বনবাণী ভট্টাচার্য
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে।
গত ৯ এপ্রিল, সমাজ দেখেছে সেই বিদ্বানদের অভূতপূর্ব পূজা। (ভাইরাল ভিডিওতে হয়তো গোটা পৃথিবীই নয়ন সার্থক করেছে এরাজ্যের বিদ্বানদের এরকম ‘রাজকীয় সমাদরে।’) চাণক্য পণ্ডিতের সমাজ-মূল্যায়নের এমনন নির্মম পরিহাস বোধহয় আর কখনও হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেছে যে, বিদ্বান যাঁরা, তাঁরা তাঁদের অর্জন, তাঁদের জ্ঞান কৃপণের সম্পদের মতো সিন্দুকে ভরে রাখেননি। তাঁরা বিদ্যা চর্চা করেছেন শিক্ষা দান করে, তৈরি করেছেন বিখ্যাত শিষ্য, বিশিষ্ট পণ্ডিত ছাত্রদের। আর এভাবেই আলো ছড়িয়েছেন সমাজে। সমাজের প্রয়োজন, সেদিনও আজও, শুধু বিদ্বান — জ্ঞানীদের নয়, প্রয়োজন শিক্ষকের। প্রাচীন ভারতে ঋষি উদ্দালক, পুত্র শ্বেতকেতুকে, নিজে বিদ্বান হওয়া সত্ত্বেও, তার শিক্ষার জন্যে গুরুগৃহে পাঠিয়েছিলেন কারণ তিনি বিদ্বান কিন্তু শিক্ষক নন। আজও পর্যন্ত, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে মান্যতা পান গ্রীসের জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ সক্রেটিস।
নদীয়ার বুনো রামনাথ, বাংলার গৌরব। তাঁর দারিদ্র্য ছিল সীমাহীন। তিনিও তাঁর স্ত্রী তেঁতুলপাতার ঝোল ভাত খেয়ে দিন কাটাতেন। তাঁর ছিল দারিদ্র্যের অহঙ্কার-প্রত্যাখ্যান করেছেন রাজার অনুগ্রহে। শোনা যায়, রাজমনীষীর স্নানের সময়ে, এক হতদরিদ্র প্রায় সামান্য কাপড় পরা মহিলার হাতের জল তার গায়ে পড়লে, তিনি প্রচণ্ড রাগে সেই মহিলার আস্পর্ধায় বিষ্মিত হয়ে তাতর কব্জিতে বাঁধা লাল সুতো দেখিয়ে বলেছিলেন — ঐ সুতোটুকু ছিঁড়ে ফেলতে কতক্ষণ, তবু কি স্পর্ধা। শাঁখা-পলাহীন সেই মহিলা উত্তর দিয়েছিলেন রানীর চোখে চোখ রেখেই — ‘‘এই লাল সুতো যেদিন ছিঁড়ে যাবে, সেদিন নবদ্বীপ অন্ধকার হয়ে যাবে। সেই দরিদ্র মহিলাই ছিলেন বুনোরামনাথের স্ত্রী — যিনি তাঁর স্বামীকে তাঁর বিদ্যা ও শিক্ষা দানের কারণে উজ্জ্বল আলোক শিখার সাথে তুলনা করেছিলেন।
শিক্ষিত-বিদ্বানেরা সমাজে মাথা উঁচু করে চলা মানুষ — বাকিরা তাঁদের পায়ে নত মাথা, সুস্থ দেশকালের এটাই দস্তুর। সেদিন সকলে দেখেছে, সমাজ যাদের চিরকাল মাথায় করে রাখে, মমতা সরকার তাদেরই লাথি মেরে পায়ের তলায় রাখার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যে রাজ্যের পুলিশকে, একটা কলেজ ইউনিয়নের সুষ্ঠু ইলেকশন করার পাহারাদারিতে ল্যাজে গোবরে হয়ে গুন্ডাদের গুলিতে বিদ্ধ হওয়া সহকর্মীকে হারাতে হয়, শাসকদলের দাপটে টেবিলের তলায় ফাইল চাপা দিয়ে নিজেকে বাঁচায়, শাসকের পোষিত দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব-ভাঙচুরের সময়ে, হয় উদাসীন দর্শক, নয় রোগীর কম্বলের তলায় ঢুকে আত্মরক্ষা করে কাপুরুষের মতো, সেই পুলিশ কোন টনিকে রাজ্যের চাকরিহারা মাস্টারমশাইদের উপর বীরত্ব ফলাতে গেল?
