Egra blast

তৃণমূল নেতার বোমা কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত ১০

রাজ্য

রামশংকর চক্রবর্তী ও কিশোর নাগ: এগরা

পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বারুদের স্তূপে বাংলা। মঙ্গলবার দুপুরে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় এক তৃণমূল নেতার বোমা তৈরির কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ গেল অন্তত ১০জনের। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১৪জন। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে দগ্ধ দেহ দূরে দূরে ছিটকে পড়েছে। এমনকি পাশের পুকুর থেকেও দগ্ধ দেহ ও দেহাংশ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি, পুলিশ ও তৃণমূল নেতারা মৃত্যুর সংখ্যা ধামাচাপা দিচ্ছে। গ্রামে ঢোকার পরেই পুলিশের আইসি’কে পিটিয়ে জামা ছিঁড়ে দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পুলিশের এই আইসি’র প্রত্যক্ষ মদতেই এই কারখানা চলছিল। 
 পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মরিয়া তৃণমূল রাজ্যে বোমা তৈরি ও মজুত করছে এই অভিযোগ ছিলই। একের পর বিস্ফোরণের ঘটনায় এমনকি নিরীহ সাধারণ মানুষ, বোমাকে বল ভেবে খেলতে গিয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনা সেই আশঙ্কাকেই জোরালো করছিল। কিন্তু মঙ্গলবার এগরায় যা ঘটেছে তা রাজ্যে বিস্ফোরণের সব নজিরকে ভেঙে দিয়েছে। পুলিশ এবং মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাকে চাপা দিতে ‘বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ’ বলে চালাতে চেষ্টা করেছেন, দেশজুড়ে ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাওয়ার পাঁচ ঘণ্টা পরেও নবান্নে বসে মুখ্যমন্ত্রী নিহতের সংখ্যা অর্ধেক করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ঘটনাস্থলে যে ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে তা যে কোনও মানুষকে আতঙ্কিত করে দেওয়ার মতো। নিহত দশজনের মধ্যে দুইজনের দেহ পুড়ে কয়লা হয়ে এমন অবস্থায় পাওয়া গেছে যে রাত পর্যন্ত তাঁদের শনাক্তই করা যায়নি। গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, কমপক্ষে পনেরো জনের মৃত্যু হয়েছে, কিছু মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
  পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা ১ নম্বর ব্লকের সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েতের খাদিকুল গ্রামের তৃণমূল নেতা কৃষ্ণপদ বাগ যিনি ভানু বাগ নামেই কুখ্যাত, তাঁরই বোমা কারখানায় এই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, ভানু বাগের এই বোমা কারখানাটির জায়গা তাঁর নিজের নয়। মোট ১ বিঘা ৫ কাঠা জায়গাটি স্থানীয় এক বর্গাদার দয়ানিধি মাইতির কাছ থেকে জোর করে দখল করে নিয়ে ভানু বাগ একটি বাড়ি ও বাড়ি লাগোয়া কারখানাটি তৈরি করে। ২৫ জন কর্মী কাজ করতেন এখানে। এদিন ৩ জন কাজে আসেননি। ২২ জন কর্মী কাজ করছিলেন। বিস্ফোরণের সময় ভানু বাগ নিজেও ছিলেন ঘটনাস্থলে। তবে আহত অবস্থায় তিনি পলাতক বলে জানা গেছে। 
বিস্ফোরণের খবর পেয়ে এদিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় পোড়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাড়িটি। তখনও পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। চারিদিক পোড়া গন্ধে ভরে গেছে। বাড়ির পাশে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে আছে আধপোড়া একাধিক মৃতদেহ। বোমা কারখানার পাশে থাকা পুকুরের মধ্যেও কিছু দেহ ভাসতে দেখা যায়। দেহগুলি আগুনে সম্পূর্ণ ঝলসে গিয়েছে। মৃত ও আহতদের প্রত্যেকেরই বাড়ি এই খাদিকুল গ্রামে। ভয়াবহ বিস্ফোরণে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন মহিলা। রাত পর্যন্ত নিহতদের আটজনের পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন অম্বিকা মাইতি (স্বামী সুরেশ), শক্তিপদ বাগ (পিতা জয়ন্ত বাগ), কবিতা বাগ (স্বামী উমাপদ বাগ), মাধবী বাগ (স্বামী সঞ্জিত বাগ), জয়ন্ত জানা (পিতা ভৈরব জানা), বাপন মাইতি (পিতা গৌরহরি মাইতি), মিনতি মাইতি (পিতা শীতল) ও শ্যামাশ্রী মাইতি (স্বামী রবীন্দ্র মাইতি)।
  খাগড়াগড়ে তৃণমূল নেতার বাড়িতে আইইডি বিস্ফোরণের পরে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে দুর্ঘটনা বলে তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা হয়েছিল জেলা পুলিশের তরফে। এদিন এগরার ঘটনার পরেই পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অমরনাথ কে জানান, ‘ওডিশা সীমানা থেকে কিছুটা দূরে একটা বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়েছে। সেখানে বাজি তৈরি হচ্ছিল। বিস্ফোরণের জেরে এখনও পর্যন্ত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর জখম হয়েছেন বেশ কয়েকজন, তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ আর এগরার তৃণমূল বিধায়ক তরুণ মাইতি বলেন, ‘ওখানে বাজি কারখানা ছিল বলেই খবর পেয়েছি। পুলিশ আগেই তল্লাশি করে বন্ধ করেছিল। তারপরও হয়তো গোপনে লুকিয়ে চলছিল। কতজন মারা গিয়েছেন এখন বলতে পারব না।’ আর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে বসে বলে দিয়েছেন, বাজি কারখানায় দুর্ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
   কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের জানালেন, বেলা ১১টা নাগাদ আচমকাই বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে খাদিকুল গ্রাম। বিস্ফোরণের তীব্রতায় প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা কেঁপে উঠেছিল বলে এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন। সবাই ছুটে এসে দেখেন, বিস্ফোরণে গোটা বাড়িটিই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাঁরাই উদ্ধারকাজে হাত লাগান, পরে পুলিশ এবং দমকল এলে তাঁদের ক্ষোভের মুখে পড়ে পুলিশ। গ্রামবাসীরা ঘিরে ধরে মারতে থাকেন পুলিশ কর্মীদের, এমনকি এগরা থানার আইসি’কে প্রকাশ্যে পিটিয়ে উর্দি ছিঁড়ে দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তাঁরা বলেছেন, ‘ভানু বাগের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নিত এই পুলিশ।’ 
 মানুষের ক্ষোভের কারণ স্পষ্ট। পুলিশের প্রত্যক্ষ মদতে তৃণমূল নেতার বোমার কারখানা চলছিল বলে তাঁদের অভিযোগ। ভানু বাগ কোনও অজানা অচেনা ব্যক্তি নন, তিনি যে তৃণমূলের দাপুটে নেতা সেটা এলাকার মানুষ একবাক্যে বলছেন। গ্রামবাসীরাই জানালেন, বাড়িতে থাকলেও ভানু বাগের মৃত্যু হয়নি। তিনি আহত হয়েছেন। বিস্ফোরণের পরেই একটি গাড়িতে করে ভানু বাগকে কয়েকজন তুলে নিয়ে চলে যায়, তাঁকে ওডিশার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। 
তবে কি আসল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই ভানু বাগকে পালাতে দেওয়া হলো? প্রশ্ন উঠছে আরও অনেক। কারণ, বোমা কারখানার মালিক ভানু বাগের বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক মামলা রয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্দল সদস্য ছিলেন ভানু বাগ। ২০১৩ সালে ভানু বাগ তৃণমূলের বুথ সভাপতি হন। গোটা এলাকায় তিনি সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। বিশেষত ২০১৩ এবং ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এবং ২০২১ সালের বিধানসভা বিধানসভা নির্বাচনে ভানু বাগের বাহিনী বোমা বন্দুক নিয়ে ভোট লুট করেছে, বিরোধীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ ছিল এই ভানু বাগের। বেআইনি কারখানা চালানোর অভিযোগে পুলিশ একবার গ্রেপ্তার করে ভানু বাগকে। কিন্তু সত্যিই কি সে পুলিশের জালে ছিল নাকি স্রেফ খাতায় কলমে গ্রেপ্তারি দেখানো হয়েছিল শাসকদলের সম্পদকে? গ্রামবাসীরা বলছেন, ভানু বাগ বরাবর অবাধে এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, পুলিশ তাকে কোনও বাধাই দেয়নি। তাঁর দাপটেই সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৪ সদস্যের মধ্যে ১০ জনই তৃণমূলের। গোটা এলাকায় সন্ত্রাস চলে তৃণমূলের।
  বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনা পূর্ব মেদিনীপুরে এটাই প্রথম নয়। গত বছর একইভাবে ভগবানপুর ২ নম্বর ব্লকের ভূপতিনগর থানার অর্জুননগর গ্রাম পঞ্চায়েতের নাড়ুয়বিলা গ্রামে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সেই ঘটনায় মৃত্যু হয় এক তৃণমূল নেতা সহ তিন জনের। তার আগে খেজুরির পশ্চিম ভাঙনমারি গ্রামে এক তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হয়। সেখানেও বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। সেই ঘটনায় এনআইএ তদন্তে নেমে তৃণমূল নেতা সহ একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এছাড়াও পাঁশকুড়ার তৃণমূল কর্মীর বাড়িতেও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় তিন জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। সম্প্রতি গত ২৫ এপ্রিল পুন্দা গ্রামে তৃণমূল নেতা নারায়ণ জানার বাড়িতেও বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে এক মহিলা ও তাঁর ছেলের। এভাবেই বারুদের স্তূপ জমা হতে হতে বাড়ছে, তারই ভয়ানক পরিণতি দেখা গেল এগরাতে।
  এদিন বিস্ফোরণের খবর পেয়েই স্থানীয় সিপিআই(এম) নেতা সমীর সামন্ত, তপন প্রধান, অমিয় রঞ্জন দাস সহ পার্টি নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে গিয়ে পার্টি কর্মীদের নিয়ে উদ্ধার কাজে হাত লাগান এবং আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে সাহায্য করেন। আহতদের ভর্তি করা হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে।

Comments :0

Login to leave a comment