ছেড়েও দিই, ২০১৯ সালের পরের থেকেই যদি ধরা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে বারে বারে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদের ইকোসিস্টেম আমরা শেষ করে ফেলেছি। বদলে দিয়েছি। একজন নাগরিক হিসেবে আমার প্রশ্ন, আপনি ঘরকে কেন সুরক্ষিত করেননি। এর জবাবদিহি তো কোথাও কারোকে করতে হবে। ঘরে যারা এসে ঢুকেছে, তারা তো বাইরের। কিন্তু তারা রাস্তা পেল কোথা থেকে? সরকারের নজরদারি কোথায় গেল? সতর্কতা কোথায় গেল? এখানে তো লাগাতার প্রচার হয়েছে, এখন শান্তির দিন আসছে। সন্ত্রাসবাদ খতম হয়ে গেছে। আমরাও মনে করেছি এত পর্যটক আসছেন, খুবই ভালো কথা। মনে করা হয়েছে শান্তি আসছে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা তো ভারত সরকারই প্রচার করেছে। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর মতো বড় বড় লোকেরাই এই কথা প্রচার করেছেন। সেই প্রচারের ফানুস তো ফুটো হয়ে গেল পহেলগামের ঘটনায়। তাহলে এর দায় তো কারোকে নিতে হবে। আত্মসমীক্ষা করতে হবে। আমি অভিযোগ তুলছি না। যা ঘটে গেছে সেটা বদলানো যাবে না। কিন্তু পর্যালোচনা তো করতে হবে। নিজেদের ঘর সামলানোর ক্ষেত্রে কি ত্রুটি ছিল না? যদি ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে শনাক্ত করা প্রয়োজন। তার ভিত্তিতে এমন বন্দোবস্ত করুন, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।
পহেলগামের ঘটনা প্রসঙ্গে তারিগামি বলেন, আতিথেয়তায় কাশ্মীরিদের একটা পরিচয় রয়েছে। সেই দিক থেকে পহেলগামের ঘটনা আমাদের জন্য বিরাট ধাক্কা। নিরস্ত্র কিছু মানুষ এখানে এলেন আমাদের ঘরে। আমরা যদি তাদের জন্য আতিথেয়তা করতেও না পারি, কিন্তু তাদের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার চিন্তা করাও ক্ষমাহীন অপরাধ। আমি মনে করি এটা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। আমাদের ছেলেমেয়েরা অন্যত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে যায়। মজুররা অন্যত্র কাজে যান। ব্যবসায়ীরা যান। আমাদের এখানের আপেল দেশের অন্যত্র বাজারে পাঠান কারবারিরা। সন্ত্রাসবাদীদের এই হামলা কি কাশ্মীরের মানুষের কোনও উপকার করবে? এটা পরিস্থিতকে খারাপই করবে। কাশ্মীরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় বাধা তৈরি করবে। কাশ্মীরিদের দুর্দশাই বৃদ্ধি করবে। কিন্তু একইভাবে সাধারণ কাশ্মীরি ছাত্র-ছাত্রী, গরিব দিনমজুর, গাড়িচালক যারা অন্যরাজ্যে গেছেন, তাদের উপর জুলুম করেও কিছু সমাধান হবে না। তাঁদের কী দোষ, প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে তারিগামি বলেন, সেই দুঃখজনক বিষয়টি আপনি তুললেন। সেই সময়ে আমিও ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি কুলগাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হই উগ্রপন্থার কারণে। কাশ্মীরি পণ্ডিতরা আসার পরে উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আমি গিয়ে জম্মুতে ছিলাম। পরে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা সেখানে আসেন। নিজের ঘর নিজেরই হয়, ছোট বাসাও নিজের। অন্যের যদি আপনি মহলও দিয়ে দেন, সেখানে সেই সুখ, স্বস্তি থাকে না। ঘর ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ আমার আছে, আমি বুঝি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অবস্থা। জম্মুতে