Sagardighi

উপনির্বাচনে জোরালো ধাক্কা তৃণমূল-বিজেপি’কে

রাজ্য

অনির্বাণ দে: সাগরদিঘি
 

তৃণমূলের ‘পাখির চোখে’ তির বিঁধলেন সাগরদিঘির সাধারণ মানুষ।
তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী দেবাশিস ব্যানার্জিকে ২২,৯৬৮ ভোটে  হারালেন বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস। একুশের ভোটে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিজেপি পিছিয়ে গিয়েছে তৃতীয় স্থানে। 
২০২১’র নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ৫০.৯৫ শতাংশ ভোট। ২০২৩’র নির্বাচনে তারা পেয়েছে ৩৪.৯৪ শতাংশ ভোট। কমেছে  ১৬.০১ শতাংশ ভোট। আবার বিজেপি ২০২১’র ভোটে ২৪.০৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবার বিজেপি প্রার্থী দিলীপ সাহা পেয়েছেন  ১৩.৯৪ শতাংশ। কমেছে  ১০.১৪ শতাংশ ভোট। বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন ৪৭.৩৫ শতাংশ ভোট। ২০২১’র নির্বাচনে বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছিলেন ১৯.৪৫ শতাংশ ভোট। বেড়েছে ২৭.৯ শতাংশ ভোট।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারে আসার পর এই প্রথম একটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী হলেন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও আইএসএফ ঐক্যবদ্ধভাবে যে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি করেছিল, তাতে একমাত্র ভাঙড় বিধনাসভা কেন্দ্রে আইএসএফ প্রার্থী নওসাদ সিদ্দিকী জয়ী হয়েছিলেন। রাজ্য বিধানসভায় একমাত্র বিরোধী বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকীকে প্রতিনিয়ত হেনস্তা করে চলেছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার। প্রতিহিংসামূলকভাবে তাঁকে ৪১দিন ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। সাগরদিঘিতে এই তাৎপর্যপূর্ণ জয়ের জন্য সাগরদিঘির জনসাধারণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরি ও সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। এদিন অধীর চৌধুরি বলেন, “এই ভোটের ফল ইঙ্গিত দিচ্ছে, পঞ্চায়েত ভোট যদি নিরপেক্ষভাবে হয় তাহলে মুর্শিদাবাদ জেলায় কেন, সারা বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসকে খুঁজে পাওয়া যাবে না”। মহম্মদ সেলিম বলেন,‘‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সাগরদিঘি তার ফল। পঞ্চায়েতে ভোট লুট আটকাবো আমরা। মানুষ বুঝেছেন যে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করে তাঁদের ঠকানো হয়েছে। বিজেপি-তৃণমূল যৌথভাবে সেই কাজ করেছে।’’
সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। তাই, নির্বাচনের দিন ঘোষণার দিন থেকেই সাগরদিঘি ছিল আক্ষরিক অর্থেই হাইভোল্টেজ কেন্দ্র। ভোট ঘোষণার আগেই উড়ে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাগরদিঘির ধুমারপাহাড়ে করেছেন ‘প্রশাসনিক সভা’। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঘোষণা করেছেন বহু প্রকল্পের। আর দিয়েছেন রাজনৈতিক ভাষণ। 
এই কেন্দ্রে প্রচারে এসে ভোট নিয়ে সাগরদিঘির জনগণকেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জি। ভাইপো সাংসদ নিদান দিয়েছিলেন, যে বুথ, যে এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ভোটে  পিছিয়ে থাকবে সেই এলাকা ‘মীরজাফর’র এলাকা বলে চিহ্নিত হবে। এদিন অভিষেক ব্যানার্জিকে কড়া উত্তর দিয়েছেন সাগরদিঘির মানুষ।
এই কেন্দ্রে কংগ্রেস বাইরন বিশ্বাসের নাম ঘোষণা করে। বামফ্রন্টের সমর্থন চেয়ে চিঠি লেখেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি। কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করে মুর্শিদাবাদ জেলা বামফ্রন্ট। শুরু থেকেই চলেছে যৌথ প্রচার।