হ্যাঁ, অস্ত্রহীন নিরীহ চাকরিহারা শিক্ষকরা গিয়েছিলেন শিক্ষা-কর্মকর্তা ডিআই’র কাছে তাদের বক্তব্য জানাতে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। চাকরিহারারা তো শিক্ষিত-বুদ্ধিমান মানুষ— ওঁরা জানেন হাজার হাজার প্রতিবাদীর উপস্থিতিতে একটা ঘরে আলোচনা হয় না। সবাই অফিসে ঢুকে পড়তেন না অবশ্যই। স্লোগান, জমায়েত, প্ল্যাকার্ড, অবস্থান-আন্দোলনের অঙ্গ। তৃণমূল নেত্রী দাবি করেন, তাকে যেন কেউ আন্দোলন না শেখান, আন্দোলনে তাঁর জন্ম, তবে তিনি শেখাননি তার পুলিশকে জনতার মেজাজ বুঝতে, চেনাননি জঙ্গী আন্দোলনের লক্ষণ? বঞ্চিত-অপমানিত এই শিক্ষকদের মেজাজ কি সেদিন আর জি করের ভাঙচুর করা দুষ্কৃতীদের মতো ছিল? সরকারের কে কে যেন আবার গন্ধ শুঁকে আতঙ্কিত হয়েছেন, ওঁরা হয়তো ফাইলপত্র তচনচ করতেন, তাহলে কি হতো? হাস্যকর ব্যাপার— যে সরকারের শিক্ষা দপ্তর চাকরীর পরীক্ষার ওএমআর সিট দাখিল করতে পারে না, দুর্নীতি করে টাকা খেয়ে প্রমাণ লোপাট করতে, হয় চুরি করেছে, নয় পুড়িয়ে ফেলেছে, তাদের মুখে ফাইলের সুরক্ষার কথা আদৌ মানায়? মুখ্যমন্ত্রীর স্তাবকেরা প্রশ্ন করছেন, নিন্দা করছেন, মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেছেন, তিনি দেখছেন, তাহলে কেন এই ডিআই অফিস অভিযান? আসলে দেরিতে হলেও মানুষ বুঝেছে, মুখ্যমন্ত্রীর এই সরকার ‘‘দুর্নীতিগ্রস্ত— ভ্রষ্টাচারী, ভণ্ডামিতে এক নম্বরী’’। না হলে চাকরি প্রার্থীরা, টেট পরীক্ষার্থীরা কেন রাস্তায় রাস্তায়? কতবার তো তার প্রতিনিধিরা তার হয়ে উচ্চারণ করেন ‘দেখছি’। মানুষকে ভুলিয়ে রাখা, ঠকানো যার কৌশল, তার উপর কে আস্থা রাখতে পারে? কোনও দৃষ্টান্ত আছে প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখার, বিশ্বাস করার?