তাঁবু, স্কুলে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সেই সময়ে রাখা হয়েছিল। তাদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত কোনও পরিস্থিতিই ছিল না। বাবার সঙ্গেই মেয়ে জামাই অন্যরা একই ঘরে। সেই সময়ে রাজ্যপালের শাসনের প্রশাসন তেমন কোনও ব্যবস্থাই করেনি। ওটা আমাদের কাশ্মীরের ইতিহাসের অত্যন্ত বেদনাদায়ক ইতিহাস। কাশ্মীরি মানুষদের এতে ভূমিকা ছিল না। তাঁরা অসহায় ছিলেন। আমার গ্রামবাসীরা যখন ইউসুফকেই রক্ষা করতে পারেনি তখন তাঁরা প্রতিবেশী কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কীভাবে বাঁচাবে? আমি যখন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম, তখন যদি আমাকে কিছু ঘণ্টার জন্য মানুষ আশ্রয় না দিতেন তাহলে হয়তো আমিও বেঁচে থাকতাম না। এখনও সেই জিনিসই হয়েছে। হামলা, হিংসার পরে আমাদের ঘরের মা-বোনারা তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, স্বান্তনা দিয়েছেন। আমি বলছি না আমরা কাশ্মীরিরা কোনও দয়া করেছি। এটা আমাদের করা দায়িত্ব। এটা আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু দেশের মিডিয়ার একটা বড় অংশ এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করছেন, যেন এখানে সবাই সন্ত্রাসবাদী বা তাদের পক্ষে। এরা আমাদের সম্পর্কে একটা খারাপ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে চায়। আমাদের ইতিহাসের ওই ঘটনায় একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল আমাদের সম্পর্কে। সরকার এবং অন্যরা সেটাকে কাটানোর বদলে পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। সংবাদ মাধ্যমের একাংশ মানুষের দুর্দশাকে নিয়ে বাজার করছে। কাশ্মীরি পণ্ডিতরা এখান থেকে চলে যাওয়ায় আমরা এখনও অসম্পূর্ণ মনে করি। আমরা অর্থাৎ কাশ্মীরি সমাজ, ব্যাখ্যা করেন তারিগামি। তিনি বলেন, আমি আশাবাদী একদিন কাশ্মীরি পণ্ডিতরা আবার ফিরবেন। আমরা একসঙ্গে থাকব। আবারও গান, ভজন হবে। মন্দির-মসজিদে এক সঙ্গে উপাসনা হবে। আমি তো ঘৃণার পুজারী হতে পারবো না। তাতে যদি আমাকে একলা হতে হয়, মরেও যেতে হয়, আমি আলোর খোঁজ চালিয়ে যাব।
তারিগামি জোরের সঙ্গে বলেন, ভারত সরকারের এবং দেশের মানুষদের উচিত কাশ্মীরের জনগণকে আপন করে নেওয়ার। দূরত্ব আছে, অবিশ্বাস আছে। দুঃখ আছে এদিকে এবং ওদিকেও। দূরত্ব কাটাতে পদক্ষেপ করতে হবে। ভরসা তৈরি করতে হবে। নাহলে দেশের শত্রুদেরই ফায়দা হবে। ভারত সরকার এই দায়িত্ব পালনের জন্য সমস্ত সম্ভাব্য চেষ্টা করেছে, এই কথা বলা যায় না। তিনি দেশের মানুষের কাছে আবেদন করে বলেছেন, এক সঙ্গে মিলে কাশ্মীরকেও সামলাতে হবে, দেশকেও সামলাতে হবে। কাশ্মীরের মানুষ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবে। আপনারা কাশ্মীরে আসুন। কাশ্মীরে সাড়ে তিন দশকে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কখনও এইভাবে গ্রাম-পাহাড়, শহর থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় এমন ধর্মঘট হয়নি। প্রথমবার এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ হয়েছে। এটাই কাশ্মীরের মানুষের বার্তা দেশের মানুষের কাছে।
Pahalgam Attack
"নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি কেন, সেই জবাবদিহি কেন্দ্রকে করতে হবে।" সাক্ষাতকারে বললেন তারিগামি

×
Comments :0