BAHA: SPRING FESTIVAL

‘বাহা’: আদিবাসী বসন্ত উৎসবে সমন্বয়ের বার্তা

রাজ্য জেলা

BAHA SPRING FESTIVAL বাহা উৎসবে, যৌথ সমাজের বার্তা

ড. জলধর কর্মকার

 

আদিবাসীদের মধ্যে কেউ বলেন বাহা। কেউ বলেন সারহুলকেউ বা ফাগুয়াকেউ বা খাদ্দিআবার কেউ বা শালুই পূজা। তবে আসলে তা বসন্ত উৎসব। সাঁওতাল সহ ওরাঁও, মুন্ডা, কোল, কিষাণ, হো, বিরজিয়া, খেড়িয়া প্রায় সমস্ত আদিবাসীজনগোষ্ঠীর কাছেই বাহা এক পবিত্র উৎসব। 

পুরাতন নুতনকে বরণ করে এটাই প্রকৃতির নিয়ম।সেই অর্থে যখন মুকলিত বৃন্তের আগায় সহস্র শাখায় হেসে ওঠে, কুসুম সহ প্রায় সমস্ত গাছে কচিকচি লালপাতা, পলাশ, শিমুলের লালিমা, মহুয়া গাছে মহুয়ার ফুল আর আকাশে ফাগুন পূর্ণিমার চাঁদ এই মাহেন্দ্রযোগে অরণ্য দুলাল অদিবাসীরা মেতে ওঠেন এই বাহা উৎসবে। আদিবাসীরা সাধারণত তিনদিন ধরে এই উৎসব পালন করেন। প্রথম দিনটিকে বলা হয় উম। 

এই বিশেষ দিনে গ্রামের নায়েক বা পুজারি প্রকৃতির কোলে জাহের বা জাহিরা থানে এসে সেই জায়গাটিকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেন। খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি হয় জাহের সাড়িম। সেদিন রাতে তাঁকে অতন্ত শুচি ও পবিত্র হয়ে থাকতে হয়। দ্বিতীয় দিনটি হল সার্দি। এইদিন মারাংবুরু, জাহের আয়ো এবং মড়েকে তুরিইকোপ্রমুখের উদ্দেশ্যে পূজা নিবেদিত হয়। 

পূজা শেষে ছোট ছোট মুরগির বাচ্চার মাংস সহ রান্না হয় খিচুরি। গ্রামের শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা সকলেই সেদিন নতুন কাপড় পরে জাহরে এসে প্রথমে দেবস্থান এবং নায়েক বা পূজারিকে প্রণাম নিবেদন করে। নতুন কুলাতে পূজারির কাছে থাকে শাল ফুল। প্রতিজনকে তিনি এই নতুন ফুল উপহার দেন। মেয়েরা তা খোঁপায় নেয়। ছেলেরা গোঁজে কানে। এই বিশেষ দিন থেকে আদিবাসীরা নুতন পাতা ও ফুল আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্যবহার শুরু করেন। এর পর খিচুরি প্রসাদ গ্রহণের পর সারাদিন ও রাত ধরে চলে বাহা নিত্য। তৃতীয় দিন হলো বাহা সেঁদরা। এইদিনে পলাশ ফুলের রঙে রাঙানো জল দিয়ে হিলি খেলেন। কোন প্রকার রাসায়নিক ব্যবহৃত হয় না। আর ছেলেরা যায় পাশাপাশি জঙ্গলে শিকার করতে। 

বাহা উৎসব আদিবাসীদের কাছে নিছক অনাবিল আনন্দ উৎসব নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে বিজ্ঞানচেতনা, রয়েছে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ, রয়েছে সাম্য, মৈত্রীর আদর্শ। কারণ বাহা গানে রয়েছে ‘পৃথিবীর ঘূর্ণনের কথা।’ সমান ভাবে খিচুড় বন্টনে রয়েছে সাম্যের আদর্শ। আর বাহার দিনক্ষণ নির্ণয়ে গ্রামবাসীর সমবেত আলোচনায় রয়েছে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ। ‘খড়ের জাহের সাড়িমের নিচে পূজা নিবেদনের অর্থ আমরা সকলেই এক ঈশ্বরের সন্তান। পুজা নিবেদনের সময় বাখের বা স্তোত্রগুলি উচ্চারিত হয় সামগ্রিক মঙ্গলকামনায়। ‘বহুজন সুখায় বহুজন হিতায়’ এর আদর্শ রয়েছে বাহায়। পলাশ ফুলের রঙে নিজের প্রিয়জনকে রঙিন করার অর্থ সকলকে কলুষমুক্ত করা। ধনী-গরিব সবাই একসাথে মিলিত হয়ে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে উৎসবে মিলিত হন। এভাবেই এই উৎসবে রচিত হয় সম্প্রীতির বাতাবরণ। 

এই সর্বজনীন বিশ্বাস মানুষকে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্দধে রুখে দাঁড়াবার প্রেরণা জোগায়। অন্যের উপকারে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে মানুষকে। 

(প্রতিবেদক পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সঙ্ঘের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক ও আদিবাসী সংস্কৃতির গবেষক)

Comments :0

Login to leave a comment