৭ এপ্রিল নেতাজী ইন্ডোরে মুখ্যমন্ত্রী যোগ্য চাকরিহারাদের ডেকে তার বক্তব্য রাখেন যার নির্যাস, তিনি আগে যোগ্যদের ব্যবস্থা করবেন, পরে অযোগ্যদের জন্যেও— অর্থাৎ তাদের বিক্রি করা চাকরি, যারা ঘটিবাটি বিক্রি করা টাকায় কিনেছে তাদের জন্যে। অনুগতরা বিগলিত, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং উপস্থিত হওয়ার সাহস ও বিচক্ষণতায়, ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে, জ্যোতি বসু কত নির্দয়-নিষ্ঠুর, তার খতিয়ান জনমানসে পৌঁছে দিতে ব্যস্ত।
প্রথমত জ্যোতি বসুর একটা আস্ত মন্ত্রীসভা ছিল, যেখানে শুধু পদ নয়, পদাধিকারীরা সবাই মগজ বন্ধক দেওয়া না, মুক্ত মগজের সত্যিকারের মন্ত্রী ছিলেন একজন মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে। তাই তখনকার মুখ্যমন্ত্রীকে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ, মানে সুলভ শৌচালয় উদ্বোধন থেকে নিজের পরিবার ও ঘনিষ্ঠ নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতির কারণে শাস্তি রেহাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাথে একান্তে সাক্ষাতে ছুটে যেতে হতো না। (২) যদি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু নিজে উপস্থিত থাকবেন বলে কোনও সভা বা ডেপুটেশন নেবেন বলে স্থির করে থাকেন, তবে পৃথিবী উলটে গেলেও তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তবে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরের কোনও নিয়োগ নিয়ে কোনও অনিয়ম হয়নি বলে, তৃণমূল নেত্রী কোনও আন্দোলন করার সুযোগই পায়নি। অবশ্যই সেটা একটা আফশোসের বিষয় বামবিরোধীদের কাছে। এমনকি রাজত্বের প্রথমদিকে, মাননীয়া যেমন সভামঞ্চে ফাইলের পাহাড় নিয়ে বাম আমলের আবাসন দপ্তরের কেলেঙ্কারি প্রায় ধরে ফেলেছেন বলে চিৎকার করেছেন, কোনও স্তরের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ নিয়ে এরকম একটা ‘শো’ পর্যন্ত করতে পারেননি। হ্যাঁ, সরকারের কোনও পলিসি, কোনও প্রকল্প সব অংশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, তা নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন মানুষ করতেই পারেন, কারণ সেটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। সুদীর্ঘকাল শিক্ষক সমাজ এই বাংলায় তাঁরা তাঁদের শিক্ষাদান করেছেন, মানুষ গড়েছেন, সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন পেটে গামছা বেঁধে অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে— তাদের কর্তব্য পালনের মর্যাদা দেয়নি সমাজ। ১৯৬৭ সালে একজন প্রধান শিক্ষকও হয়তো তাঁর সর্বোচ্চ আয় মাত্র ৫০০ টাকা নিয়ে অবসর গ্রহণ করেছেন। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষাগুরুদের সেই আর্থিক ও সামাজিক অসম্মান থেকে উদ্ধার করে, মোটামুটি সাদাসিধে জীবন ও সংসার যাপনের মাইনের ব্যবস্থা করে। আর সেই নিশ্চয়তা সৃষ্টি করার জন্য ৬০/৬৫ বছরের অবসরের অবতারণা। যারা বলছেন, এক কলমের খোঁচায়, একদিনে ৭৩ হাজার শিক্ষকের চাকরি খেয়েছে বাম সরকার— হয় তারা অজ্ঞতা থেকে, নয় ইচ্ছে করে ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। সেদিনকার বাংলার মানুষ একটা ইংরেজি শব্দ ‘অপশন’ (Option) এর সাথে খুব পরিচিত ছিলেন। সরকার বলেছিল ৬০ বছরে অবসর নিতে চাইলে নতুন বর্ধিত স্কেল আর ৬৫ বছর পর্যন্ত পড়াতে চাইলে পুরানো স্কেলে থাকতে হবে— শিক্ষকের স্বাধীনতা তার পছন্দ বেছে নেওয়ার। বন্ধু সরকার চেয়েছিল ৬৫ বছরের জন্যে ম্যানেজিং কমিটির অনুগ্রহ প্রার্থী হয়ে, যে কমিটির সম্পাদক-সভাপতিরা, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, হতেন নিরক্ষর অশিক্ষিত জোতদার জমিদারের মতো ক্ষমতাবানরা তাদের অনুমোদন সাপেক্ষে মাস্টারমশাইদের রুজি-রোজগারের সংস্থান করার মতো অসম্মানের হাত থেকে রক্ষা করা। সরকার একদিন-দু’দিন নয় দীর্ঘ সময় দিয়েছে অপশন ফরম জমা দেবার শেষ দিন জানিয়ে। ডেডলাইন তো একদিনই হয়— আর সেই তারিখ পার হলে, তখন তো একদিনেই যা হবার তা হয়ে যায়। ফলে আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডোবা সরকারের অন্যায়ের ফলে ২৫ হাজার ৭৫২জন শিক্ষক হারিয়ে ফেললেন তাদের চাকরি। বাম আমলে রাজ্য শাসন করত নিয়ম-আইন-নৈতিকতা-স্বচ্ছতা-সততা নিয়ে, তৃণমূলের রাজত্বে বেনিয়মই নিয়ম, নীতিহীনতাই নীতি, স্বচ্ছতার প্রশ্ন নেই, অতএব সব কিছুই ধামাচাপা। তাই, তৃণমূলের জমানায় দেখা দিল দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকতায় নতুন এক ‘তন্ত্র’, দুর্নীতিতন্ত্র, আর চলছে তারই শাসন। সমাজে যারা শীর্ষ-সম্মানীয়, বামফ্রন্ট সেই শিক্ষক সমাজকে মর্যাদার সাথে মাথায় তুলে রেখেছিল, মমতা সরকার তাদের লাথি মেরে ধুলায় ফেলে দিয়েছে। পুরাণ থেকে জানা যায়, বামন অবতার বলী রাজার মাথায় পা রেখে তাকে পাতালে পাঠিয়েছিল, (কলিকালে ?) পুলিশ অবতার কি চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের সাথে সাথে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই পাতালে পাঠালো ? পুলিশের ঐ পদাঘাতের যন্ত্রণা শুধু ব্যক্তি-শিক্ষকের নয়, ঐ আঘাত, ঐ ব্যথা, আগত-অনাগত গোটা শিক্ষক সমাজের বুকে লেগেছে— ঐ পদাঘাত শিক্ষাকে সর্বনাশের অতল তলে পাঠাবারও ঘৃণিত পদক্ষেপ।
লাথিমারা ঐ পুলিশ, সংবাদে প্রকাশ যে, তার বন্ধুবান্ধব ও পরিজনদের নিন্দাবাদ শুনেছেন। বাবা বলেছেন প্ররোচনার কথা, বলেছেন পুলিশের চাকরিতে তার অপছন্দের কথা। কিন্তু তিনি কি একবারও ক্ষমা চেয়েছেন, দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তার কৃতকর্মের জন্যে ? কোথায় শিক্ষা, কোথায় মনুষ্যত্ব ? কি করে তা অর্জন হবে ? মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন তো, রাজ্যের আচার্যদের অসম্মানে ক্ষমা চেয়েছেন কি, অন্তত দুঃখ প্রকাশ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী করেছেন কি? অথচ, এরা সকলেই জানেন শিক্ষকই জাতির মেরুদণ্ড, স্কুলজীবনে কখনও না কখনও এ নিয়ে কত শ্রদ্ধা-সম্মানের কথা লিখেছেন তাঁদের রচনায়। কিন্তু পুলিশের লাঠি-লাথি খেয়ে সর্বস্তরের শিক্ষকের সম্মান যখন ভূলুণ্ঠিত, তখন ক্ষমা চেয়ে তারা মনুষ্যত্বের পতাকা তুলে ধরতে পারলেন না তো?
পেরেছিলেন কি একটু সংবেদনশীলতা দেখাতে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তার গাড়িতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রটির চাপা পড়ার পর, গাড়ি থামিয়ে ছেলেটির খোঁজ নিতে ২ মিনিট সময়ের জন্যে, যা যে কোনো সাধারণ মানুষ করে থাকেন, যদি তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে গাড়ি চাপা না দিয়েও থাকেন? শিক্ষিত বিদগ্ধ অধ্যাপক ব্যক্তি, তিনি বিদ্যাসাগরের ছাত্র দরদ এবং সামগ্রিকভাবে মানবদরদি মনের কথা তো জানেনই, জানেন, এ দেশে, বিদেশি ইংরেজ ডেভিড হেয়ার সাহেবের ছাত্র দরদের কথা, যিনি নবজাগরণের যুগের হিন্দু কলেজের ছাত্র, কলেরায় আক্রান্ত রামতনু লাহিড়ীর শরীরের অবস্থার কোনো খবর, একদিন সন্ধ্যে পর্যন্ত জানতে না পেয়ে রাত্রে একা একা লালদিঘি থেকে হিন্দু কলেজ চত্বরে তার বাসস্থানে হেঁটে উপস্থিত হয়েছিলেন। আরো জানেন নিশ্চয়ই এখনকার পার্কস্ট্রিট অঞ্চল থেকে একদিন মুষলধারে বৃষ্টি থামলে তিনি গোরাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, তার ছাত্র চন্দ্রকান্ত দেবকে কলেজ স্কোয়ারের গোলদিঘি পর্যন্ত পায়ে হেঁটে পৌঁছে দেবার পরেও, তার পটুয়াটোলা লেনের বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে জিজ্ঞাস করেছেন—‘‘ ’’ চন্দ্র বাড়ি পৌঁছেছে?
‘’ কবি টি এস ইলিয়ট তাঁর নিজস্ব জীবনবোধ এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত সমকালীন পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে যা লিখেছিলেন, তা কি নির্মম সত্য হয়ে দাঁড়ালো এই কর্মচ্যুত শিক্ষকদের জীবনে গত ৩রা এপ্রিলের পর থেকে। শুধু একটা ক্ষমতা সর্বস্ব-অমানবিক দুর্নীতিবাজ সরকারের লোভ ও স্বার্থপরতায়। এক লহমায় যাদের সংসার থেকে স্বপ্ন, সব চুরমার হলো, মানহারা হলো তাদের প্রতি এতটুকু সহমর্মিতা থাকলে এখনও এই সরকার মিথ্যাচার-মিথ্যা আশ্বাস ও ছলনা করত না। এই প্রতারণা এবং লাঞ্ছনা ঐ চাকরি হারানোদের যন্ত্রণাকে যে আরো তীব্র করে, সেই সংবেদনশীলতাটুকুও নেই।
দশ কোটি মানুষের একটা সরকারের প্রধান অনায়াসে নির্লজ্জভাবে যে কোনো আর্থিক দুর্নীতি, অপ্রীতিকর ঘটনার বিষয়ে বলে দিতে পারেন যে তিনি জানেন না, জানতেন না, চেনেন না ইত্যাদি, সে সারদা-নারদা থেকে আর জি কর হাসপাতাল ও কলেজের অধ্যক্ষ সহ স্বাস্থ্য দপ্তরের ঘৃণ্য দুর্নীতি তক। কিন্তু তিনি জানেন না কেন? নবান্নের চোদ্দতলা থেকে গঙ্গার শোভা দেখার জন্যে তো জনগণ তাঁকে পাঠায়নি। হয় তিনি সব বুঝতে অক্ষম, নয় তিনি অন্যায় ও দুর্নীতির সহায় শুধু নয়, উৎস। এসএসসি অটোনমাস বডি ঠিক। কিন্তু সরকার না চাইলে, না অনুমোদন করলে এসএসসি গঠন ও তার কাজ চলে? সরকারের সম্পূর্ণ এক্তিয়ারের বাইরে? সত্যিই ধরা-ছোঁয়া যায় না