ভোটে জিততে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস বুথে বুথে মোতায়েন করেছিল বহিরাগত নেতাদের। সাগরদিঘির নেতাদের অট্টালিকায় থেকে ‘ভোট করাচ্ছিলেন’ তৃণমূলের বাহুবলী কাউন্সিলর, বিধায়ক থেকে মন্ত্রীরা। অনুন্নয়নের সাগরদিঘিতে বারবার বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে তৃণমূলের নেতাদের। সিপিআই(এম), কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধে  চলেছে লাগাতার ব্যক্তি কুৎসাও। তবে তৃণমূলের প্রচার যে ভালোভাবে নেননি মানুষ তা বুঝিয়েছেন ভোটে। 
বাইরন বিশ্বাসের সমর্থনে মিছিল, সমাবেশে ছিলেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, পার্টির জেলা সম্পাদক জামির মোল্লা থেকে স্থানীয় পার্টিনেতারা।
হাওয়া খারাপ বুঝে তৃণমূলের চাপে পাটকেডাঙার কংগ্রেস নেতা সাইদুর রহমানকে গ্রেপ্তারও করেছিল পুলিশ। তবে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে জামিন পান তিনি। ভোটের ৩ দিন  আগে সাগরদিঘি থানার ওসি’কে সরিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন। ভোটের আগের রাতে  নির্বাচনের আগে গ্রামে গ্রামে তাড়া খেয়েছেন তৃণমূলের নেতারা।
২৭ ফেব্রুয়ারি রাস্তায় থেকেই শান্তিপূর্ণ ভোট নিশ্চিত করেছেন কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট কর্মীরা। কোথাও তির, ধনুক হাতে, কোথাও রাস্তায় নেমে গ্রাম পাহারা দিয়েছেন সামসাবাদ থেকে  কাবিলপুরের মানুষ। সাগরদিঘির ভোট ছিল শান্তিপূর্ণ। মানুষ রাস্তায় থেকে রুখে দিয়েছিল তৃণমূলের নেতাদের বুথ দখলের চেষ্টা।
বৃহস্পতিবার সাগরদিঘির কামদাকিঙ্কর স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ে সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় ভোট গণনা। এদিন ফল ঘোষণা হতে দেখা যায়, প্রথম রাউন্ড থেকেই তৃণমূলের প্রার্থীকে হারিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস। শেষ রাউন্ডের পর জয়ী ঘোষণা করা হয় বাইরন বিশ্বাসকে।
ফলাফল দেখা যাচ্ছে, এমনকি তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী দেবাশিস ব্যানার্জির বাড়ি যে এলাকায় সেই বাড়ালা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেও লিড পেয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী। বাড়ালা গ্রাম পঞ্চায়াতের নরসিংহপুরে বিনোদবাটি স্কুলের বুথ লুট করার পরিকল্পনা করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। নবগ্রাম থেকে এলাকায় ঢোকার রাস্তায় পথ আটকেছিলেন আদিবাসী নিবিড় এলাকার মানুষ। তিরধনুকে রক্ষা করা সেই বুথেও কংগ্রেস প্রার্থী এগিয়েছেন ৪৩০ ভোটে। তৃণমূলের সমাজবিরোধী দাপটে অতিষ্ঠ কাবিলপুরের মানুষ পঞ্চায়েতের সব বুথেই লিড দিয়েছেন বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীকে।
জয়ের পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরি বলেন, “বাইরন বিশ্বাসের জয়ের পিছনে কংগ্রেস এবং তাঁর সাথে বামেদের সমর্থন রয়েছে। তৃণমূল যে বিজেপি’র দালালি করে এটা পরিষ্কার”। অধীর জানান, যারা আগে তৃণমূল, বিজেপি’কে ভোট দিয়েছেন, তাঁরাও এবার বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন।  অধীর চৌধুরি এদিন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোট সম্পর্কেও বলেন, ‘‘সাগরদিঘির মানুষ এই জোটকে মান্যতা দিয়েছে। এবার গোটা রাজ্যে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোটকে মানুষের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। তা হলেই পঞ্চায়েত ভোটে সাফল্য আসবে। জোটবদ্ধ হলেই তৃণমূলকে হারানো সম্ভব।’’
সাগরদিঘির মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন সিপিআই(এম) মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা। জামির মোল্লা বলেন, “মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারলে তৃণমূল, বিজেপি জিতবে না সেটা এই নির্বাচন প্রমাণ করল। তৃণমূলের শুধুই  দুর্নীতি চালিয়েছে, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি, শুধুই ভাঁওতা দিয়েছে। বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন সাগরদিঘির মানুষ”। জামির মোল্লা বলেন, ‘‘আর পেশিশক্তির জোরে কোনও নির্বাচন হতে দেবেন না মানুষ।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment