পার্থপ্রতিম কোঙার- বর্ধমান
বর্ধমান ষ্টেশনে জলের ট্যাঙ্ক ভেঙে ৩ যাত্রীর মৃত্য হয় বুধবার। আহত হয়েছে ৪০ জন। তাদের মধ্যে ৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক খবর বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে। এই দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছেন রেল মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। দুর্ঘটনায় আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে এবং নিহতদের ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবার ঘোষণা করেছেন তিনি। দুর্ঘটনার তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। জানানো হয়েছে কেউ দোষী থাকলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই ট্যাঙ্ক দিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই জল পড়ছিল বলে যাত্রীরা অভিযোগ করা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, কয়েকদিন আগেই ওই ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করা হয়েছে। যাত্রীরা অভিযোগের সূরে এদিন বলেছেন, প্রকৃত মেরামাতের দিকে নজর না দিয়ে চটকদারি মডেল স্টেশন করার দিকে বেশি ঝোক রেলের।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মৃতদের মধ্যে একজন মহিলা ও দু’জন পুরুষ। নিহতদের নাম মাফিজা খাতুন (৩৫)। তাঁর বাড়ি বর্ধমানের লাকুর্ডি এলাকার কাটরাপোতায়। কান্তি বাহাদুর (১৬)। বাড়ি বিহারের সাহেবগঞ্জ এলাকায়। সোনারাম টুডু(৩৫) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এদিনের দুর্ঘটনায়। তিনি ঝাড়খণ্ডের পাকুড়ের বাসিন্দা।
জানা গেছে এদিন মাফিজা খাতুন এবং তাঁর স্বামী আব্দুল মফিজ সেখকে নিয়ে মাফিজা খাতুনের বোনঝিকে হাওড়ায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর বোনঝিকে দিল্লীর গাড়িতে তুলে দেবার জন্য। এই দুর্ঘটনার জেরে মাফিজা খাতুনের মৃত্যু হলও অল্পবিস্তর আহত হয়েছেন তাঁর স্বামী ও বোনঝি। কান্তি বাহাদুর বর্ধমানে আত্মীয় বাড়ি থেকে এদিন সে সাহেবগঞ্জ যাবার জন্য যাত্রী সেডের নীচে অপেক্ষা করছিল।
রেল দপ্তরের চুড়ান্ত গাফিলতির জেরে বুধবার দুপুরে প্রাণ হারালেন ৩ জন যাত্রী। আহত হন প্রায় ৪০ জন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কমপক্ষে ৪জন। এদিন দুপুর ১২টা ৮ মিনিট নাগাদ আর পাঁচটা দিনের মতই বর্ধমান জংশনের ২ ও ৩ নং প্ল্যাটফর্মের মাঝে যাত্রী সেডে বহু যাত্রী ট্রেনের জন্য প্রতীক্ষায় বসে ছিলেন। ঠিক সেই সময়েই এই যাত্রী সেডের লাগোয়া প্রায় ৫০ ফুট ওপরে থাকা ১৮৯০ সালে তৈরি হওয়া ধাতব পাতের জলের ট্যাঙ্কের একাংশ আচমকাই ভেঙে আছড়ে পড়ে ওই যাত্রী সেডে। মূহূর্তের মধ্যে লোহার বিমের ওপর থাকা ওই সেডের মাঝামাঝি ভেঙে পড়ে যাত্রীদের ওপর। ভারী জল ট্যাংকের ধাতব পাত ভেঙে আছড়ে পড়ে ১ ও ২ নং প্ল্যাটফর্মের মাঝে রেল লাইনের ওপর। ভারী ধাতব পাত পাথরের ওপর পড়ায় রেল লাইনের পাথর ছিটকে পড়ে চর্তুদিকে। এই পাথরের আঘাতেও বেশ কয়েকজন জখম হয়েছেন বলে যাত্রী সূত্রে জানা গেছে। এদিকে, ওই জলের ট্যাঙ্ক আচমকাই ভেঙে পড়ায় ৫৩ হাজার ৮০০ গ্যালন জল আছড়ে পড়ে নীচে। জলের তোড়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে ১০-২০ ফুট দূরে ছিটকে পড়েন যাত্রীরা রেল লাইনের ওপর। মূহূর্তে গোটা ষ্টেশন জুড়ে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান বর্ধমানের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাঝি। প্রকৃত মেরামত বা নজরদারী নেই। তারই মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এদিন দুর্ঘটনার খবর । তিনি জানিয়েছেন, রেল বর্ধমানকে মডেল ষ্টেশন না করে শক্তপোক্ত ষ্টেশন তৈরী করুক। কারণ এর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে এই ষ্টেশনের সামনের ভবনের একাংশ ভেঙে পড়েছিল। এমনকি পদপিষ্ট হয়ে মারাও যান যাত্রী। সর্বোপরি একাধিক এক্সলেটর থাকলেও সেগুলি অচল। সবমিলিয়ে এই দুর্ঘটনার জন্য রেলের এই গাফিলতিকেই তিনি দায়ী করেছেন।
অন্যদিকে, এই দুর্ঘটনার খবর পেয়েই জেলাশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সহ জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকরা ছুটে যান ঘটনাস্থলে। জেলা বিপর্যয় ব্যবস্থাপন দপ্তরের আধিকারিক পথিক বন্দোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ওই জল ট্যাঙ্কের নির্ধারিত জলধারণের বেশি জল ঢোকার জন্যই ট্যাঙ্ক ফেটে যায়।
এই দুর্ঘটনার বিষয়ে পূর্বরেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র জানিয়েছেন, দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন রেল মন্ত্রী।
জখমদের মধ্যে তরুণা খাতুন বলেন, এদিন ওই সময় ট্রেন ধরার জন্য স্বামী ও দুই বাচ্চাকে নিয়ে ২ নম্বর প্লাটফর্মে শেডের নীচে বসেছিলাম। ট্যাকঙ্ক থেকে অল্প অল্প জল লিক করছিল। তারপরেই আচমকা ট্যা ঙ্কটি ভেঙে পড়ে। তাতে আমি ও স্বামী জখম হই। এছাড়াও আরও বহু লোক জখম হয়েছেন।
স্টেশনের সাফাই কর্মী পানাগড়ের বাসিন্দা রামাশিস ডোম বলেন, আমি সকালে স্টেশনে সাফাইয়ের কাজ করছিলাম। সেই সময় আচমকা ট্যাঙ্কটি ভেঙে পড়ে। আমার হাতে ও পায়ে আঘাত লাগে। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে আসে জিআরপি। জিআরপি জখমদের উদ্ধার করে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে হাসপাতালে আসে বর্ধমান থানার পুলিশ। হাসপাতালের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও নার্সরা অতি দ্রুততার সঙ্গে জখমদের চিকিৎসা শুরু করেন। হাসপাতালের সুপার ডাঃ তাপস ঘোষ এসেও তদারকি শুরু করেন।
মৃত মাফিজা খাতুনের মামা মজিবুর মোল্লা বলেন, মফিজার বোন দিল্লিতে থাকে। বোনঝি কয়েকদিনের জন্য বর্ধমানে আসে। এদিন বোনঝির দিল্লিতে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। সেইমতো বোনঝিকে হাওড়ায় পৌঁছানোর জন্য বর্ধমান স্টেশনে হাওড়াগামী ট্রেন ধরতে আসে। তখনই এই দুর্ঘটনা ঘটে।
যাত্রীদের অভিযোগ, দুর্ঘটনার পর জখমদের নিয়ে যাওয়ার জন্য রেলের তরফে কোনওরকম অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়নি। টোটোয় করে জখমদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। স্টেশনের হকাররা উদ্ধার কাজে হাত লাগান। এদিকে, টোটোয়া করে জখমদের নিয়ে যাওয়া কারণে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেকটাই দেরি হয়ে যায় বলে অভিযোগ। আরও জানা গিয়েছে, বেশ কিছুদিন আগে বর্ধমান স্টেশনের হকাররা ট্যাঙ্ক থেকে জল লিক নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু, তা মেরামতের জন্য কোনওরকম পদক্ষেপ নেয়নি রেল বলে অভিযোগ।
যাত্রীদের বক্তব্য দেশের লাইফলাইন হল ট্রেন। লোকাল হোক বা দূরপাল্লার, যাতায়াতের ক্ষেত্রে এই ট্রেনের ওপর ভরসা করেন বহু মানুষ। কোটি কোটি মানুষ যে পরিবহনে গন্তব্যে পৌঁছয়, সেই ক্ষেত্রে প্রকৃত মেরামাতের দিকে নজর দেওয়া জরুরি।
Comments :0