কি? বিশ্বাসযোগ্য? তার অনুপ্রেরণা ছাড়া গাছের পাতা নড়তে পারে? উনি নাকি যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করতে পারতেন সুযোগ পেলে। সুযোগ তো পেয়েছেন মাসের পর মাস, করেননি কেন? এসএসসি পারব না বলে, দেয়নি কেন? সব কিছু তারই মুঠোয় তো—বিধানসভায় ১২ বার এসএসসি’র নিয়োগে চাকরি বিক্রি হয়েছে, প্রশাসনিক দুর্নীতি হয়েছে, এ নিয়ে আলোচনা হয়, প্রধান প্রশাসক কি কান বন্ধ করে ছিলেন? আবার ২০বার আদালতের শুনানি হয়েছে, বাদানুবাদ হয়েছে, সরকারি আইনজীবীর হাতে সমস্ত তথ্য প্রমাণ আছে, তিনি তা স্টাডি করেননি কেন? কি করে এসএসসি স্বীকার করল ৬২৭৬ জনের বে আইনি নিয়োগ হয়েছে? সরকারকে জবাব দিতে হবে, এসএসসি সঠিক বা বেঠিক বলে। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী অন্যান্য আধিকারিকদের টাকার পাহাড়গুলি কি অলীক— মায়ামাত্র ? তা যদি না হয়, তবে চাকরি বিক্রি করেছে মন্ত্রী থেকে শুরু করে তাদের আত্মীয়-বন্ধু এবং সরকার-ঘনিষ্ঠরা। আর এই যোগ্য-অযোগ্য বাছাই হলে, চাকরি খোয়া যাওয়া অযোগ্যরা যারা টাকা দিয়ে ঠকে গেল, তারা কি সেই টাকা খাওয়া প্রতারকদের রেহাই দেবে, গায়ের চামড়া ছিঁড়ে নেবে না? তাতে কি মন্ত্রী-এমএলএ, সাংসদ মন্ত্রীর পরিবার, শাসকদলের ছোট-বড় নেতারা বাদ যাবে ? তাই মুখ্যমন্ত্রী তাদের বরাভয় দেখান, দেখাতে বাধ্য হন যে তিনি তাদের জন্যেই আছেন—না হলে কার মুণ্ডু কোথায় গড়াবে কে জানে? তাই, অপরাধীদের ঢাল হয়েছেন তিনি।
সরকারকে অপরাধ স্বীকার করতেই হবে যে সরকারের জন্যেই, তাদের অপরাধের জন্যেই দণ্ড পেতে হচ্ছে ২৬ হাজার শিক্ষককে। অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি যেমন, তেমনি যোগ্যদের দ্রুত স্কুলে ফেরার জন্যে আবেদন জানাতে হবে আইনসম্মত রিভিউ পিটিশন করে আদালতে। সরকারের দুর্নীতিতে শিক্ষার সর্বনাশ হচ্ছে—সরকারের নির্দেশেই শিক্ষক সমাজ অপমানিত-শরীরে মনে আহত। উপরতলার বিনা নির্দেশে শিক্ষক নিগ্রহ সম্ভব ? হয়নি তো ১৯৫৪, ১৯৬৬ সালের শিক্ষক আন্দোলনে ?
এমন নয়, দুর্নীতি এই সরকারই প্রথম করেছে, অন্যান্য দেশে অভিযুক্ত মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন দায় মাথায় নিয়ে। বৃটেনে হয়েছে, আমেরিকায় ঘটেছে। ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এ রাজ্যের মন্ত্রী নেতারা আসফালন করেন বুক ফুলিয়ে, অন্যায়ভাবে শাস্তি প্রাপ্তদের জন্যে একটু দুঃখ প্রকাশও নেই। মুখ্যমন্ত্রীর এখনও মিথ্যাচার ও স্তোক বাক্য চলছে। খৃষ্ট-বিশ্বাসীরা মানেন, পাপ করে অনুতাপ করলে ঈশ্বর ক্ষমা করেন। এই সরকারের অনুতাপ নেই, লজ্জাও নেই। শিক্ষকদের এই প্রতিবাদী আন্দোলন সকলের যুদ্ধে পরিণত হয়ে এমন উত্তাল হয়ে উঠবে, যে সিংহাসন যত উপরেই থাকুক, তা ভেসে যাবেই।
Comments :0